ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সামনে পবিত্র রমজান মাস ॥ ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ পর্যাপ্ত করুন

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৯ মার্চ ২০১৮

সামনে পবিত্র রমজান মাস ॥ ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ পর্যাপ্ত করুন

আজ মার্চ মাসের ৯ তারিখ। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে শুরু হবে পবিত্র রমজান। চট্টগ্রামের খবরে দেখা যাচ্ছে ব্যবসায়ীরা ইতোমধ্যেই শুরু করে দিয়েছেন আমদানির ব্যবস্থা। নিয়মিত আমদানি তো আছেই, এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে রোজার সামগ্রী। ছোলা, বুট, পেঁয়াজ, খেজুর থেকে শুরু করে অন্যান্য ভোগ্যপণ্য আমদানির তোড়জোড় এখন সর্বত্র। ঢাকা ও চট্টগ্রামের ব্যাংকগুলো ব্যস্ত আমদানি ঋণপত্র খুলতে। এটা খুবই স্বাভাবিক। তবে খবর পাচ্ছি না ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি)। এটি সরকারী প্রতিষ্ঠান। বাজার স্থিতিশীল রাখতে এর গুরুত্ব কমার পরিবর্তে দিন দিন বাড়ছে। বেসরকারী খাতের ‘উৎপাত’ সামলাতে এর কোন বিকল্প নেই। অথচ টিসিবি রোজার পণ্যসামগ্রী আমদানিতে নেমেছে কীনা তা কাগজে পাচ্ছি না। নামা উচিত কারণ প্রতিবছর এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী রোজার সময়ে নানা অঘটন ঘটান। তারা ধর্মপ্রাণ মানুষকে শান্তি দেন না। জিনিসপত্রের দাম বাড়ান। এই আশঙ্কা কিন্তু এবারও আছে। চালের দামই এর প্রমাণ। চালের দাম নিয়ে নয়-ছয় হচ্ছে বহুদিন ধরে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে অর্থাৎ আগের অর্থবছরে বড়জোর ৯-১০ লাখ টন চাল উৎপাদনে ঘাটতি হয়েছে। দুইটা বন্যার কারণে এমনিতে চাল-গমের উৎপাদন ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে ক্রম উর্ধমুখী। গেল অর্থবছরেই সামান্য ঘাটতি হয়েছে। অথচ এই ঘাটতির সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী আজও বাজারে ‘উৎপাত’ করছে। অথচ ‘উৎপাতের’ কোন হেতু নেই। সরকার যথেষ্ট পরিমাণে চাল আমদানির ব্যবস্থা করেছে। শুল্ক হ্রাস করে প্রায় শূন্যের কোটায় আনা হয়েছে। বেসরকারী খাতও চাল ও গম আমদানি করছে অনেক বেশি পরিমাণে। এক তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে চাল ও গম আমদানি হয়েছিল ৩৭ লাখ টনের মতো। এর বিপরীতে বর্তমান অর্থ বছরের (২০১৭-১৮) প্রথম সাত মাসে চাল ও গম আমদানি হয়েছে প্রায় ৬৯ লাখ টন। খবরের কাগজে প্রকাশিত তথ্য ঠিক হয়ে থাকলে চালে চালে বাজার এখন সয়লাব। আর কিছুদিনের মধ্যে দেশের অনেক অঞ্চলে বোরো ফসলও উঠতে শুরু করবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে চালের দামের উর্ধগতি থামছে না। চালের ব্যবসায়ীরা এক কথায় যাচ্ছেতাই ব্যবহার করছেন। এর থেকে কী শিক্ষা? শিক্ষা বরাবরের মতো একটাই। রোজার সময়েও তারা ভোক্তাদের রেহাই দেবে না যদি না সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারে। সরকারী হস্তক্ষেপ হচ্ছে ‘ওপেন মার্কেট অপারেশন’ (ওএমএস)। রোজার পণ্যসামগ্রী ‘টিসিবির’ স্টকে থাকতে হবে। সেই ব্যবস্থা হচ্ছে কী? আমি জানি না। বাণিজ্যমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন। করে থাকলে, ভাল। না করে থাকলে জরুরী ভিত্তিতে