ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

রুহুল আমিন ভূঁইয়া

জাতির পিতার জন্মভূমি গোপালগঞ্জ

প্রকাশিত: ০৭:০৪, ৯ মার্চ ২০১৮

জাতির পিতার জন্মভূমি গোপালগঞ্জ

অপরূপ সৌন্দর্যে মহিমান্বিত আমাদের এই বাংলাদেশ। চারদিকে সবুজের সমারোহ, বয়ে যাওয়া নদীর কলতান, পাখির কলকাকলী পাহাড়-পর্বত সব কিছু মিলিয়ে প্রকৃতি অপার এক মহিমা বিরাজ করছে আামাদের এই ভূখন্ডে। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠী বাস করছে এই বদ্বীপে। বর্ণ, ধর্ম, জাতি এবং উপজাতির পরিচয়ের উর্ধে উঠে এসে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সহাবস্থানে নজির আমাদের ইতিহাসকে করেছে গৌরবান্বিত। বাংলাদেশে পর্যটকদের উপহার দেয়ার মতো প্রচুর আকর্ষণীয় বিষয় রয়েছে তার মধ্যে সমুদ্র সৈকত হ্রদ, পাহাড়, বন্যপ্রাণী, আবহমান গ্রামীণ জীবন, উপজাতীয় জীবনধারা, প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন ঐতিহাসিক কীর্তি, লোক কাহিনী হস্তশিল্প, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধর্মীয় কৃষ্টি, কবি গান, বাউল গান, যাত্রা গান পল্লীগীতি ভাওয়াইয়া, জারি গান, মুর্শিদী, মারুফতি, লালন গীতি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশে পর্যটন আকর্ষণীয় এক নাম গোপালগঞ্জ-টুঙ্গিপাড়া। গোপালগঞ্জের ক্ষেতখামারগুলো সরিষার হলুদ রঙে ছেয়ে গেছে। যে দিকেই চোখ যাবে সে দিকেই শুধু হলুদ আর হলুদ। দূর থেকে মনে হয় কোন শান্ত-স্নিগ্ধ মেয়ে হলুদ শাড়ি পরে আচল বিছিয়ে রেখেছে। ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে সরিষার ক্ষেত। আর আকাশ যেন শিমুল আর পলাশ ফুলের লাল রঙে রাঙিয়ে নিয়েছে নিজেকে। গাছে গাছে রয়েছে সোনালি গাছের সোনালি ফুলের অপরূপ দৃশ্য। এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। এ দৃশ্য প্রকৃতি প্রেমিককে যেন প্রকৃতির কাছে টেনে নিতে চায়। শুধু ক্ষেত আর খামারই নয় গ্রামের প্রতিটি বাড়ি আর অফিস আদালত ছেয়ে গেছে গাঁদা ফুলের হলুদ আর কাগজী ফুলের গোলাপী আর সাদা রঙে। পিছিয়ে নেই নদীমাতৃক বাংলাদেশে খাল বিলগুলো। কচুরিপানার বেগুনি রং রাঙিয়ে তুলেছে স্বচ্ছ জলকণা। সেই সঙ্গে আমগাছের হলুদ রঙের মুকুল। এভাবে প্রকৃতি তার আপন সৌন্দর্যে সেজে আকৃষ্ট করছে প্রকৃতি প্রেমিকদের। স্বচ্ছ সাদা পানি, পানিতে শাপলা ফুল, পানির উপরে নীল আসমান, চারদিকে থৈ থৈ জল, পানির মাঝে হিজল গাছ, কনচ গাছ, চতুর্দিকে উঁচু নিচু টিলা, টিলার বুকে রয়েছে ছোট-বড় বাড়ি, পাখ-পাখালির কলতান, সারি সারি গাছ-গাছালি, খালবিল, পালতোলা নৌকা আর নৌকায় মানুষের যাতায়াত, জেলেদের মাছ ধরা, দলবদ্ধ হাঁসের অবাধ বিচরণ, এ সব মিলিয়ে এক একটা টিলা যেন একেকটা আলাদা আলাদা রাজ্য। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের যেন এক অপরূপ লীলাভূমি। এ যেন এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। অপরূপ সৌন্দর্য ঘেরা এ স্থানটির নাম হচ্ছে গোপালগঞ্জ। প্রাকৃতিক শোভায় সুশোভিত গোপালগঞ্জ জেলায় রয়েছে বহু দৃষ্টিনন্দন স্থান। এসব স্থানের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিধন্য টুঙ্গিপাড়া অন্যতম। মধুমতি নদীর তীরে পাটগাতির পরেই টুঙ্গিপাড়া। কোন কবি এখানে এলে রূপসী বাংলাকে স্বচক্ষে দেখতে