ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

সরল জীবনযাপনের গুরুত্ব

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৯ মার্চ ২০১৮

সরল জীবনযাপনের গুরুত্ব

মহাকালের দীর্ঘ পথপরিক্রমে মানুষের পার্থিব জীবন হচ্ছে খুবই ক্ষণিক সময়ের। মহাকালের সময় আলোকবর্ষের হিসেবে বিশ্লেষণ করলেও খেই হারিয়ে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। ‘জন্মিলেই মরিতে হয়’- এই অকাট্য সত্যটি সবারই জানা, এটা প্রতিটি প্রাণীর জন্যই সমানভাবে প্রযোজ্য। কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : কুল্লু নাফসিন জাইকাতুল মাউত- জীব মাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। (সূরা আল ইমরান : আয়াত-১৮৫) একটি সুনির্দিষ্ট মেয়াদকালের জন্য মানবসন্তানের পৃথিবীতে আগমন ঘটে। মানুষের পার্থিব জীবনের সেই স্থিরকৃত মেয়াদকালকেই বলা হয় আয়ু। মানুষের বয়স বৃদ্ধি পায়, একই সঙ্গে কমে যায় তার আয়ু। সব মানুষের আয়ু এক হয় না। আল্লাহ জাল্লা শানুহু যার জন্য যতটুকু আয়ু নির্ধারণ করে দেন, সে সেই অনুযায়ী এই পৃথিবীর আলো হাওয়ায় থাকতে পারে। এ সম্পর্কে কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : ‘তিনি তোমাদের মৃত্তিকা হতে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর এককাল নির্দিষ্ট করেছেন এবং আর একটি নির্ধারিত কাল আছে, যা তিনিই জ্ঞাত।’ (সূরা আন্আম : আয়াত-২)। উপর্যুক্ত আয়াতে কারিমা থেকে এটা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, আল্লাহ জাল্লা শানুহু মানুষের পার্থিব জীবনের মেয়াদ বা আয়ুষ্কাল নির্ধারণ করে দেন। অন্য একখানি আয়াতে কারিমায় ইরশাদ হয়েছে : আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত (ইল্লা বিইযনিল্লাহ্) কারও মৃত্যু হতে পারে না, যেহেতু তার মেয়াদ অবধারিত। কেউ পার্থিব প্রতিদান চাইলে আমি (আল্লাহ) তার কিছু দেই আর কেউ পারলৌকিক প্রতিদান চাইলে আমি (আল্লাহ্) তার কিছু দেই এবং অতিসত্বর কৃতজ্ঞদের পুরস্কৃত করব। (সূরা আল্ ইমরান : আয়াত ১৪৫)। মানুষের পার্থিব জীবনের মেয়াদের অবসান ঘটে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। মৃত্যু মানুষের পার্থিব জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটালেও অনন্ত জীবনের দিকে মানবসত্তার পথ করে দেয়। প্রিয় নবী সরওয়ারে কায়েনাত হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : পৃথিবী হচ্ছে আখিরাতের শস্যক্ষেত্র, অতএব পৃথিবীতে সৎকর্ম কর যাতে আখিরাতে পুণ্যের ফসল কাটতে পার। পার্থিব জীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : এই পার্থিব জীবন (হায়াতুদ্ দুনিয়া) তো অস্থায়ী উপভোগের আর আখিরাতই হচ্ছে চিরস্থায়ী আবাস। (সূরা মু’মিন : আয়াত ৩৯)। এই পার্থিব ক্ষণস্থায়ী জীবনকে সহজ-সরলভাবে নির্বাহ করার মধ্যে, সৎ চিন্তা ও সৎ কর্মের দ্বারা সুশোভিত করার মধ্যেই রয়েছে মানব জীবনের সার্থকতা। মানবিক মূল্যবোধের প্রকৃষ্ট বিকাশ ঘটে সহজ-সরল জীবনযাপনের মাধ্যমে। একজন সত্যনিষ্ঠ, প্রজ্ঞাবান এবং যথার্থ সংযমী মানুষের কাছে পার্থিব জীবনের বিলাস-বসন, ঐশ্বর্য আকর্ষণীয় হতে পারে না। এ সম্পর্কে কুরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : যারা সত্য প্রত্যাখ্যান করে তাদের নিকট পার্থিব জীবন সুশোভিত। তারা বিশ্বাসীদের ঠাট্টা-বিদ্রƒপ করে থাকে। অথচ যারা তাকওয়া অবলম্বন করে তারা কিয়ামতের দিন তাদের উর্ধে থাকবে। (সূরা বাকারা : আয়াত ২১২)। পার্থিব জীবন তো আখিরাতের তুলনায় ক্ষণস্থায়ী ভোগ মাত্র। (সূরা রা’দ : আয়াত ২৬)। পার্থিব ভোগ সামান্য এবং যে মুত্তাকি তার জন্য আখিরাতই উত্তম। (সূরা নিসা : আয়াত ৭৭) আখিরাতের তুলনায় পার্থিব জীবনের ভোগের উপকরণ অকিঞ্চিতকর (সূরা তওবা : আয়াত ৩৮)। উল্লেখ্য, যারা সংযমী, যারা পার্থিব জীবন অতিবাহিত করে সাবধানতা অবলম্বনের মাধ্যমে, যারা যা বৈধ তা গ্রহণ করে