ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নাহিদা আশরাফী

প্রিয়ভাষিণীর সঙ্গে এক বিকেল

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ৯ মার্চ ২০১৮

প্রিয়ভাষিণীর সঙ্গে এক বিকেল

যে সত্যভাষণ রূপকথার গল্পকেও হার মানায়, যা শুনলে নতুন প্রজন্মের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয় তাকে তো গল্পই বলা যায়। বাঁধ ভাঙা আবেগের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সেই জীবনমুখী গল্পের নায়িকাকে আমরা বের করে আনতে চেষ্টা করেছি মাত্র। আমরা যখন তার বাড়িতে পৌঁছাই তখন বিকেল নামেনি, নামার আয়োজন করছিল। বাড়ির সামনে দাঁড়ালেই আলাদা করে বলে দেয়া যাবে এটাই তার বাড়ি। ছোট ছোট ভাস্কর্য ও বাগান পরিবেষ্টিত বাড়ি যাকে আর দশটা বাড়ি থেকে আলাদা করা যায় সহজেই। ছোট নান্দনিক ড্রয়িংরুমে বসার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই নেমে এলেন সালটা ১৯৫৮। তৎকালীন স্পীকার হাউজ বর্তমানে যেটা মেট্রোলিটন পুলিশের কার্যালয়। সেই বিশাল হাউজের একটি রুমে এগারো বছরের একটা ছোট্ট মেয়ে আপন মনে খেলছিল। হঠাৎ আর্দালি আবুল মিয়া একটা চিঠি এনে দিল সেই ছোট্ট মেয়েটির হাতে। মেয়েটি তো অবাক! কে তাকে চিঠি লিখবে? ভেবেভেবে কুল কিনারা পায় না সে। সেই অবাক হবার মাত্রা আরো বেড়ে গেল যখন সে শুনলো চিঠিটা তাকে নাম সই করেই গ্রহণ করতে হবে। চিঠি হাতে নিয়ে খুলতেই মেয়েটি বুঝে ফেললো চিঠিটা কার লেখা। কারণ এমন শৈল্পিক হস্তাক্ষর বাড়িতে একজনেরই আছে এবং সেই হস্তাক্ষর নকলের প্রাণপণ চেষ্টা করেও বাড়িতে সবাই ব্যর্থ হয়েছে। তিনি আর কেউ নন মেয়েটির বড় মামা নাজিম মাহমুদ। চিঠি খুলতেই মেয়েটির নাম, তার পর গোটা গোটা হরফে লেখা, ‘সন্ধ্যা ছ’টায় পশ্চিমের ঘরে অবশ্যই দেখা করিবেন। জরুরি সভা, আশা করি বিষয়টি গোপন রাখিবেন। ‘এর পরে মেয়েটির বড় মামার স্বাক্ষর করা। সারাদিন উসখুস করতে করতেই চলে গেল। কি বিষয়ে সভা, কেন বিষয়টি এত গোপনীয় আর কে কে পেল এমন চিঠি, গোপনীয় বলে কাউকে জিজ্ঞাসাও করা যাচ্ছে না। বিশাল বাড়ির একান্নবর্তী পরিবারে আলাদা করে কার কাছে চিঠি লেখে কে জানে। দু একজন আকার ইঙ্গিতে একে ওকে জিজ্ঞাসা করছে, তুমি কি কিছু পেয়েছো? উত্তরদাতা পেলেও বলতে পারছে না। তাহলেই ধরা পড়ার ভয়। অবশেষে এলো সেই ক্ষণ। চুপি চুপি পশ্চিমের ঘরে যাওয়া হল। সেই ছোট মেয়েটি গিয়ে দেখল সে ছাড়াও সেখানে উপস্থিত তার চার খালা। তারপর বড় মামা বললেন সেই গোপন কথা, কথাটি হল সকাল বেলায় বকুল তলায় স্টেশন ওয়াগন দাঁড়িয়ে থাকবে। যে কজনকে ডাকা হলো তারা যেন চুপটি করে গাড়িতে গিয়ে বসেন। বড় মামা তাদের নিয়ে