ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিয়ের জন্য তাড়াহুড়ো না করে কন্যা সন্তানকে উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে স্বাবলম্বী করে তোলার আহ্বান নারীর উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় বিশেষ অবদানের জন্য ৫ জয়িতার হাতে সম্মাননা পদক হস্তান্তর

নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে ॥ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ৯ মার্চ ২০১৮

নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে ॥  আন্তর্জাতিক নারী  দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিয়ের জন্য তাড়াহুড়ো না করে কন্যা সন্তানকে উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে স্বাবলম্বী করে তুলতে সহায়তা করতে অভিভাবকদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন নারীর জন্য অত্যন্ত জরুরী। নারীদের আত্মবিশ্বাস এবং মর্যাদা নিয়ে চলে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে হবে। আর বিয়ে দিলেই মেয়ের ওপর থেকে দায়িত্ব চলে যায় না। বরং দায়িত্ব আরও বাড়ে। মেয়েকে যদি লেখাপড়া শিখিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে; সেটাই সমাজের জন্য সব থেকে ভাল, পরিবারের জন্যও সেটা একটা সুরক্ষা সৃষ্টি করতে পারে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, নারীদের আত্মবিশ্বাস ও মর্যাদা নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। সমাজে যদি নারী পেছনে পড়ে থাকে; তাহলে এই সমাজ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। নারীদের অধিকার সুরক্ষিত করে তাদের অধিকার সৃষ্টি করে দেয়া এবং সর্বক্ষেত্রে তাদের বিচরণ যেন নিশ্চিত হয়; সেটাই আমাদের লক্ষ্য। আর সেই কাজটাই করে আমরা অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছি। নিজের পায়ে দাঁড়াতে মেয়েদেরও উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মেয়েদের বসে থাকলে চলবে না, নিজেদেরও কাজ করতে হবে, লেখাপড়া শিখতে হবে এবং নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে হবে। নারীর অধিকার সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর দর্শন তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমরা নারীর অধিকার নারীর অধিকার নিয়ে যতই স্লোগান দেই, যতই বক্তব্য দেই অধিকার তো আর হেঁটে আসবে না।’ তিনি বলেন, জাতির পিতা বলতেন- ‘একটা মেয়ে যদি নিজে অর্থ উপার্জন করতে পারে এবং তার হাতে যদি কিছু টাকা থাকে বা আঁচলে যদি কামাই করে ১০ টাকা বেঁধে নিয়ে আসতে পারেন তাহলে সমাজে-সংসারে এমনিতেই তার অবস্থানটা হবে। কেউ অবহেলা করতে পারবে না।’ মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক এবং বাংলাদেশে জাতিসংঘের প্রতিনিধি মিয়া সেপো এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসিমা বেগম। অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সদস্যগণ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, সংসদ সদস্যগণ, সরকারের পদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিক, আমন্ত্রিত অতিথি, নারী উদ্যোক্তা এবং বিভিন্ন নারী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রীকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন মেহের আফরোজ চুমকি। অনুষ্ঠানে নারীর উন্নয়ন-অগ্রযাত্রায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ প্রধানমন্ত্রী ৫ জন জয়িতার হাতে সম্মাননা পদক তুলে দেন। পদকপ্রাপ্তরা হচ্ছেন- অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনে ঢাকা বিভাগের দৃষ্টি, শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করায় খুলনা