ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

এক মুক্তিযোদ্ধার চলে যাওয়া

প্রকাশিত: ০৭:০৯, ৯ মার্চ ২০১৮

এক মুক্তিযোদ্ধার  চলে যাওয়া

স্বাধীনতার মাস এই মার্চেই চলে গেলেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর মতো একজন মুক্তিযোদ্ধা যিনি সম্ভ্রমহানিতার বিনিময়ে বীর সেনানীর মর্যাদায় অভিষিক্ত। উত্তাল মার্চের ভয়াল সময়টুকু স্মরণে আসলে পরবর্তী নয় মাসের অবর্ণনীয় অস্থিরতায় আজও আমরা আতঙ্কে শিউরে উঠি। স্মৃতিচারণের এই মহিমান্বিত মাসটিতে ৩০ লাখ শহীদের জীবন উৎসর্গ করার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত হয়ে আছে ২ লাখ বীরাঙ্গনা আত্ম সম্ভ্রমের করুণ আখ্যান। স্বাধীনতা অর্জনের রক্তঝরা পথপরিক্রমায় লাল-সবুজের পতাকা শুধু ক্ষতবিক্ষতই হয়নি অসংখ্য মা-বোনকেও হতে হয়েছে নিষ্ঠুর অত্যাচারের বলি। তেমনই এক নির্যাতিত নারী সৈনিক প্রিয়ভাষিণী। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে যার নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ১৯৪৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি খুলনায় প্রিয়ভাষিণীর জন্ম। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের সময় যার বয়স ছিল মাত্র ২৪ বছর। খুলনার পাওনিয়ার গার্লস হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করে খুলনা গার্লস কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান ফেরদৌসী ১৯৬৩ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে প্রথম বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তাদের দ্বারা লাঞ্ছিত হয়ে অসহায় অবস্থায় পড়লে আহসানউল্লাহ আহমেদের সঙ্গে তাঁর দ্বিতীয়বার বিয়ে হয়। তিনি তিন ছেলে ও তিন মেয়ের স্নেহময়ী জননী। স্বাধীনতার পরবর্তী সময় অর্থাৎ ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের অত্যাচারিত নারেিদর ‘বীরাঙ্গনায়’ ভূষিত করে তাদের যে মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেন সেখান থেকে অনেক নারী বাঁচার পথ খুঁজে পান। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীও পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আদেশক্রমে বীরাঙ্গনাদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল দুর্ভাগ্যক্রমে ’৭৫-এর রাজনৈতিক সহিংসতায় তা সাময়িকভাবে রুদ্ধ হয়ে যায়। পরবর্র্তী ২১ বছর সেই মহৎ প্রক্রিয়ার কোন নতুন কার্যক্রম চালু করা না গেলেও শেখ হাসিনার সরকার পুনরায় এই অসহায় বীরাঙ্গনাদের ব্যাপারে ভাবতে শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালের ১০ অক্টোবর বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল। ২০১৫ সালে ৪১ জন বীরাঙ্গনার নামের ওপর যে গেজেট প্রকাশ করা হয় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সেখানে প্রিয়ভাষিণীর নাম না থাকায় তিনি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত হন। যদিও তিনি সমস্ত বীরাঙ্গনার অধিকার আদায়ে সোচ্চার কণ্ঠ ছিলেন। সুতরাং আক্ষেপ করে বলেছিলেনÑ কোন কিছু চাওয়া আসলে কোন ব্যাপারই নয়Ñ তবু আমার নাম আসা উচিত ছিল। কোন অভিযোগ নয়Ñ অনেক মনোকষ্ট। ভাস্কর্য শিল্পী প্রিয়ভাষিণী তাঁর অসাধারণ নান্দনিক দক্ষতায় বিজ্ঞজনের দৃষ্টি আকর্ষণেও সমর্থ হন। তারই পুরস্কারস্বরূপ তাঁকে ২০১০ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা হয়। তবে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে মুক্তিযোদ্ধার খেতাবও দেন। ২০১৪ সালের বইমেলায় তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘নিন্দিত নন্দন’ প্রকাশ পায়। গত ছয় মাস ধরে তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে আসা-যাওয়ার মধ্য দিয়ে তার শেষ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো কাটে। গত বছরের নবেম্বরে তিনি বাথরুমে পড়ে আঘাতপ্রাপ্ত হলে হাসপাতালে ভর্তি হন। পরবর্তীতে হার্ট এ্যাটাকের মতো শারীরিক বিকলতায়ও আক্রান্ত হন। এরপর তিনি আর কোনভাবেই সুস্থ হয়ে ওঠেননি। ৬ মার্চ ল্যাবএইড হাসপাতালে ৭৯ বছরের এই প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা চিরতরে বিদায় নেন। তার মৃত্যুতে দেশ একজন সত্যিকারের স্বাধীনতা যোদ্ধাকে হারাল যাদের মর্যাদার বিনিময়ে লাল-সবুজের পতাকাকে অর্জন করতে হয়েছিল। এদের ঋণ অপরিশোধ্য। জাতি তাদের চিরদিন অবিস্মরণীয় করে রাখবে এমন আশা করা ছাড়া আর কিছু চাওয়ার নেই। এই বীর মুক্তিযোদ্ধার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা জ্ঞাপন করছি। জীবনের টানাপোড়েন, ঘাত-প্রতিঘাত অর্জন, বিসর্জন সব মিলিয়ে এই অকুতভয় জীবন যোদ্ধা প্রিয়ভাষিণীর বৈচিত্র্যিক জীবন ছিল এক দুঃসাহসিক অভিযাত্রা। মাত্র ১৬ বছরে বাল্য বিয়ের অভিশাপে পড়া এই লড়াকু সৈনিক অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়েও তাঁর শিক্ষা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো এক সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তবে বাল্যবিয়ের অভিঘাতে জবিনটা বাসন ও নির্বিঘœ কিংবা মসৃণ ছিল না। মাতুলালয়ে জন্ম নেয়া এই বীরযোদ্ধার শৈশব কেটেছে মাতামহের নিবিড় সান্নিধ্য আর ¯েœহছায়ায়। মাতামহ পেশায় আইনবিদই নন তার চেয়ে উল্লেখ্য কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন, শুধু তাই নয় অসাম্প্রদায়িক চেতনায় পরিপুষ্ট এ্যাডভোকেট আবদুল হাকিম ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের কালজয়ী নির্বাচনের অংশীদারও ছিলেন। এমন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ছত্রছায়ায় প্রিয়ভাষিণীর ও সঙ্গত কারণেই ভিন্নধারায় বইতে থাকে। তারও আগে ১৯৫২ সালে আইনের পেশায় নিজেকে আরও সফল করার উদ্দেশ্য নিয়ে আবদুল হাকিম ঢাকায় সুপ্রীম কোর্টে নতুনভাবে কর্মজীবন শুরু করেন। ফলে ঢাকায় প্রিয়ভাষিণী গত ৫ বছর বয়সে ভর্তি হন নারী শিক্ষা মন্দিরে পারিবারিক ঐতিহ্য তাকে তার সমবয়সীদের তুলনায় অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছিল সেটার স্পষ্ট স্বাক্ষর তার যাপিত জীবন। পরবর্তীতে জীবনের আর এক মহাযোগ ঘটে সিদ্ধেশ্বরী গার্লস হাই স্কুলে শিক্ষা জীবন শুরু করার সুবাদে। কারণ এখানে এসে যাঁর সান্নিধ্যে নিজেকে পূর্ণ করেছেন তিনি আর কেউ নন, মহীয়সী নারী শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তিনি ছিলেন তখন ঐ স্কুলের প্রধান শিক্ষক। প্রিয়ভাষিণী স্কুলে প্রতিদিন উপস্থিত থাকার কৃতিত্ব পুরস্কৃতও হয়েছেন। এক স্মৃতিচারগে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন পড়াশোনার কারণেই যে স্কুলে যাওয়া তা কিন্তু নয়, আসলে মূল লক্ষ্য ছিল প্রতিদিন জাহানারা