ইন্ডিয়ান হাইকমিশনে যাবেন, ওখানে পথের পাঁচালী দেখানো হবে। যেহেতু টিকেট মাত্র কয়েকটিই পাওয়া গিয়েছে এবং পথের পাঁচালী ছোটরা কিছুই বুঝবেন না অতএব ছোটরা যাতে মনে কষ্ট না পায় তাই এই সাবধানতা। এমন সচেতন, সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বেড়ে উঠা মেয়েটি তো জানে নিভু নিভু জীবন প্রদীপে কি করে নতুন করে আলো জ্বালাতে হয়, হেরে যেতে যেতেও ঘুরে দাঁড়াতে হয়। মেয়েটির বড় মামা সেলিম বুলবুল গান করতেন, তবলা বাজানোর কলা কৌশল নিয়ে একটি বইও লিখেছিলেন। এতো গেল মেয়েটির বড় মামার কথা, খালারাও গান আবৃত্তিতে পারদর্শী। মেয়েটির নানা আবদুল হাকিম ছিলেন একজন ডাকসাইটে উকিল, কংগ্রেসের একনিষ্ঠ কর্মী। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের শাসন আমলে স্পীকারও নিযুক্ত হন। অথচ এই মানুষটি মেঘনাদবধ কাব্য শুরু থেকে শেষাবধি মুখস্থ বলতে পারতেন। এতক্ষণে নিশ্চয় কারো বুঝতে বাকি নেই এই মেয়েটি কে। হ্যাঁ, এই সেই মেয়ে যে জীবনের কাছে নতজানু হয়নি কখনোই;বরং জীবনই নতজানু হয়ে কুর্নিশ করেছে তাকে। আমাদের সকলের প্রিয়মুখ ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। অসীম সাহসী এই বীর মুক্তিযোদ্ধার মুখোমুখি হয়ে জানতে চেয়েছিলাম তার আনন্দ বেদনা আর কান্নার গল্প। গল্পই তো। যে সত্যভাষণ রূপকথার গল্পকেও হার মানায়, যা শুনলে নতুন প্রজন্মের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয় তাকে তো গল্পই বলা যায়। বাঁধ ভাঙা আবেগের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সেই জীবনমুখী গল্পের নায়িকাকে আমরা বের করে আনতে চেষ্টা করেছি মাত্র। আমরা যখন তার বাড়িতে পৌঁছাই তখন বিকেল নামেনি, নামার আয়োজন করছিল। বাড়ির সামনে দাঁড়ালেই আলাদা করে বলে দেয়া যাবে এটাই তার বাড়ি। ছোট ছোট ভাস্কর্য ও বাগান পরিবেষ্টিত বাড়ি যাকে আর দশটা বাড়ি থেকে আলাদা করা যায় সহজেই। ছোট নান্দনিক ড্রয়িংরুমে বসার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই নেমে এলেন। খুব আন্তরিকভাবে কুশল বিনিময়ের পরে প্রশ্ন করার আগেই নিজে থেকে বলতে শুরু করলেন “জানো এত কথা বলেছি আমাকে নিয়ে, এখন আর কথা বলতেও ইচ্ছে করে না, শক্তিও পাই না। কিন্তু তোমাদের যখন দেখি তখন মন ভাল হয়ে যায়, আবার বলতে ইচ্ছে করে। এইযে তোমরা কাজ করছো, মেয়েদের কাজ করার সুযোগ কত বেড়েছে। মেয়েরা দিন দিন সাহসী হয়ে উঠছে এসব দেখে খুব ভাল লাগে জানো। আমাদের সময়ে এত স্বাধীনতা মেয়েদের ছিল না। অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। জানো তো, আমি বেড়ে উঠেছি আমার নানা বাড়িতে। আমার জীবনে মামা, খালা, নানার প্রভাব অনেক। খুলনার ডাক-বাংলার মোড়ে আমার নানা বাড়িটার নাম কি ছিল জানো? আমি ছোট করে উত্তর দিলাম “ফেয়ারী কুইন”। -ওমা, তুমি তো অনেক কিছুই জানো! আমার দাদা বাড়ির কথা কিছু জানো?’ আপনার দাদা সৈয়দ জহুরুল হক ছিলেন বড় লাটের কেয়ার টেকার। চলনে বলেন সাহেবী প্রভাব তার ছিল। এমনকি ফরিদপুরের চর কমলাপুর রোড বর্তমান যেটা খান বাহাদুর ইসমাইল হোসেন রোড নামে পরিচিত সেখানে তার তৈরি করা বাড়িটও ছিল পশ্চিমা ঢঙে। সৈয়দ বংশ নিয়ে তাদের গরিমা ও আভিজাত্যবোধেরও কমতি ছিল না। কিন্তু এ কথাও সত্যি যে আভিজাত্য ও অহংকারের সঙ্গে সঙ্গে তিনি জ্ঞানী হিসেবেও সুপরিচিত ছিলেন। আপনার বাবা সৈয়দ মাহবুবুল হক খুলনা দৌলতপুর কলেজে কর্মাসের অধ্যাপক ছিলেন। -হ্যাঁ, ঠিকই বলেছো আভিজাত্য, বংশগরিমা এসবের কারণে মা-বাবার সর্ম্পকটা কখনই ঠিক তেমন আন্তরিক ছিল না। ১৯৫২ তে নানার পরিবারের সাথে আমরাও ঢাকায় চলে এলাম। তখন আমার বয়স মাত্র পাঁচ, টিকাটুলির নারী শিক্ষা মন্দির আমার জীবনের প্রথম স্কুল। ডঃ মেহেরা নন্দি, যিনি আমার নানার ফিজিশিয়ান ছিলেন ,তার স্ত্রী মিসেস নন্দী ছিলেন সেই স্কুলের শিক্ষিকা। আমাকে বর্ণমালার পাঁচটি অক্ষর লিখতে বলায় আমি পুরো বর্ণমালা লিখে দিলাম। মিসেস নন্দী আমাকে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি না করিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করাতে চাইলেন, আমি রাজি হলাম না । প্রথম শ্রেণীতেই ভর্তি হলাম। ১৯৫৪ তে নানা স্পীকার হওয়ায় আমরা চলে এলাম মিন্টু রোডে। ওখানে এসে ভর্তি হলাম সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলে। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ছিলেন সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। এতো ভালবাসা তার কাছ থেকে পেয়েছি যে একদিনও ওনাকে না দেখে থাকতে পারতাম না। কিন্তু এই আনন্দ আমার কপালে বেশিদিন সইলো না। আমার বাবা বাধ্য করলেন আমাদেরকে তার কাছে চলে যেতে। এটা ১৯৫৬ সালের দিকে। পরে নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে খুলনা পাইওনিয়ার র্গালস স্কুল থেকে এস.এস.সি ও র্গালস কলেজ থেকে ডিগ্রী পাস করি। ওহ্ যে কথা না বললেই নয় আমার ভার্স্কয ‘বীনাপানি পাঠশালা’র কথা জানো? খুলনা গিয়ে প্রথম এই পাঠশালতেই ভর্তি হই। ওখানে কাঠের খুঁটিতে কত কি লেখা থাকতো ‘খুকি+রহমান’ আ-মরি বাংলা ভাষা, আই লাভ ইউ’ আমার ভার্স্কযে এগুলো সব উঠে এসেছে । এ পর্যন্ত বলে বোধহয় কিছুটা ক্লান্ত বোধ করলেন। সেই সুযোগে তার কিছু ছবি নেবার জন্য বাড়ির বাইরে বাগানে যাবার অনুরোধ করলাম, সানন্দেই রাজি হলেন। সামনের অনেকটা জায়গা জুরে তার করা