বিভাগের মোসাম্মাৎ নাছিমা খাতুন, সফল জননী ক্যাটাগরিতে চট্টগ্রাম বিভাগের পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির হলা ক্রা প্রু মারমা, নির্যাতনের বিভীষিকা পেছনে ফেলে নতুনভাবে জীবন শুরু করায় ঢাকা বিভাগের ফিরোজা খাতুন এবং সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখায় রাজশাহী বিভাগের আমেনা বেগম। প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, মেয়েদের যে মেধা আছে সেটা আমাদের কাজে লাগাতে হবে এবং একটা সমাজকে যদি গড়তে হয় যে সমাজে প্রায় অর্ধেকই নারী সেই অর্ধেক বাদ রেখে একটা সমাজ উন্নত হতে পারে না। সমাজকে উন্নয়ন করতে হলে নারী পুরুষ সবাইকেই সমানভাবে সুযোগ করে দিতে হবে। নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করতে হবে এবং কর্মক্ষেত্রেই তাদের যে শক্তি ও মেধা সেটা যেন কাজে লাগে তার ব্যবস্থাও করতে হবে। এই সময় প্রধানমন্ত্রী জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার পঙ্ক্তি ‘বিশ্বে যা কিছু সুন্দর চিরকল্যাণকর/ অর্ধেক তাঁর আনিয়াছে নারী অর্ধেক তাঁর নর,’- উল্লেখ করে বলেন, নারীদের যদি আমরা সুযোগ করে না দেই তাহলে সেটা হবে না। এজন্য তাঁর সরকার ’৯৬ সালে সরকার গঠনের পর ইউনিয়ন পরিষদে নারীদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা বরাদ্দ করেন যাতে তৃণমূল থেকেই নেতৃত্বটা উঠে আসে। তিনি বলেন, একটা সমাজে নারী-পুরুষ সকলে মিলে কাজ করতে পারলেই একটা দেশ এগিয়ে যাবে। আর যে লক্ষ্য আমরা স্থির করেছি, জাতির পিতা আমাদের যে স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন তার সুফল প্রত্যেক ঘরে পৌঁছাতে হবে। আমাদের ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া শিখে বড় হবে এবং বিশ্বে মর্যাদা নিয়ে চলবে তারা যেন সমানভাবে চলতে পারে সেভাবেই তাদের আমরা গড়ে তুলতে চাই। সরকারপ্রধান আরও বলেন, সমাজে যদি নারী পেছনে পড়ে থাকে তাহলে সেই সমাজ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। সেজন্যই নারীদের অধিকার সুরক্ষিত করে তাঁদের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া, কর্মক্ষেত্রসহ সর্বক্ষেত্রেই তাঁদের বিচরণ যাতে নিশ্চিত হয় সেটাই আমাদের লক্ষ্য আর সে কাজটাই আমরা করে অনেক দূর এগিয়ে গেছি। তিনি বলেন, অনেক উন্নত দেশে যা পারে না, বাংলাদেশের মেয়েরা তা পারে সেটাও আমরা প্রমাণ করে দিয়েছি। কাজেই এটাই চাই আপনারা আমাদের বোনেরা একটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে আত্মমর্যাদা নিয়ে চলবেন। তারপরেও পরিবারের প্রতি যে দায়িত্ব সেটাও যথাযথভাবে পালন করবেন। কারণ কথাইতো আছে সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে, একথাটাও যেন আমরা ভুলে না যাই। তাঁর সরকার দেশে বাল্যবিবাহ বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে একটা সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করা একান্তভাবে প্রয়োজন, যেটা তাঁর সরকার করে যাচ্ছে। তিনি যেখানেই যান সেখানেই এ ব্যাপারে প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করছেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের নারীদের জন্য দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক লেখাপড়া করার ব্যবস্থা, বৃত্তি-উপবৃত্তির শতকরা ৭৫ ভাগ নারীদের জন্য প্রদান এবং নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টিসহ তাঁদের জন্য কর্মসংস্থানের পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী অভিভাবকদের উদ্দেশে করে বলেন, বাবা-মা বৃদ্ধ হয়ে গেলে ছেলের বউ যত না দেখে তার চেয়ে মেয়েরা বেশি দেখে এটাও তাদের মনে রাখা উচিত। এটিই বাস্তবতা। মেয়েরাইতো ছেলের বউ হয় সেটাওতো