ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রশ্নফাঁসে ফায়ারিং স্কোয়াড!

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ৯ মার্চ ২০১৮

প্রশ্নফাঁসে ফায়ারিং স্কোয়াড!

জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহের এক অনুষ্ঠানে মঙ্গলবার রাষ্ট্রপতি প্রশ্নফাঁস সম্পর্কিত বহুল আলোচিত বিষয়ে লিখিত বক্তব্যের বাইরে গিয়ে যা বলেছেন, তা সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য। এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই, যে বা যারা প্রশ্ন ফাঁসের মতো জঘন্য ও নিন্দনীয় একটি কাজের সঙ্গে জড়িত, তারা প্রকৃতপক্ষে দেশ ও জাতির শত্রু। তাদের নীতিনৈতিকতা বলে কিছু নেই। কেবল অর্থের বিনিময়ে তারা যা খুশি তা-ই করতে পারে। করে যাচ্ছে। এমনকি আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘোষণাও তারা আগাম দিয়েছে। এই চক্রটি, যার সঙ্গে একশ্রেণীর প্রশ্নকর্তা, শিক্ষক, সংরক্ষক, সরবরাহকারী, মুদ্রাকর, সর্বোপরি কোচিং সেন্টার, শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা পর্যন্ত জড়িত প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে, তারা দেশ ও জাতির আগামী প্রজন্মকে ধ্বংসের পাঁয়তারা করছে। এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রপতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, প্রশ্নফাঁস ও বিতরণের সঙ্গে জড়িতদের ‘ফায়ারিং স্কোয়াডে’ দেয়া উচিত। মানবাধিকার কর্মীরা এতে আপত্তি তুললেও রাষ্ট্রপতি প্রকারান্তরে প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের কঠিন শাস্তি দেয়ার কথা বলেছেন। সরকার তথা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শত উদ্যোগ সত্ত্বেও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে যে, প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানো যাচ্ছে না কিছুতেই। গত এসএসসি পরীক্ষায়ও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। আগামী উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের হুমকিও দেয়া হয়েছে। সত্যি বলতে কি, গত কয়েক বছর ধরেই হচ্ছে এসব। পাবলিক পরীক্ষা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, চাকরিতে নিয়োগ পরীক্ষা এমনকি পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষাসহ প্রায় সব পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস যেন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সর্বাধিক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ায়। এতে স্বভাবতই সরকার, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বোর্ডের কর্মকর্তারা বেশ হতাশ, বিব্রত এবং অসহায় হয়ে পড়েছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে বেশ কিছু কঠোর পদক্ষেপ নেয় সরকার। পরীক্ষার আধা ঘণ্টা আগে প্রশ্নপত্রের মোড়ক খোলাসহ পরীক্ষার্থীদের আধা ঘণ্টা পূর্বে কেন্দ্রে প্রবেশ বাধ্যতামূলক করা হয়। সাত দিন আগে থেকে বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয় কোচিং ও গাইড সেন্টারগুলোকে। প্রয়োজনে ফেসবুক বন্ধের কথা বলা হলেও পরে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সরকার। তবে শেষ পর্যন্ত সকলই গড়ল ভেল! সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রশ্নফাঁসের ঘটনা ঘটছে অবলীলায়। অতঃপর সংশ্লিষ্টরা দিশেহারা হয়ে বলছেন, পরীক্ষা শুরুর আগে কেন্দ্র বা উপজেলা থেকে প্রশ্নপত্র নেয়ার দায়িত্বে থাকা কোন অসাধু শিক্ষক অথবা ব্যক্তি প্রশ্নের প্যাকেটের সিলগালা খুলে মোবাইল ফোন বা অন্য কোন প্রযুক্তির সাহায্যে তা পাচার করে দিচ্ছে বাইরে। এটিও অনুমানভিত্তিক। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে তার আগেই পাওয়া যাচ্ছে প্রশ্নপত্র। একেবারে উত্তরপত্রসহ! বাকি রইল পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোতে অনলাইনের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র পাঠানোসহ তাৎক্ষণিকভাবে প্রিন্ট করে পরীক্ষার্থীদের সরবরাহ। তাতেও অবশ্য হ্যাকিংয়ের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। অতঃপর প্রশ্নপত্র ফাঁস প্রতিরোধে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি প্রধানসহ জড়িতদের ধরিয়ে দিলে ৫ লাখ টাকা পুরস্কারের চিন্তা-ভাবনা চলছে বলে জানা যায়। তবে এতেও কাজ হবে বলে মনে হয় না। কেননা, নিকট অতীতে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে ধরপাকড়সহ যৎসামান্য শাস্তি হলেও উৎসস্থল তথা আসল ‘নাটের গুরুরা’ থেকে গেছেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। বরং যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তারা অনতিবিলম্বে জামিনে বেরিয়ে গেছেন আইনের ফাঁকফোকড়ে। প্রশাসনিক শাস্তিও প্রায় নেই বললেই চলে। আসলে শিক্ষাব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়ম-অব্যবস্থা। এনসিটিবি কর্তৃক পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন থেকে শুরু করে মুদ্রণ, সরবরাহ, নোট ও গাইড বইয়ের রমরমা ব্যবসা, কোচিং বাণিজ্য সর্বোপরি প্রতিবছর পরীক্ষা গ্রহণের নিমিত্ত প্রশ্নপত্র প্রণয়ন-ফাঁস-খাতা দেখা তথা মূল্যায়ন পর্যন্ত হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেন তথা ব্যবসা-বাণিজ্য হয়ে থাকে। রাজধানীসহ সারাদেশে এসব ঘিরে গড়ে উঠেছে সুবিশাল একটি স্বার্থান্বেষী চক্র তথা ব্যবসায়ী শ্রেণী। শিক্ষায় নীতি-নৈতিকতা ও মান বলতে কিছু আর অবশিষ্ট নেই। এই অবস্থায় প্রশ্নফাঁস ঠেকানো আকাশ কুসুম কল্পনা মাত্র!
×