ভার্ষ্কয। আবার নিজে থেকে বলতে শুরু করলেন ‘‘এখন তো আর নিজে কিছু করতে পারি না। দুজন লোক রেখেছি। ওদের দেখিয়ে দেই, ওরাই আজ করে। প্রদর্শনীর সময়ে কোন ভাস্কর্য বিক্রি হলে আনন্দ পাই, না হলেও আনন্দ পাই মনে হয়। আমার সৃষ্টি আরও কিছু দিন আমার কাছেই থাকবে” আপা একটা প্রশ্ন- ভাস্কর্য শিল্পে আপনি এক নতুন ধারা চালু করেছিলেন এদেশে। মানুষ যা কিছু ফেলে দেয়, যা কিছু পরিত্যক্ত আপনি তা দিয়েই আপনার শিল্প জগৎ কে জীবন্ত করেছেন। -হ্যা ঠিকই বলেছ। আমি শুধু বোঝাতে চেয়েছিলাম শেষ বলে কোন কথা নেই। যেখান থেকে শেষ সেই স্থান থেকেই আবার শুরু। মৃত গাছের গুঁড়ি, মরা ডাল, শুকনো পাতা, ঘর যা পেয়েছি তাকেই শিল্পে রূপ দেবার চেষ্টা করেছি। শিল্পী এস এম সুলতান যখন বললেন ‘তুমি তো হেনরী মুরের সৌন্দর্য নিয়ে এসেছো তোমার ভাস্কর্যে, তখন আমি সত্যিই বিস্মিত হয়েছিলাম। আমার আর প্রকৃতির এক নিবিড় একাত্মতা ছিল, ছিল সান্নিধ্য। আমি তাকেই আমার নিমগ্ন সাধনায় রূপ দেবার চেষ্টা করেছি মাত্র। তা যে এতখানি নান্দনিক তা কে জানতো। তিনিই প্রথম আমার ভাস্কর্যের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন। যশোর শিল্পকলা একাডেমিতে এসব ভাস্কর্যের প্রদর্শনীতে বিশিষ্ট শিল্পী হাশেম খান মন্তব্য করেছিলেন ‘প্রিয়ভাষিণী’র শিল্পর্কম দেখে আমি বিস্মিত! তিনি অত্যন্ত উঁচুমানের ভাস্কর্য নির্মাণ করেছেন। তার এই সৃষ্টি ভাস্কর্য নির্মাণের ক্ষেত্রে নতুন এক ধারা তৈরি করেছে, এরপর ২০০৭ সালের আগস্টে প্রদর্শনী হলো বেঙল গ্যালারিতে। গল্পের ঠিক এই অবস্থানে একজন কফি নিয়ে এলো। আমায় বললেন ‘চেক করে দেখো তো কোনটা চিনি ছাড়া।’ আমার ইতস্ততভাব দেখে বললেন ‘তুমি ভেবো না। টেস্ট করে দেখ। তুমি মুখে দিলেও আমি সেই কফি খাব, তুমি জানো তোমায় দেখে আমার মেয়ের কথা মনে পরে গেল।’ আমি বিস্ময় আর আবেগ চেপে রাখার যারপরনাই চেষ্টা করলাম। কি এক অদৃশ্য বন্ধনে কত সহজেই তিনি আমায় জড়িয়ে নিলেন। আমায় কিশোরী মেয়ের মত বলে উঠলেন, ‘জানো আমি না চায়ে বিস্কিট ভিজিয়ে খেতে পছন্দ করি। আমার এক বান্ধবী আছে ও অনেক রকম বিস্কিট নিয়ে আসে আমার জন্য।’ আমি বিমুগ্ধ চোখে বেড়ে ওঠা শরীরের ভাঁজে লুকিয়ে থাকা এক কিশোরীকে অবিষ্কার করলাম। কফি পর্ব শেষ হলো। আমি উসখুস করছিলাম, কিভাবে শুনতে চাইবো কেমন করে উপস্থাপন করবো আমার কথাগুলো যাতে তার কষ্টের বা অভিমানের দেয়াল আর বাড়বে না। আমার এমন অবস্থা থেকে তিনিই আমায় উদ্ধার করলেন। ‘নিজে থেকে কত গল্প করলাম তোমার সাথে, এবার বলো, তোমার কি জানতে ইচ্ছে করছে।’ আমি খুকখুক করে কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলাম। মুক্তিযুদ্ধকালীন তার সেই অবর্ণনীয় কষ্ট, অত্যাচার আর নির্যাতনের কথা ঠিক কেমন করে জানতে চাইলে তিনি সহজ বোধ করবেন তাই ভাবছিলাম। পরিবেশ হালকা করে নিতে প্রথমেই তাই কিছু সহজাত বিষয় জানতে চাইলাম।আপনার প্রিয় কিছু বিষয় জানতে চাই। যেমন- কী রঙ পছন্দ, কী খেতে ভালবাসেন, কী পোশাকে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন এইসব আর কি। -ঋতুভিত্তিক, যে ঋতুতে যে রঙ যায় সেই রঙকেই বেছে নেই। লাল ভাল লাগে, সবুজ ভালো লাগে, নীল ভালো লাগে তবে বেগুনিটা একটু কম পছন্দ করি, সে কারণটাও বেশ অদ্ভুত। এই রঙে কোন বিদ্রোহ খুঁজে পাই না আমি। তাই বেগুনিটা কম পছন্দ। প্রিয় পোষাক শাড়ি, শাড়ি খুব প্রিয়, দেশজ অনেক রকম শাড়ি আছে আমার। খুব মিষ্টি খেতে পছন্দ করতাম এক সময়। এখন আর অতটা খেতে পারি না। গরম ভাত, ডাল, পটল ভাজা খুব প্রিয়, বেগুন ভাজা আর ফুলকপির তরকারি হলে তো কোন কথাই নেই। ইলিশ মাছ ভীষণ প্রিয়। জানো আমি মনে করি মানুষের সাথে ঈশ্বরের এক নিবিড় সর্ম্পক আছে, নাইলে পৃথিবী কিসের উপর চলছে বলো? -আপা, একটা বিষয় খুব জানতে ইচ্ছে করছে, যুদ্ধকালীন যে কষ্ট আপনি পেয়েছেন জানি তার মর্ম বেদনা উপলব্ধি করার ক্ষমতা আমাদের কোন ভাবেই হবে না, তবুও সেই সময়ের কিছু ম্মৃতি কি আমাদের বলবেন? -আমরা আর কি কষ্ট করেছি বলো, কষ্ট সইতে সইতে নির্মম ভাবে যারা মারা গেছেন তাদের অসহায় অবস্থার কথা শুধু তারা জানে আর তাদের আল্লাহ জানে। আর যারা বেঁচে এসেছে তাদের কথা আবার অন্যরকম। বেঁচে থেকে সেই কষ্ট উপলব্ধির বিষয়টা আরও ভয়ঙ্কর। সমাজ বিতাড়িত, পরিবার-পরিজন বিতাড়িত, তুমি দেখো আমার স্বামী এত উদার মানুষ হওয়া সত্ত্বেও যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তিনি দ্বিধায় পড়লেন কি করে এই পরিস্থিতি সামাল দেবেন অথচ সব জেনেই কিন্তু তিনি আমায় গ্রহণ করেছিলেন। যদিও সেই দ্বিধা তিনি কাটিয়ে উঠেছিলেন, তবে মন থেকে একটা বিষয় বুঝেছিলাম যে আমাদের মাথা উঁচু করে বাঁচতে হবে। উনি চাইতেন না যুদ্ধ নির্যাতিত হবার বিষয়গুলি আমি সবার সামনে তুলে ধরি, সবাইকে জানাই। আমি তখন তাকে বলেছি, তুমি প্রথমে আমাকে সব জেনেশুনে প্রপোজ করেছিলে তখন আমি আমার তিন সন্তানদের কথা বিবেচনা করে একবার তোমাকে নাও বলে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম একজন র্আদশ মা হয়েই জীবন পার করে দেব। তাছাড়া তুমি অনেক সুদর্শন, শিক্ষিত, বড়লোকের ছেলে। এত আভিজাত্যের সাথে আমার কোন পরিচয় নেই। আমি দুটো শাড়ি পরে নয় মাস কাটিয়েছি। অনেক কষ্ট করেছি, জীবন ও সন্তানদের জন্যে অপমান, নির্যাতন সয়েও চাকরি ছাড়তে পারিনি। কত কষ্ট সয়েছি, লাঞ্ছিত হয়েছি পদে পদে। এত কিছুর পরেও