পারেনি। তখন কবির কাব্যে প্রকৃতি নতুনতর রূপে অঙ্কিত হবে। কবি আলাদা এক জগত সৃষ্টি করবেন। টুঙ্গিপাড়ার গাঁয়ের মেঠো পথের পারে চোখে পড়বে বিল-ঝিল। আর সেখানে ফুটে রয়েছে কত না শাপলা। টগর-কামিনী ফুলের গন্ধেও মাতোয়ারা হতে হয় তখন। এই টুঙ্গিপাড়ায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধি। এখানে ঢুকতেই পাথরের গায়ে লেখা রয়েছে- ‘দাঁড়াও পথিক বর যথার্থ বাঙালী যদি তুমি হও। ক্ষণিক দাঁড়িয়ে যাও, এই সমাধিস্থলে। এখানে ঘুমিয়ে আছে, বাঙালীর সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা। এ দেশের মুক্তিদাতা, বাংলার নয়নের মণি” এই কথাগুলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই টুঙ্গিপাড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। শেখ লুৎফর রহমানের চার কন্যা ও দুই পুত্রের মধ্যে তৃতীয় সন্তান শেখ মুজিব। বাবা-মা ডাকতেন ‘খোকা’ বলে। তাঁর শৈশবকাল কাটে টুঙ্গিপাড়ায়। জীবনভর তিনি দুঃখী মানুষের পাশে থেকে সংগ্রাম করে গেছেন। পাকিস্তানীদের জুলুম-নির্যাতন সহ্য করে বার বার তিনি কারাগারে গিয়েছিলেন। তবুও বাংলার মানুষের পাশেই ছিলেন তিনি। ১৯৬৮-৬৯ সালে স্লোগান উঠলÑ ‘আগরতলার ষড়যন্ত্রের মিথ্যা মামলা মানি না’, ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই।’ ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে তিনি প্রায় দশ লাখ লোকের উপস্থিতিতে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। ১৮ মিনিটের ওই ভাষণে তিনি বাঙালীর মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান জানান। এই ভাষণে তিনি বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বাঙালীর এই অবিসংবাদিত নেতাকে তাঁর ধানম-ির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের আগে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সামরিক বাহিনীর কতিপয় বিপথগামী সদস্যের হাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন। গোপালগঞ্জ শহর থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে টুঙ্গিপাড়া। নির্জন নিরিবিলি একটি শহর। এখানে চারদিকে গাছ-গাছালি, ফল ও বিল। যেন ছবির মতো সাজানো এই টুঙ্গিপাড়া। বঙ্গবন্ধুর সমাধির পাশেই তাঁর বাড়ি। টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে তাঁর সমাধি ও বাড়ি দেখে কী মনে পড়বে নাÑ ‘নয়ন সম্মুখে তুমি নাই, নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠঁাঁই।’ টুঙ্গিপাড়ার সবুজ শ্যামল মায়ায় মোহিত হওয়ারই কথা। ওখানে মানুষ কত না সহজ-সরল। কয়েক মিনিট বাক্য বিনিময় হওয়ার পরে বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে যে সময় লাগে না। ধানক্ষেত দেখে বলবেন, ‘এখানে যে সোনা ফলে।’ কল্পনায় ভাসবে, ওই যে বাড়িঘর ওখানে বুঝিবা এক জোতদার বসবাস করেন। ওনার বাড়িতে গরু, মহিষ আছে। গরু, মহিষ দেখাশোনার জন্য এক রাখাল ছেলেও যে আছে। ওর নাম ‘কৃষ্ণ’। দারুণ বাঁশি বাজায়। বাস্তবেও এখানের বিল-ঝিলের পাশে রাখাল ছেলের বাঁশির সুর শুনে ও তাকে দেখে মনে পড়বেই কানন দেবীর গাওয়া- ‘রাখাল ছেলে বাঁশি বাজায়/ বাঁশি বাজে আর বাজে’ গানের এই কথাগুলো। সত্যিই এক ভাল লাগা আর নির্জনতা খুঁজে পাওয়ার এক মনোরম স্থান এই টুঙ্গিপাড়া।
×