ইমামকে এক নজর দেখার। সেই বোধেই অতিবাল্যকাল থেকে প্রিয়ভাষিণী ছিলেন স্বাধীনচেতা, নিজের মতো করে নৈসর্গিক বাংলার চিরায়ত রূপ সুষমায় নিবিষ্ট হওয়ার মতো নান্দনিক চৈতন্য। যে শৈল্পিক শৈলী থেকে ভাস্কর্য নির্মাতা হওয়া এক অবিস্মরণীয় অভিগামিতা, ছোটকাল থেকেই নানার পাশাপাশি থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন দেশের বরেণ্য জ্ঞানী-গুণীদের মহা সম্মিলন। সেই চেতনাও জীবনব্যাপী লালন-ধারণ করেছেন। যা তার জীবনের সিংহভাগ সময়কে নানা মাত্রিকে ভরিয়েও তুলেছে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ এই প্রিয়ভাষিণীর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব তাঁদের কবিতা আবৃত্তি করে প্রতিযোগিতার প্রথম সারিতে অসতে তার কখনও সময় লাগেনি। বড় মামা নাজিম মাহমুদ ছিলেন ইংরেজী সাহিত্যের একজন জ্ঞানী ব্যক্তিই নয় সাংস্কৃতিক বলয়ের একজন পুরোধাও বটে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সংস্কৃতির একজন অগ্রনায়ক এই নাজিম মাহমুদ ভাগ্নি ফেরদৌসিকে কতখানি অনুপ্রাণিত করেছিলেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রিয়ভার্ষিণীর আবৃত্তির ব্যাপারে এই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের একটি মূল্যবান বাণী সবসময়ই বীরযোদ্ধাকে উদ্বুদ্ধ করেছে। বার্তাটি হলো আবৃত্তি পুরস্কারের জন্যে নয়। কেবলমাত্র অনাবিল আনন্দের। কত গভীর বোধ দিয়ে কবির অভিব্যক্তিকে যথার্থভাবে উপস্থাপন করা যায় সেটাই আবৃত্তির অন্যতম নির্ণয়ের শক্তি। আর তাই নির্দ্বিধায় বলা যায় ফেরদৌসির গড়ে ওঠা, প্রতিদিনের জীবনে সাংস্কৃতিক আবহ তৈরি হওয়া শুধু পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণেই নয়, অন্তরের গভীর চৈতন্যের অনুপম শৈলীরও এক নিরবচ্ছিন্ন শৈল্পিক অনুভব। তবে তাঁর এই স্বাপ্নিক জীবনের মাঝপথে ছন্দপতন হয়। কারণ মাত্র ৯ বছর বয়সে তাকে খুলনায় চলে আসতে হয় বাবা-মার কাছে। সৈয়দ বংশের পিতার পারিবারিক ঐতিহ্যের অহমিকা ছিল অত্যন্ত প্রবল। যার কারণে মাকেও অনেক কষ্ট পেতে দেখেছেন প্রিয়ভাষিণী। বাবা সুশিক্ষিত এবং দৌলতপুর কলেজে কমার্সের অধ্যাপক ছিলেন। তিনিও শিল্প সংস্কৃতিরা পরিচর্যায় কোনভাবেই পিছিয়ে ছিলেন না। নাটক পরিবেশনায় সিদ্ধহস্ত এই মানুষটি অভিনয়ও পারদর্শী ছিলেন। সাংস্কৃতিক পরিবারে জন্ম নেয়া মাও ছিলেন শিল্প সাহিত্যের একনিষ্ঠ ভক্ত। ওস্তাদের হাতে গানের তালিম নেয়া মা, রবীন্দ্রনাথ ও অতুল প্রসাদের সঙ্গীত পরিবেশন করতে ভীষণ ভালবাসতেন। প্রিয়ভাষিণীরও সঙ্গীতের হাতে খড়ি হয়েছিল মায়ের পাশাপাশি। আর গানের প্রতি ভালবাসা ও মমতা তার সব সময়ই অটুট ছিল। এমন শৈল্পিক সত্তায় যার শৈশব কৈশোর পার হয়ে যৌবনের স্বর্ণ শিখরে পদার্পণ সেখানে ভাস্কর্যের নন্দনতত্ত্ব তাঁকে কতখানি সমৃদ্ধ করেছিল তার প্রমাণ জীবদ্দশাতেই তিনি রেখে যান। অতি বাল্যকাল থেকে এক অপার শৈল্পিক বোধে তৈরি হওয়া প্রিয়ভাষিণী সময়ের মিছিলে নিজেকে যেভাবে ঋণ করেন সেখান থেকেই ভাস্কর্য শিল্পীর শীর্ষ মর্যাদায় ওঠে আসতে তাকে বেগ পেতে হয়নি। ভাস্কর্য স্থাপত্যের নির্মাণ শৈলীর অভূতপূর্ব সম্ভাবনাময় নান্দনিক শৌর্য তাকে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘স্বাধীনতার পদক’-এর দুর্লভ মর্যাদার অভিষিক্ত করে। যা যে কোন গুণী মানুষের সবচাইতে বড় প্রাপ্তি।
×