তুমি আমাকে গ্রহণ করলে। নতুন জীবন দিলে, আমি কৃতজ্ঞ। তবে কেন আবার এত দ্বিধা? আমি মাথা নিচু করে রাখি। এই যোদ্ধাকে আমি আর কি প্রশ্ন করব। তবু চোখ তুলে চাইতেই উনি নিজেই বলতে শুরু করলেন- কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে প্রায় দুই রাত এক দিন ছিলাম, জানো যে আসছে সেই একবার নির্যাতন করছে। আমাকে রাখা হয়েছিল একটা অফির্সাস ক্লাবে। তখন অক্টোবর মাস। নওয়া পাড়ার সেই অফিসার্স মেসে অকথ্য নির্যাতন ও শারীরিক লাঞ্ছনা সয়ে জীবনীশক্তি যখন প্রায় শেষের দিকে তখনই হঠাৎ এক দয়ালু অফিসার আমার কাছে আসেন। এই গল্পটা বইতে দিয়েছিলাম কিনা মনে নেই। আমি তো ভেবেই নিয়েছিলাম উনিও এসেছেন আমাকে লাঞ্ছিত করতে। উনি আমার কাছে এসে কুশল জিজ্ঞেসা করলেন। আমি চুপ করে আছি দেখে উনি বললেন, “আমি বিলিয়ার্ড খেলছিলাম। আমার সদ্য ডির্ভোস হয়েছে। আমার একটা গার্লফ্রেন্ড ছিলো, তারও বিয়ে হয়ে গেছে আইয়ুব খানের ছেলের সাথে। আমি খুব নিঃসঙ্গ মানুষ। আপনাকে আমার ভালো লেগেছে, আপনি যদি রাজি থাকেন আপনাকে বিয়ে করে নিয়ে যেতে চাই। আপনারা খুব দ্রুতই স্বাধীনতা পেয়ে যাবেন। আমরা অযথাই এসে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছি। এটা ঠিক না। ইউ কান্ট ইমাজিন! কি পরিমাণ ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা ছড়িয়ে পরেছে। তোমার ওপর আরও অত্যচার চলবে। আমি তখন তাকে বিনয়ের সাথে বললাম, ‘মেজর আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ, তুমি আমার জীবন বাঁচিয়েছ, কিন্তু এই দেশ ছেড়ে, আমার সন্তানদের ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না। দেশ ছেড়ে গেলো তো আগেই যেতে পারতাম। এ নির্যাতন সহ্য করেও তবে কেন রয়েছি, আমি নিজের কাছে ছোট হয়ে যাব। আমার মতো একজন অখ্যাত, অচেনা মেয়ে তোমার মতন একজন মেজরের হাত ধরে নিশ্চিত জীবনে চলে গেলে কেউ হয়তো আমাকে নিয়ে ভাববেও না, কিন্তু আমার দেশ, আমার সন্তান, আমার প্রেম এসব রেখে এদেশ থেকে যাওয়ার থেকে নির্যাতন সয়ে যাব তাও ভালো।’ তখন সে তার হ্যাটটি মাথা থেকে খুলে রেখে আমাকে বলেন ‘আই স্যালুট ইউ’ আমি আমার প্রস্তাব ফিরিয়ে নিলাম, কিন্তু বাংলাদেশ কি বুঝবে তোমার এই স্যাক্রিফাইজ? এই যে প্রতি মুহূর্তে কত যন্ত্রণা, মৃত্যুভয় এগুলোর মূল্য কি বাংলাদেশ দেবে? আমি তখন তাকে বললাম ‘প্রতিনিয়ত আমার ভাই, বোন, বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন মারা যাচ্ছে। আমার সবকিছু চলে যাক তবুও এই দেশ ছেড়ে আামাকে যেতো বলো না। এই মা মাটিকে আমি অসম্মানিত হতে দিতে পারি না, উনি তখন বললেন, ‘তোমার জায়গায় অন্য কোন মেয়ে হলে হয়তো অবলীলায় এই