ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শহীদ জননীর পাশে শায়িত হলেন

শ্রদ্ধা ভালবাসায় প্রিয়ভাষিণীর চিরবিদায়

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ৯ মার্চ ২০১৮

 শ্রদ্ধা ভালবাসায় প্রিয়ভাষিণীর চিরবিদায়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ তিনি ভালবেসেছিলেন এই দেশের নিসর্গ, মাটি ও মানুষকে। নির্যাতনের ক্ষত থেকে সঞ্চয় করেছিলেন শক্তি। সেই শক্তির প্রতিবাদী প্রকাশে সমরযুদ্ধ না করেও অবতীর্ণ হয়েছিলেন যোদ্ধার ভূমিকায়। নিজেকে পরিণত করেছিলেন নির্যাতিত নারীর কণ্ঠস্বরে। তারই কল্যাণে একাত্তরের নির্যাতিত নারীরা পেয়েছেন বীরাঙ্গনা থেকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। তাই তো বিদায়যাত্রায় পেলেন দেশের প্রতি ভালবাসার সেই প্রতিদান। অদেখার ভুবনে পাড়ি দেয়া মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীকে শ্রদ্ধা জানাল সমগ্র জাতি। বসন্তের ফুলে ফলে ছেয়ে গেলা লাল-সবুজের পতাকায় আবৃত শিল্পীর কফিন। বৃহস্পতিবার বিকেলে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে শহীদজননী জাহানারা ইমামের কবরের পাশে সমাহিত করা হলো এই বীরমাতাকে। চিরবিদায়ের আগে বরেণ্য এই ভাস্করের সঙ্গী হলো অগণন মানুষের শ্রদ্ধা আর অশ্রুভেজা ভালবাসা। মুক্তিযুদ্ধের কণ্ঠস্বর হিসেবে পরিচিত শিল্পীকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন ছাত্র, শিক্ষক, লেখক, কণ্ঠশিল্পী, চিত্রশিল্পী, অভিনয়শিল্পী থেকে সর্বসাধারণ। সেই তালিকা থেকে বাদ যায়নি তাঁরই মতো একাত্তরের নির্মমতার স্বীকার বীরাঙ্গনা থেকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়া নারী। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন সহযোদ্ধা, স্বজন আর অনুরাগীরা। সেই শ্রদ্ধা পর্বে বিশিষ্টজনরা স্মরণ করেছেন তাঁর সংগ্রামী জীবনের কথা। যে জীবনে তিনি আদায় করেছেন বীরাঙ্গনা থেকে মুক্তিসেনার স্বীকৃতি। শ্রদ্ধাঞ্জলি শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়েছে তার দ্বিতীয় দফা জানাজা। মঙ্গলবার রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ হয় ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর লড়াকু জীবনের পরিভ্রমণ। সেদিনই বাদ এশা তার বারিধারা পিংক সিটির বাসভবনের সামনে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম জানাজা। এরপর তার লাশ রাখা হয় ল্যাবএইড হাসপাতালের হিমঘরে। সেখান থেকে বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা ৫ মিনিটে তার মরদেহ নিয়ে আসা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। প্রকৃতি কন্যা নামে খ্যাত ভাস্করের নিথর দেহখানি রাখা হয় হয় বেদির উল্টোপাশের গগনশিরীষ বৃক্ষতলে। সেখানে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের তত্ত্বাবধানে শ্রদ্ধাঞ্জলির শুরুতেই ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রদান করা হয় রাষ্ট্রীয় সম্মান গার্ড অব অনার। এতে নেতৃত্ব দেন জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার তাজওয়ার আকরাম সাকাপি ইবনে সাজ্জাদ। প্রিয়ভাষিণীকে শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে ভিড় জমিয়েছিলেন নানা শ্রেণীর-পেশার মানুষ। সারিবদ্ধ হয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে জানিয়েছেন শ্রদ্ধাবনত ভালবাসা। অনেকের চোখের কোল গড়িয়ে ঝরেছে অশ্রুধারা। কেউ বা মৌনতার মাঝেই প্রকাশ করেছেন শোকমাখা শ্রদ্ধাঞ্জলি। শ্রদ্ধা নিবেদনের এ পর্বে খোলা হয়েছিল শোকবই। সেখানে কালো অক্ষরে বিবৃত হয়েছে প্রিয়ভাষিণীর বিদায়যাত্রায় লেখা বেদনার্ত অনুভূতি। প্রতিটি লেখায় ছিল নারীর প্রতিনিধিত্বকারী এক যোদ্ধাকে হারানোর আকুতি। শ্রদ্ধাঞ্জলি পর্বে প্রিয়ভাষিণীর শবদেহের পেছনে বিষণœ বদনে নীরবে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর ছেলে কারু তিতাস, মেয়ে ফুলেশ্বরী নন্দিনীসহ পরিবারের সদস্যরা। জাতীয় সংসদের পক্ষে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর প্রতি শ্রদ্ধা জানান স্পীকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। আওয়ামী লীগের পক্ষে সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, তথ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু শ্রদ্ধা জানায়। এছাড়াও সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শ্রদ্ধা জানায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ওয়ার্কার্স পার্টি, মহিলা পরিষদ, কর্মজীবী নারী, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, নৌ পুলিশ, ছাত্রমৈত্রী, গণজাগরণ মঞ্চ, স্বাস্থ্য অধিদফতর, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, গণসঙ্গীত শিল্পী সমন্বয় পরিষদ, ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, জাতীয় কবিতা পরিষদ, সঙ্গীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ, ঢাকা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ, প্রজন্ম ’৭১, ছায়ানট, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালসহ বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান। ব্যক্তিগতভাবে প্রিয়ভাষিণীর প্রতি শ্রদ্ধা জানান ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী, নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, চিত্রশিল্পী আবুল বারক্্ আলভী ও মনিরুল ইসলাম, ডাঃ সারওয়ার আলী, প্রাবন্ধিক মফিদুল হক, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমত আরা সাদেক, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, শাহরিয়ার কবির, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক, ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ, গণসঙ্গীত শিল্পী ফকির আলমগীর, শহীদকন্যা নুজহাত চৌধুরী, কণ্ঠশিল্পী শুভ্রদেব, ডাঃ জাফরউল্লাহ চৌধুরী, কবি কামাল চৌধুরী, নাট্যজন ম হামিদসহ অনেকে। শ্রদ্ধাঞ্জলি শেষে পরিবারের পক্ষে প্রিয়ভাষিণীর মেয়ে ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী বলেন, গত চার মাস ধরে মা ঘরের বাইরে যেতে পারেননি। এই ফাল্গুন তার দেখা হয়নি। আজ এত ফুলে ফুলে মাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আপনারা তাকে সেই ফাল্গুন উপহার দিলেন। মা তার শেষ ঠিকানা পেয়েছেন, মা ঘুমাবেন শহীদজননী জাহানারা ইমামের পাশে। এজন্য আমরা গর্বিত। শিরীন শারমীন চৌধুরী বলেন, নারী আন্দোলনের সকল পর্যায়ে তিনি সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার এ কণ্ঠস্বর কখনও পিছপা হননি। তিনি বীরাঙ্গনাদের স্বীকৃতির জন্য যে লড়াই করেছেন, সরকার তার পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটাবে। ওবায়দুল কাদের বলেন, নির্যাতিত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার যে ত্যাগ-তিতিক্ষা, তা নতুন প্রজন্মের কাছে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তার ভাস্কর্য শিল্পচর্চায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে, শিল্প পেয়েছে এক নতুন মাত্রা। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, সাহস থাকলে যেসব বাধা অতিক্রম করা যায়, তার উদাহরণ ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। তার ওপর বারবার আঘাত এসেছে, কিন্তু তিনি বারবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তিনি জীবনভর লড়াই করে গেছেন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী একইসঙ্গে সাহস ও সম্ভ্রমের প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ছড়িয়ে দেয়ার জন্য তার অবদান অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। সংস্কৃতিচর্চায় তার ভাস্কর্য এক নতুন সংযোজন। নতুন প্রজন্ম তার সম্পর্কে ভালভাবে জানলে, দেশকে আরও ভালভাবে জানতে পারবে বলে মত দেন এই শিক্ষাবিদ। কামাল লোহানী বলেন, তিনি ছিলেন সাহসী নারীর প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতনের কথা লুকিয়ে না রেখে লোকসমাজে তা প্রকাশ করেছেন। নির্যাতিত নারীর পক্ষে দাঁড়িয়ে তিনি অনন্য সাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন। তার অনন্য অবদানের কথা ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ থাকবে। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর শিল্পী ও সংগ্রামী জীবনের মূল্যায়ন করে চিত্রশিল্পী মনিরুল ইসলাম বলেন, দেশের ভাস্কর্যশিল্পে নিজস্বতার স্বাক্ষর রেখেছেন প্রিয়ভাষিণী। শিল্পীসৃজনে তিনি পাঠ নিয়েছেন প্রকৃতি থেকে। কোন প্রতিষ্ঠানের বদলে শিখেছেন প্রকৃতির কাছ থেকে। প্রকৃতির নানা অনুষঙ্গ দিয়ে গড়েছেন বার্তাবহ অসাধারণ সব শিল্প। আচরণে ছিলেন খুবই নরম মনের একজন মানুষ। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধে চেতনার বাংলাদেশ গড়ার বিষয়ে ছিলেন দারুণ সোচ্চার। রামেন্দু মজুমদার বলেন, তিনি শিল্পী হিসেবে অনেক বড়, তবে তার সামাজিক গুরুত্ব আরও বেশি। তিনি একাত্তরের নির্যাতিত নারীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, প্রেরণা জুগিয়েছেন। সে সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে তিনি সবসময় সোচ্চার হয়েছেন। মফিদুল হক বলেন, তার কপালের বড় টিপ আমার কাছে ‘জয়ন্তিকা’। তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন। ফেলে দেয়া কাঠ থেকে যে ভাস্কর্য তৈরি করেছেন, তাতে উঠে এসেছে জীবনের কথা। প্রিয়ভাষিণীকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন বীরাঙ্গনা থেকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সিরাজগঞ্জের রাহেলা বেওয়া। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন অনেক ব্যথা-বেদনা আর কষ্টে কেটেছে এই জীবন। প্রিয়ভাষিণীর প্রচেষ্টাতেই আজ পেয়েছি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। এখন সরকারীভাবে প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে ভাতা পাচ্ছি। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর কারণেই এই জীবনটা সহজ হয়েছে। আমাকে তিনি ভীষণ ভালবাসতেন। শেষ তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল ডিসেম্বর মাসে। সেই সময়ের জীবিত মানুষটিকে মার্চ মাসে যখন আবার দেখলাম, তখন তিনি চলে গেলেন জীবনের বাইরে। নাগরিক স্মরণসভা : সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ জানিয়েছেন, আগামী ১৩ মার্চ বিকেল সাড়ে ৪টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর নাগরিক স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হবে।
×