ঠিক। তাই বাবা-মা শ্বশুর-শাশুড়ি সকলের প্রতিই নারীদের সমানভাবে দায়িত্ব পালন করা উচিত। বাবা-মা শ্বশুর-শাশুড়ির প্রতিও মেয়েরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করবে সেই প্রত্যাশাও ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের নারীরা এখন পিছিয়ে নেই। যে বাধা আমাদের নারীদের ছিল সে বাধা অতিক্রম করে তারা এখন এগিয়ে যাচ্ছে। এয়ারফোর্সে মেয়েরা যুদ্ধ বিমান চালনা শুরু করে দিয়েছে, বিমানে তো মহিলা পাইলট আছেই, রেলেও নারী ড্রাইভার রয়েছে, গাড়িচালক রয়েছে, অন্যান্য বাহিনী এবং বিজিবিতেও তারা রয়েছে, জাতীয় সংসদে ৫০টি সংরক্ষিত আসন ছাড়াও ২২ জন সরাসরি নির্বাচিত নারী সদস্য রয়েছেন এবং সংসদ নেতা, উপনেতা, বিরোধী দলীয় নেতা এবং স্পীকারও একজন নারী। তিনি বলেন, বিচার বিভাগে নারী বিচারপতি, প্রশাসনের শীর্ষ পদে ১০ জন নারী সচিব, পুলিশ বাহিনী, র‌্যাব, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনী, প্রশাসনের শীর্ষ পদে ১০ জন নারী সচিব এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদেও নারীরা দায়িত্ব পালন করছেন। আমাদের মেয়েরা এএফসি অনুর্ধ-১৪ ফুটবলে আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। সাফ অনুর্ধ-১৫ নারী চ্যাম্পিয়নশীপের প্রথম আসরে ভারতের বিপক্ষে বিজয়ী হয় বাংলাদেশ অনুর্ধ-১৫ মহিলা ফুটবল দল। জাতীয় নারী ক্রিকেট দল ২০২০ সালে অনুষ্ঠেয় টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলবে। আমাদের নারীরা এভারেস্ট শৃঙ্গও জয় করেছে। সকল জায়গায় মেয়েরা তাঁদের স্থান করে নিয়েছে এবং একটু সাহসের সঙ্গে এগিয়ে গেলেই এই স্থানটা করে নেয়া যায়। মেয়েরা যে পারে সেটা সর্বত্রই আজ প্রতিষ্ঠিত এমন অভিমত ব্যক্ত করে মেয়েদের কাজের প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মেয়েরা যখন কাজ করে আমি মনে করি খুব ভালভাবেই করে। তাদের কাজের দক্ষতা অনেক বেশি তাতে কোন সন্দেহ নেই। প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যের শুরুতে নারী জাগরণের পথিকৃত বেগম রোকেয়াকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে অন্তঃপুরবাসিনী মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিবের জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বাংলার মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং বীরাঙ্গনা নারীদের পুনর্বাসনে তাঁর গৌরবদীপ্ত ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন। নারীদের পুনর্বাসন ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে জাতির পিতা ‘নারী পুনর্বাসন বোর্ড’ গঠন করেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা সংবিধানের ১৯ ও ২৮ অনুচ্ছেদে জাতীয় জীবনের সকলক্ষেত্রে নারীর সমানাধিকার নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য জাতির পিতার পাশাপাশি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিবও ছিলেন সচেষ্ট। মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের তাঁদের পরিবার ফিরিয়ে নিতে চায়নি। আমার মা নিজের গয়না দিয়ে তাদের অনেকের বিয়ে দিয়েছিলেন। এসব নারীদের অনেকেরই বিয়ের বেলায় বাবার নাম লেখা হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমান, ঠিকানা ধানম-ি ৩২ নম্বর। প্রধানমন্ত্রী এ সময় ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় কর্মপরিকল্পনা-২০১৩ গ্রহণ, মাতৃত্বকালীন ছুটি ৪ মাসের পরিবর্তে স্ব-বেতনে ৬ মাসে বর্ধিতকরণ এবং সন্তানের পরিচয়ের ক্ষেত্রে বাবার নামের পাশাপাশি সর্বত্রই মায়ের নাম বাধ্যতামূলক করাসহ তাঁর সরকারের নারী উন্নয়নে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরেন।
×