ভাবা উচিত। মনে রাখা দরকার, বাজার অর্থনীতি সরকারের কথা শোনে না। ব্যবসায়ীরা সরকারের ‘ভাই’ মুখে মুখে। তারা কোন সুযোগ ছাড়তে রাজি নয়। অতএব, ‘টিসিবির জন্য এই সতর্ক বার্তাটি জানান দিয়ে অন্য বিষয়ে চলে যাচ্ছি। একটু আলোচনা দরকার ‘খেলাপী ঋণ’ ও ‘ঋণ খেলাপী’ নিয়ে। এই কলামের একজন পাঠকের ধারণা খেলাপী ঋণ মানে এই টাকা মেরে দেয়া হয়েছে। তা আদায়ের কোন সম্ভাবনা নেই। টাকা আদায়ের সম্ভাবনা আছে কী নেই তা ভবিষ্যতই বলবে। তবে আইনীভাবে যে সমস্ত ‘খেলাপী ঋণ’ ‘রাইটঅফ’ বা অবলোপন করা হয়েছে সেসব ঋণের বেলায় প্রতিটি ক্ষেত্রে আদালতে মামলা আছে। ব্যাংকের দাবি ‘তামাদি’ হয়নি। ব্যাংক সুদ ও আসলের ওপর মামলা জারি রেখেছে। আর ওই ঋণের সমস্ত টাকা তার ‘প্রফিট’ থেকে কেটে ‘প্রভিশন’ হিসাবে রেখেছে। টাকা আদায় না হলে ব্যাংক ‘প্রভিশন’ থেকে তা পুষিয়ে নেবে। যতদূর জানা যায় ‘রাইটঅফ’ করা ঋণের পরিমাণ ৪০ হাজার কোটি টাকার মতো। এটা বাদে অন্যান্য খেলাপী ঋণের পরিমাণ ৮০ হাজার কোটি টাকার মতো। ‘খেলাপী’র অর্থটা বোঝা দরকার। ‘খেলাপী’ মানে শর্ত খেলাপী। ঋণ দেয়া হয় কতগুলো সর্তে। সুদের হার, জামানত, ঋণ পরিশোধের সময়সীমা এবং ডকুমেন্ট ইত্যাদি থাকে শর্তে। এসব শর্ত ভঙ্গ করলেই ঋণটি ধীরে ধীরে ‘খেলাপী’ হয় এবং ঋণ গ্রহীতা হন ‘ঋণ খেলাপী’। ‘ঋণ খেলাপী’ (ডিফল্ট) সমস্যা বাংলাদেশ, ভারত ও চীনসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই প্রকট হচ্ছে। এর অনেক কারণও আছে। ইচ্ছাকৃতভাবে যারা প্রভাব খাটিয়ে টাকা ফেরত দেয় না এটা একটা ‘ক্যাটাগরি’। তাদের অনেকই ঋণের টাকা জমিতে, শেয়ারে ‘ডাইভাট’ করেছেন, অনেকেই বিদেশে পাচারও করেছেন। আবার রয়েছে ব্যবসায়িক কারণ। ব্যবসায়িক লোকসান দিয়ে অনেক ব্যবসায়ী খেলাপী হয়েছেন। পিতা ভাল ব্যবসা করেছেন। পুত্ররা পিতার মৃত্যুর পর ব্যবসা ধরে রাখতে পারেনি। অথবা পুত্র-পুত্রীদের গ-গোল। এসব হাজারো কারণেও অনেক ঋণ খেলাপী। তবে খেলাপী ঋণ ভীষণভাবে বাড়ার আরেকটি কারণ আছে বলে আমি মনে করি। যদিও সচরাচর এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয় না। কোন্ ঋণটি কখন খেলাপী বা ‘ক্লাসিফাইড’ হবে তার একটা সংজ্ঞা আছে। ‘খেলাপী’ হলে কোন্ ধরনের ‘খেলাপী’ হবে তারও ক্যাটাগরি করা আছে। কোন ‘ক্যাটাগরির’ কোন ঋণ খেলাপী হলে এর বিপরীতে কত ‘প্রভিশন’ রাখতে হবে তার সংজ্ঞাও আছে। ‘কোলেটারেল’ কাকে বলে, কেন কোলেটারেলের মূল্য কত তারও ব্যাখ্যা আছে। খেলাপী ঋণ বাড়লে কীভাবে পুঁজি সংরক্ষণ করতে হবে তারও সংজ্ঞা দেয়া আছে। এভাবে ব্যাংকিংয়ের যাবতীয় ঝুঁকিতে আন্তর্জাতিকভাবে মান্য নিয়মবিধি আছে। এটা করেছে ‘ব্যাংক অব ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্ট’ (বিআইএস)। বলাবাহুল্য, নিয়মবিধিগুলো অঙ্কের মতো। পাঁচে পাঁচে দশ। এর কোন বিকল্প নেই। অথচ ব্যবসার ক্ষেত্রে সবসময় পাঁচে পাঁচে দশ হয় না। ব্যবসা সবসময় ভাল যায় না, সারা বছর ভাল যায় না, বছরের পর বছর ভাল যায় না। কিন্তু ব্যবসার এই সমস্যা ‘বিআইএস’ মানে না। সকল দেশের জন্য তা প্রযোজ্য, সমানভাবে প্রযোজ্য। অবশ্য কিছু ক্ষমতা দেয়া আছে সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। বলাইবাহুল্য, ‘বিআইসের’ সংজ্ঞা নিয়মবিধি কঠোর। এই কঠোরতার মধ্যেই বাংকগুলোকে কাজ করতে হয়। আমার