এবং যা অবৈধ তা বর্জন করে, যা ন্যায় তা করে, যা অন্যায় তার কাছ ঘেঁষাও হয় না, যারা সৎ কাজে আদেশ করে এবং অসৎ কাজ করতে নিষেধ করে, যারা আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী জীবন নির্বাহ করে এবং আল্লাহর রসূলের সুন্নাহ্র পায়রবী করে, যারা ছোট-বড় ও সন্দেহযুক্ত তাবত পাপ কার্য থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলে তারাই মুত্তাকিদের অন্তর্ভুক্ত। তাকওয়ার সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা জানতে চেয়ে একবার হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিআল্লাহ তায়ালা আন্হু বিশিষ্ট সাহাবি হযরত উবায় ইবনে কা’ব রাদিআল্লাহু তায়ালা আন্হুকে জিজ্ঞাসা করলেন : তাকওয়া কি? উত্তরে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন : আপনি কি কখনও কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করেছেন? হযরত উমর (রা) বললেন : হ্যাঁ। হযরত উবায় ইবনে কা’ব (রা) আবার জিজ্ঞাসা করলেন : আপনি সেই কণ্টকাকীর্ণ পথ কিভাবে অতিক্রম করেছিলেন? হযরত উমর (রা) বললেন : আমি সাবধানতা অবলম্বন করে দ্রুত গতিতে ওই পথ অতিক্রম করেছিলাম। তখন হযরত উবায় ইবনে কা’ব (রা) বললেন : এটাই তাকওয়া। কুরআন মজিদে ও হাদিস শরীফে তাকওয়া অবলম্বনের জোর তাগিদ রয়েছে। এটা নিশ্চিত জানতে হবে যে, কোন মানুষই চিরকাল পৃথিবীতে থাকে না, থাকতে পারে না। সময় হয়ে গেলেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে চলে যেতে হয়। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : নিশ্চয়ই যারা আমার সাক্ষাতের আশা পোষণ করে না ও পার্থিব জীবনেই পরিতুষ্ট এবং এতেই পরিতৃপ্ত থাকে ও যারা আমার নিদের্শনাবলী সম্বন্ধে অমনোযোগী, ওদেরই আবাসস্থল হচ্ছে আগুন; ওদের কৃতকর্মের জন্য। (সূরা ইউনুস : আয়াত ৭-৮)। যারা পার্থিব জীবনকে আখিরাতের চেয়ে ভালবাসে, মানুষকে নিবৃত্ত করে আল্লাহ্র পথ হতে এবং আল্লাহর পথ বক্র করতে চায়, ওরাই ঘোর বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছে। (সূরা ইব্রাহীম : আয়াত ৩)। পার্থিব জীবন আলস্যের জন্য নয়, হেলাফেলায় কাটানোর জন্য নয়। এটা হচ্ছে কর্মের জীবন আর সে কর্ম অবশ্যই হতে হবে সৎ কর্ম- আমালুস্ সালিহ। এই জীবন হেলায়ফেলায়, ভোগ-বিলাসের মধ্য দিয়ে কাটিয়ে দেয়ার জন্য নয়। এ জীবন মানবতার কল্যাণের জন্য, আখিরাতের পাথেয় সংগ্রহের জন্য, সত্য-সুন্দরকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। এই জীবনে ভোগ-বিলাস করার অবকাশ একজন পরিচ্ছন্ন বিত্তবান সত্যনিষ্ঠ মানবসত্তার মননে ঠাঁই লাভ করতে পারে না। এ জীবনে জীবিকা নির্বাহের জন্য যতটুকু প্রয়োজন তার অতিরিক্ত সবটুকু অন্যের প্রয়োজন মিটানোর উদ্দেশ্যে দান করে দেয়ার নির্দেশ ইসলামে রয়েছে। যাকাত ইসলামের পঞ্চ বুনিয়াদের অন্যতম। এ যাবত বিধানের মাধ্যমে বিত্তবানের ধন-সম্পদ বিত্তহীন, সর্বহারা ও অভাবগ্রস্তদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। কুরআন মজীদে স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ দেয়া হয়েছে : তাদের (বিত্তবানের) ধন-সম্পদে ন্যায্য অধিকার রয়েছে প্রার্থী ও বঞ্চিতের। (সূরা যারিয়াত : আয়াত ১৯)। ধন-সম্পদ থেকে কতটুকু দান করতে হবে তা জানার জন্য একবার প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহ ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামকে সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করেছিলেন এই প্রেক্ষিতে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : (হে রসূল) লোকে আপনাকে জিজ্ঞাসা করে তারা কী ব্যয় (দান) করবে? আপনি বলুন, যা উদ্বৃত্ত। (সূরা বাকারা : আয়াত ২১৯)। এই আয়াতে কারিমার মধ্য দিয়ে মানুষের প্রতি মানুষের কর্তব্যবোধ এবং সহজ-সরল জীবনযাপনের চেতনা অনুরণিত হয়েছে। চলবে... লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ
×