ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

প্রকাশিত: ০৭:১৫, ৯ মার্চ ২০১৮

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

(পূর্ব প্রকাশের পর) (পর্ব- ৭) এই পর্বটি কিভাবে শুরু করব তা নিয়ে ভাবছিলাম। নিতান্ত ব্যক্তিগত কিছু কথা বলেছি এর আগের পর্বে। আমি নানা রকম চিন্তার দ্বারা, ভাবনার দ্বারা স্পৃষ্ট হই এখন, তখন। তার মধ্যে যেমন মানবিক বিষয়গুলো আছে তেমনি সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিষয়গুলোও প্রায়ই প্রাধান্য পায়। অতীত নিয়ে লিখতে বসলে, আমি দেখেছি, এক মহাসমস্যা দেখা দেয় এই যে বর্তমান প্রায়শই সেই বর্ণনায় অনাহুতভাবে প্রবেশ করে। সেই রকমই ঘটল আজ। লিখতে বসে বর্তমান দ্বারা প্রভাবিত হলাম এবং কয়েকটি সাম্প্রতিক চিন্তা-ভাবনা আমার পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নেয়ার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। অতএব... ! সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রায় সব চ্যানেলে রাতের একটা বিশেষ সময় কিছু মানুষ এক বা একাধিক বিষয় নিয়ে তুমুল বিতর্কে অবতীর্ণ হয়। এই বিতর্কের জন্য টিভির আয়োজকরা বিষয়ের খোঁজে নিত্যই ঘুরে ফেরেন। ইদানীং অবশ্য বিষয়ের অভাব হচ্ছে না। আমাদের দেশে সাধারণ নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসছে এবং রাজনৈতিক অঙ্গন ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। এছাড়াও বিদেশ থেকে আমদানিকৃত উটকো ঝামেলা আমাদেরকে অহর্নিশি ব্যতিব্যস্ত রাখছে। উপরন্তু নানা রকম আপাত তুচ্ছ ঘটনা মানুষের মনের ওপরে প্রগাঢ় ছাপ ফেলে এবং তা নিয়েও আলোচনা সমালোচনা হতে দেখি আমাদের টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলে। তবে যে কোন বিষয়েই আলোচনা হোক না কেন আখেরে তা এসে রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করে। আমাদের রাজনীতিতে মূলত দুটি ধারা। একটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত গণআন্দোলনের ধারায় প্রতিষ্ঠিত রাজনীতি। অন্যটি পাকিস্তানী আদর্শ এবং ঐতিহ্যে পরিপুষ্ট সেনা ছাউনি থেকে জন্ম লাভ করা রাজনৈতিক কর্মকা-। প্রথমটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শ সঞ্জাত এবং অপরটি বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর বাংলাদেশে সেনা শাসনের প্রথম পুরুষ জেনারেল জিয়াউর রহমানের দ্বারা প্রবর্তিত। ভাবতে অবাক লাগে যে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যিনি ছিলেন আমাদের একজন সেক্টর কমান্ডার, তাঁর চিন্তা ধারায় এমন আমূল পরিবর্তন কী ভাবে এলো? ক্ষমতার লোভ কি এতই সর্বগ্রাসী? যাই হোক, সেই সময় থেকেই শুরু হয়ে গেল যা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশের জন্ম তার পরিপন্থী সকল কর্মকা-ের সূচনা। আমরা ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানী রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতির খোল নলচে সম্পূর্ণ পালটে ফেলার অভিপ্রায় নিয়েই যুদ্ধ করেছিলাম। ফলে ভেবেছিলাম যে আমাদের জাতির রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক অবকাঠামো হবে নতুন বৈপ্লবিক চেতনার দ্বারা অনুপ্রাণিত। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর থেকে আমরা আবার ঔপনিবেশিক ধারায় পথ চলা শুরু করলাম। রাষ্ট্রের প্রতিটি কর্মকান্ডে পাকিস্তানের ছায়া হলো স্পষ্ট প্রতিভাত। এখন বলতে দ্বিধা নেই যে, পাকিস্তানের এক সুদূরপ্রসারী চক্রান্তেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল। বস্তুত পক্ষে রাজনীতির পটপরিবর্তনের পর যখন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা দেশত্যাগ করে তখন অনেকেই মধ্যপ্রাচ্য হয়ে স্থান পেয়েছিল পাকিস্তানে। সুদীর্ঘ একুশ বছর পাকিস্তান পন্থীদের দাপটে যা কিছু বাঙালী চেতনায় পরিপুষ্ট তা নির্বাসিত হয়েছিল এই ভূখ- থেকে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যারা ছিলেন তারা বড় অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। বড় শক্ত সময় গেছে তাদের পায়ের নিচে মাটি খুঁজে পেতে। পাকিস্তানপন্থী সেনা নায়কদের প্রবর্তিত রাজনৈতিক আগ্রাসন যদিও স্তিমিত, এখনও দুঃখজনকভাবে তা লক্ষ্য করা যায় এদেশে। সেদিন একটি টক শো তে আওয়ামি লীগ এবং বিএনপির দুটি পরস্পরবিরোধী দলকে সামনা সামনি বসিয়ে সঞ্চালক প্রশ্ন করলেন যে তাদের মাঝে কোন আপস সম্ভব কিনা। দুই দলই এমনভাবে বললেন যাতে মনে হয় যে আপস অবশ্যই সম্ভব। আমি ভাবছিলাম যে, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে যখন উভয় পক্ষের মধ্যে এখন বিশাল ব্যবধান তখন কি করে একে অন্যের সঙ্গে হাত মেলাবেন। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখতে পাব যে সেখানে ভিন্ন ভিন্ন আদর্শ অনুপ্রাণিত রাজনৈতিক দল রয়েছে। তারা একে অন্যের সঙ্গে সর্বদাই বিবদমান। কেউ বাঁ, কেউ ডান আবার কেউ মধ্যপন্থী। তাদের প্রত্যেকেই মনে করেন যে, রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের ধ্যান-ধারণাই সঠিক। এ নিয়ে বিশাল বিতর্ক হয়, মাঝে মাঝে হিং¯্রতাও দেখতে পাই আমরা। কিন্তু স্বাধীন ভারতের জাতির পিতা যে মহাত্মা গান্ধী সে বিষয়ে তাদের মধ্যে কোন মতভেদ নেই। আমরা জানি যে বর্তমান ভারতের শাসক দল বিজেপি তাদের প্রতিপক্ষ কংগ্রেস কিংবা কমিউনিস্ট পার্টির কোন কর্মকা-কে সমর্থন করেন না। কিন্তু একই সময়ে কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা মহাত্মা গান্ধীর ছবিটি তাদের সকল কর্মকা-েই শোভা পায়। যে কোন রাষ্ট্রের কতগুলো মৌলিক দর্শন থাকে। সেগুলোর ব্যাপারে একমত হয়েই রাজনৈতিকভাবে ভিন্ন ভিন্ন পথে পথ চলা যায়। এটি সকল গণতান্ত্রিক দেশের ব্যাপারেই প্রযোজ্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন। এবং রিপাবলিকানরা তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা পিতা হিসেবে সকলে মানেন। বলাবাহুল্য, তিনি রাজনীতিগতভাবে ছিলেন একজন রিপাবলিকান। তবুও পরবর্তীতে প্রবর্তিত রিপাবলিকান দলের সম্পূর্ণ বিপরীতপন্থী ডেমোক্র্যাটরাও জর্জ ওয়াশিংটনকে মার্কিন রাজনীতির আদি পিতা বলে গ্রহণ করে নেয়। বাংলাদেশেই কেবল এর ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু কেউ কি অস্বীকার করতে পারেন যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অথবা স্বাধীনতায় সবচেয়ে বড় অবদান যার ছিল তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান? আজ যারা তাকে অস্বীকার করেন তারা এক সুদূরপ্রসারী দূরভিসন্ধিকে সমর্থন দেন বলে আমার বিশ্বাস। এই দূরভিসন্ধি কেবল পাকিস্তানপন্থীদের স্বার্থই রক্ষা করবে। ভুলিয়ে দেবে আমাদের সেই সব আদর্শ এবং মূল্যবোধ যার জন্যে আমরা ১৯৭১ এর নয় মাস এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। ৩০ লাখ লোকের আত্মাহুতির বিনিময়ে দেশটিকে স্বাধীন করেছিলাম। কোন স্বাধীনচেতা বাংলাদেশী চাইবে না যে, যে আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এবং যে মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠার জন্য লাখো মানুষ অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন তারা আবার সেই আদর্শ এবং মূল্যবোধকে অবলীলায় ভূলুণ্ঠিত করে সেই পশ্চাদগামী, অনগ্রসর এবং প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানী পথে পথ চলা শুরু করবে। তাহলে বিরোধটা কোথায়? কেন আমরা জাতি হিসেবে কতগুলো মৌলিক আদর্শ এবং মূল্যবোধের ব্যাপারে একমত হতে পারি না? আমি বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে ঘুরে বেড়াই অবিরাম। গ্রামের মানুষের সঙ্গে আমার নিত্যই কথাবার্তা হয়। রাজনীতি বিষয়েও মাঝে মধ্যেই তাদের অভিমত জানবার চেষ্টা করি। একটা বিষয় আমি লক্ষ্য করেছি যে, আমাদের দেশের সব স্তরের জনসাধারণই নিজস্ব একটি মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত। একবার আমি গ্রামের এক কৃষককে জিজ্ঞেস করেছিলাম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা কে? জবাবে সে লেশমাত্র দ্বিধা না করে বলেছিল,‘ক্যান? শেখের বেটা।’ ফলে সাধারণ বাঙালী গণমানুষের কাছে ত্রাতা হিসেবে একজনই আছেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। তাঁর বিভিন্ন কর্মকা- নিয়ে হয়ত মতভেদ থাকতে পারে তবে তারই প্রদর্শিত পথে যে স্বাধীনতা এসেছিল সে বিষয়ে কারও মনে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু মুশকিল হয়ে যায়, যখন আমরা অতি অল্প বিদ্যা অর্জন করে নিজেকে কেউকেটা ভাবতে শুরু করি। এই রকম অর্ধশিক্ষিত বামেদের কাছে বঙ্গবন্ধু একজন পাতি বুর্জোয়া। ধর্মভিত্তিক রাজনীতিবিদদের কাছে তিনি আধা মুসলমান, পাকিস্তানপন্থীদের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন রাষ্ট্রদ্রোহী। কিছু কিছু মৌলিক বিষয়ে রাজনীতির প্রকারভেদ থাকা সত্ত্বেও একমত হতেই হবে সকলকে দেশের এবং জাতির স্বার্থে। (চলবে)
×