ব্যক্তিগত ধারণা এই ‘কঠোরতম’ সংজ্ঞা, বিধি-নিয়ম মেনে চলতে গিয়েই দৃশ্যতই ‘খেলাপী’ ঋণের পরিমাণ দেশে দেশে বেশি পরিমাণে বাড়ছে। এতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সমালোচনার ঝড় উঠছে। মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে। সাম্প্রতিকতম উদাহরণ ভারত। সেই দেশ থেকে বড় বড় খেলাপীরা পালাচ্ছে। যারা পালাচ্ছে তারা ভারতের নাগরিক অন্য দেশেরও নাগরিক। বিদেশে তাদের টাকা রাখার জায়গা আছে। বহুদেশ ওই সমস্ত পাচার করা টাকা রাখার ব্যবস্থা করে দেয়। সম্ভবত এই ভরসাতেই টাকা মারার প্রবণতা সকল দেশে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাজার অর্থনীতি, অবাধ বাণিজ্য, বিশ্বায়ন, টেকনোলজি এসব কাজে উৎসাহ জোগাচ্ছে। উৎসাহ জোগাচ্ছে রাজনৈতিক ব্যবস্থা। রাজনীতি ও ব্যবসা এখন একাকার। ব্যবসায়ীরা আগে রাজনীতিবিদদের চাঁদা দিত। এখন তারা আর চাঁদা দেয় না, নিজেরাই রাজনীতি করে। রাজনীতি ও ব্যবসার মিলন দেশে দেশে আর্থিক ব্যবস্থাকে অস্থির করে তুলেছে। আমরাও এর শিকার। শিকার বলেই ‘ঋণ খেলাপী’র তালিকায় বড় বড় ঋণগ্রহীতারা নেই। তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মের অধীনেই এই তালিকার বাইরে। হাজার হাজার কোটি টাকার ‘খেলাপী ঋণে’ কার নাম আছে? নাম আছে সাধারণ ব্যবসায়ীদেরও। এই তালিকা অর্থমন্ত্রী দিয়েছেন। গত বছরের এপ্রিলের হিসাবে দেখা যায় খেলাপী ঋণের পরিমাণ এক লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। এতে কতজন ব্যবসায়ী ও প্রতিষ্ঠান আছে? দুই লাখ ২ হাজার ৬২৩ জন। এর থেকেই বোঝা যায় বিষয়টি কী? আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ‘ব্যাংকলেড’ গ্রোথে এই পরিণতি খুবই স্বাভাবিক। শ্রেণীবিন্যাসকরণ নীতিমালা, প্রভিশনিং নীতিমালা, পুঁজি সংরক্ষণ নীতিমালা, সিকিউরিটি এবং কোলেটারেল সিকিউরিটিজ নীতিমালা কঠোর হলে কী হবে, এসব কিছুই শিথিল হয়ে যায়, অকার্যকর হয়ে যায় ‘ব্যাংকলেড গ্রোথ’ এর কাছে। লোকের পুঁজি নেই, শেয়ারবাজারেও তারা যাবেন না অথচ তারা ব্যবসা করতে চান, উদ্যোক্তা হতে চান, শিল্পপতি হতে চান, গার্মেন্টস রফতানিকারক হতে চান, বড় বড় বস্ত্রকল করতে চান। এটা কীভাবে সম্ভব? সম্ভব ব্যাংকের টাকায়। ব্যবসায়ীরা ‘কোলেটারেল’ দেবে কোত্থেকে? সবেমাত্র ঢুকছেন ব্যবসাতে ব্যাংক এ্যাকাউন্ট খুলেছেন, ইনকামট্যাক্স ফাইল খুলেছেন। তিনি শিল্পপতি হতে চান। এর একমাত্র ব্যবস্থা ‘ব্যাংক ফিন্যান্স’। এর বিকল্পও নেই কিন্তু। পুঁজি নেই, ব্যাংকের মাধ্যমে ‘মিসইনভয়েসিং’ করেই তাকে পুঁজি তৈরি করতে হবে। এই অবস্থাতে ঋণ খেলাপ সমস্যা বাড়া ছাড়া গতি কী? প্রশ্ন আরও আছে? ‘ব্যাংক ফিন্যান্স’ না নিয়ে শিল্পায়ন করা কী সম্ভব নয়? সম্ভব, শেয়ারবাজার থেকে পুঁজি তুলে, অথবা নিজের পুঁজি গঠন করে। এটা কয়জনের পক্ষে সম্ভব? এমতাবস্থায় ঋণ খেলাপ, ঋণ খেলাপী সমস্যা, ব্যাংকের সমস্যা, শিল্পায়ন, প্রবৃদ্ধি, রফতানি, আমদানি ব্যবসা, বিশ্বায়ন, বাজার অর্থনীতি- সবকিছু নিয়েই আলোচনা হওয়া দরকার। বিচ্ছিন্নভাবে দেখে কোন সমস্যার টেকসই সমাধান সম্ভব নয়। সম্ভব যে নয় তার প্রমাণ ঋণ খেলাপ সমস্যার ওপর আলোচনা। দীর্ঘ তিন দশক ধরে এই আলোচনা চলছে। অথচ সমস্যা বাড়ছেই। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×