প্রস্তাব মেনে নিত। কিন্তু তোমার এই দেশপ্রেম আমাকে মুগ্ধ করেছে। আজ থেকে তোমাকে আমি মায়ের আসনে বসালাম। এই কথা শুনে আমার চোখেও জল চলে এলো। খুব টাচ করেছিল বিষয়টা আমাকে। লক্ষ লক্ষ হিংস্র পশুর মধ্যে এই একজন মানুষ দেখেছিলাম, যিনি আমাকে সম্মানের সাথে বাঁচিয়েছিলেন। আমি তো মরেই গিয়েছিলাম, বিধ্বস্ত, নির্যাতিত, প্রতিনিয়ত মৃত্যু ভয়ে আতঙ্কিত এই আমাকে উনি তখন না বাঁচালে আজ হয়তো এখানে বসে তোমাদের সাথে কথা বলা হতো না। আমি মাথা নিচু করে রইলাম, এই বীরের দিকে চোখ তুলে তাকানোর মতো মনের জোর পাচ্ছিলাম না। কিছুটা সময় নিলেন নিজেকে সামলে নিতে, একটু থেমে আবারো বলতে শুরু করলেন- ধর্ষিত হবার মতোন ভীতিকর অভিজ্ঞতা যেন কারো জীবনে না ঘটে। এ যে কি কষ্ট ও যন্ত্রণাময় ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝতে পারবে না। তুমি ভাবতে পারো আঘাতে আঘাতে আমার শরীর এতটাই বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল যে মনে হতো মৃত্যুও এরচেয়ে অনেক ভাল। অই যে শুরুতে বলেছিলাম না যারা মারা গেছে তারা একরকম ভাবে বেঁচে গেছে। যারা বেঁচে থেকে এই যন্ত্রণা ভোগ করেছে তাদের অবস্থা আরও ভয়াবহ। ঘরের ভেতর তিনটি মানুষ অথচ পিন পতন নিস্তব্ধতা। তিনটি নারী বোধহয় আত্মার গভীরে উপলব্ধির বীজ বুনে চলছি নিজেদের মতন করে। সেই বীজে জল সেচের কারণেই হয়তবা সবার চোখের কোন ভিজে উঠছিল। হঠাৎ আমার মাথায় হাত দিলেন মহিয়সী, আমি চমকে তার দিকে তাকালাম- “মন খারাপ করে দিলাম? একটুও মন খারাপ করবে না, এই যে আমাকে দেখছো আমি নিজেও ওই জীবন ভুলে গেছি। দেশ আমাকে যে সম্মান দিয়েছে, দেশের মানুষ যে ভালবাসা দিয়েছে, পরিবার থেকে যে সাপোর্ট পেয়েছি এর চেয়ে বেশি এক জীবনে আর কি চাই? স্বাধীন দেশে সকালের রোদকেও সোনাঝরা আলো মনে হয়। প্রতি সকালে ঘুম ভেঙে যখন দরজার কাছে দাঁড়াই, বুকটা ভরে যায়। আমি স্বাধীন দেশের স্বাধীন বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারছি। এই যে তোমরা হেসে খেলে কাজ করতে পারছো, মেয়েদের স্বাধীনতা বেড়েছে এই তো আমি চেয়েছিলাম। ওই যে তখন বলেছিলাম ঈশ্বরের সাথে মানুষের এক নিবিড় সর্ম্পক আছে, সত্যি কিন্তু তাই। তিনি বেঁচে থাকার যে শক্তি আমায় প্রতিনিয়ত জুগিয়েছেন তার জোরেই তো এই বেঁচে থাকা। সন্ধ্যা তখন ছুঁই ছুঁই। আমাদের যাবার সময় হলো। অন্যদের কথা জানি না, কিন্তু আমার বুকের ভেতরটা কেন যেন ব্যথায় কেঁদে উঠতে চাইলো। মনে হলো কোন আপনজন ছেড়ে যাচ্ছি। আপনজনই তো, দেশ মাতার সম্ভ্রম ও সম্মান রক্ষায়-যে নিজেকে বিলিয়ে দেয় তাঁর চেয়ে আপন, তাঁর চেয়ে আত্মার আত্মীয়, তাঁর চেয়ে নিকটতম আর কে হতে পারে।
×