ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

চার বছর ধরে বিমানের ৪ পরিচালক পদ শূন্য

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ৯ মার্চ ২০১৮

চার বছর ধরে বিমানের  ৪ পরিচালক পদ শূন্য

আজাদ সুলায়মান ॥ চার বছর ধরে পরিচালকের চারটি পদ শূন্য থাকলেও নির্বিকার বিমান। গুরুত্বপূর্ণ এসব পদের বিপরীতে যোগ্য লোক থাকা সত্ত্বেও ম্যানেজমেন্টের নোংরা রাজনীতি ও প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোভাবের দরুণ তাদের পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে না। একদিকে মেধাবী ও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের কোণ্ঠাসা করে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে একজনকে একাধিক দায়িত্ব দিয়ে এয়ারলাইন্সের সর্বনাশ ঘটিয়ে তুঘলকি কায়দায় চালানো হচ্ছে বিমান। চারজন পরিচালক না থাকায় বিমানের স্বাভাবিক কর্মকান্ড ব্যাহত হলেও কারোরই নেই মাথাব্যথা। বার বার লোক দেখানো ইন্টারভিউ নেয়া হয়, প্রার্থীরা সব শর্ত পূরণ করে মেধার জোরে টিকেও যান। তারপরও ঝুলিয়ে রাখা হয় তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া। কেন এ বিলম্ব জানতে চাইলে বিমানমন্ত্রী একেএম শাহজাহান কামাল বলেন, আমি নতুন এসেছি। এ বিষয়টি সচিব ভাল বলতে পারবেন। প্রধানমন্ত্রী আমাকে বলেছেন, আগে বিমানকে ভাল করে বুঝেন, দেখেন কোথায় কি পরিবর্তন আনতে হবে, তারপর যা করার করেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সচিব এসএম গোলাম ফারুক বলেন, চেয়ারম্যান ও বিমান ম্যানেজমেন্টকে বলুন। প্রশ্ন করা হলে চেয়ারম্যান এয়ারমার্শাল ইনামুল বারি বলেন, কাজ চলছে। সময় তো লাগবে। বিমানে তো অনেক কাজ আছে, শুধু ডিরেক্টর নিয়োগ করাই তো বোর্ডের কাজ নয়। তবে আমি বলছি- এগুলো সমস্যা মিটে যাবে। জানতে চাইলে এমডি ক্যাপ্টেন মোসাদ্দিক আহমেদ বলেন, বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে। হয়ে যাবে খুব শীঘ্রই। ইতোমধ্যে পরিকল্পনা বিভাগের পরিচালক চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্রকৌশল বিভাগের পরিচালক পদেও একজনকে রিমাইন্ড দেয়া হয়েছে। এখন আর বিলম্ব হবে না। এ মাসেই এসব সমস্যা ঠিক হয়ে যাবে। বিমানের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ পরিচালক প্রকৌশলের পদ শূন্য এক বছর ধরে। পরিকল্পনা বিভাগের পরিচালকও নেই চার বছর ধরে। একই অবস্থা কাস্টমার সার্ভিসে। এ তিনটা বিভাগের পরিচালক পদে লোক দেখানো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে স্বাক্ষাতকার নেয়া হলেও ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। যারা এসব পদে যোগ্য-অভিজ্ঞ, তাদের দূরে সরিয়ে রেখে বাহির থেকে অযোগ্য আনাড়ি লোক নিয়োগের পাঁয়তারা চালাচ্ছে বিমান। এহেন কান্ডকীর্তিতে ক্ষোভে ফুঁসে ওঠছে বিমান। বিমানের ভেতর ও বাহিরের অদৃশ্য শক্তির দাপটে এসব পদে নিয়োগ দেয়া যাচ্ছে না। যে কারণে বিমানের গতিশীল সেবা দূরে থাক অচল হয়ে পড়েছে এসব বিভাগের কর্মকান্ড। এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিমান পর্ষদ ও ম্যানেজমেন্টের শীর্ষ কর্তাদের ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের দরুণ এসব পদে যোগ্য লোক থাকা সত্ত্বেও নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না। ওদের আচরণ ও নীতি দেখে মনে হচ্ছে- বিমান ওদের পৈত্রিক সম্পত্তি। এ অবস্থা মেনে নেয়ার মতো নয়। বিমানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ প্রকৌশল। সার্বক্ষণিক উড়োজাহাজের রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয় এখানকার পেশাদার ও অভিজ্ঞ প্রকৌশলীদের। গত মার্চ মাসে পরিচালক উইং কমান্ডার আসাদুজ্জামানের মেয়াদ আর না বাড়ানোর দরুণ তাকে চলে যেতে হয়। তারপর থেকে শূন্য রয়েছে এ পদটি। অদ্যাবধি সেটা পূরণ করা হচ্ছে না। যদিও আসাদ চলে যাওয়ার দীর্ঘদিন পর এ পদটি পূরণের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হলেও আজও সেটা সম্পন্ন করতে পারেনি বিমান। এ পদে একজন পরিচালক না থাকায় বড় ধরনের সমস্যার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে বিমান। একের পর এক উড়োজাহাজ যান্ত্রিক ত্রুটির শিকার হচ্ছে। সঠিক সময়ে মিলিয়ন ডলারের ব্র্যান্ড নিউ উড়োজাহাজগুলোর সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ করা যাচ্ছে না। যিনি ভারপ্রাপ্ত আছেন- তিনি দায়িত্ব নিয়ে কোন কাজই করতে পারছেন না। উপযুক্ত মেধা ও পেশাদারিত্ব না থাকায় তার পক্ষে ন্যূনতম দায়িত্ব পালনও সম্ভব হচ্ছে না। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদের পরিচালক এক বছর ধরে শূন্য পড়ে থাকলেও বিমান নির্বিকার। এক বছরেও এ পদে লোক নিয়োগ দেয়ার মতো দক্ষতা দেখাতে পারেনি বর্তমান পর্ষদ। কেন বিমানের এহেন ব্যর্থতা জানতে চাইলে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ আশীষ রায় চৌধুরি জনকণ্ঠকে বলেন, বিমানের বর্তমান বোর্ড ও ম্যানেজমেন্ট কতটা অথর্ব ও অদক্ষ এটাই তার বড় প্রমাণ। এমন একটা পদ পূরণ করতে পারেনি এক বছরেও। বর্তমান পর্ষদে একজন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ বা পেশাদার সদস্য নেই। তারা ১৬ কোটি মানুষের দেশে কি একজন দক্ষ পরিচালককেও খুঁজে বের করতে পারেননি। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। এ ধরনের পদ সাধারণত শূন্য হওয়ার তিন মাস আগে থেকেই যোগ্য লোকের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে দায়িত্ব দিয়ে দেয়া হয়। এটা কর্পোরেট কালচার হলেও বিমানের কেউ তা অনুধাবন করতে পারেনি। একই অবস্থা পরিচালক কাস্টমার সার্ভিসের। এখানে দীর্ঘদিন ধরে একজন অভিজ্ঞ জিএম আতিক সোবহানকে দিয়ে পরিচালকের ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব পালন করানো হচ্ছিল। হঠাৎ করে তাকে এখান থেকে অজ্ঞাত কারণে সরিয়ে অন্য একজনকে পরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়। বিমানে যোগ্য লোক থাকা সত্ত্বেও তাদের পদোন্নতি না দিয়ে উল্টো একজনকে দুই দায়িত্ব দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। এতে বিমান ম্যানেজমেন্টের বিরুদ্ধে ফুসে ওঠে সাধারণ কর্মচারীরা। এক পর্যায়ে বিমান কাস্টমার সার্ভিস বিভাগের পরিচালক পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়। তখন এ পদে দীর্ঘদিন ভারপ্রাপ্ত পরিচালকের দায়িত্ব পালনকারী আতিক সোবহানসহ ৮ জন আবেদন করেন। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় আতিক সোবহান ভাল করার পর রহস্যজহনক কারণে তার ফলাফল প্রকাশ করেনি বিমান। উল্টো একজন বহিরাগতকে নিয়োগ দেয়ার পাঁয়তারা চালায় বিমান। সেটা সম্ভব হয়নি ওই প্রার্থীর সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স না থাকায়। দীর্ঘদিন বিমানের পরিচালক প্রশাসনের পদও শূন্য রাখা হয়। এ পদ নিয়েও চলে নোংরা রাজনীতি। মমিনুল ইসলামকে এ পদে পদোন্নতি দেয়ার ক’দিন পরই বিমান অন্য মন্ত্রণালয় থেকে একজনকে এ পদে প্রেষণে আনার উদ্যোগ নেয়। পরিচালক প্রশাসন পদে মমিনুল ইসলামন থাকার পরও জয়নাল বারি নামের একজনকে মন্ত্রণালয় থেকে প্রেষণে নিয়োগ দেয়াও হয়েছিল। পরে মমিনের পক্ষে আদালতে রিট করা হলে জয়নাল বারিকে ফেরত যেতে হয়। তারপর থেকে শুরু হয় অন্য খেলা। এখন আবার মমিনকে সরিয়ে আরেকজনকে দায়িত্ব দেয়ার পাঁয়তারা চালানো হচ্ছে। এতে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে সাধারণ বিমান কর্মীদের মাঝে। পরিচালক পরিকল্পনা ও স্টোর বিভাগেরও দুুটো পদ শূন্য রাখা হয়েছে চার বছর ধরে। এখানে যোগ্য লোক থাকা সত্ত্বেও বিমান রহস্যজনক কারণে এটা পূরণ করছে না। এ পদে লিখিত ও মৌখক পরীক্ষা দিয়ে ভাল ফলাফল করার পরও নিয়োগ দেয়া হয়নি সিনিয়র জিএম খান মোশাররফকে। উল্টো এ পদে যাতে যোগ দিতে না পারে সেজন্য তাকে কোণ্ঠাসা করে, তাকে প্রেসের মতো কম গুরুত্ব পূর্ণ পদে ডাম্পিং করা হয়েছে। অথচ এ পদে তিনি যোগ্য কর্তা বলে বিবেচিত হলেও বিমান তাকে বঞ্চিত করছে। বিমানে এ ধরনের অরাজকতা চললেও দেখার কেউ নেই। বিমান গতকাল জানিয়েছে, এ পদে একজন বহিরাগতকে বসানোর জন্য সব চূড়ান্ত করা হয়েছে। যদিও বিমানের এ উদ্যোগ আবারও আইনী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। বিমানের নিজস্ব যোগ্য প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও বহিরাগতকে নিয়োগ দেয়া হলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত ও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অপর এক পরিচালক। এর আগে পরিচালক প্রশাসন পদে লোক থাকা সত্ত্বে বহিরাগত নেয়ার আদেশ বের করার পরও যোগ দিতে পাারেননি জয়নাল বারী নামের মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা। বিমান সূত্র জানায়, এসব শূন্য পদ পূরণে মাঝে মাঝে মন্ত্রণালয় থেকে উদ্যোগ নেয়া হলেও বিমানের ভেতর ঘাঁপটি মেরে থাকা একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট তা নৎসাত করে দিচ্ছে। এই চক্রটি বিমান ধ্বংস হয়ে গেলেও এ সব পদ শূন্য রাখার নীতি অবলম্বন করছে। যোগ্যরা এসব পদে আসীন হলে অথর্ব-অযোগ্য কর্তাদের ক্যারিয়ার হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান এক পরিচালক। এ জন্যই বছরের পর বছর ধরে নানা অজুহাতে এসব পদ শূন্য রাখার কৌশল নিয়েছে তারা।
×