ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

পাটের অমিত সম্ভাবনা

প্রকাশিত: ০৫:২০, ৮ মার্চ ২০১৮

পাটের অমিত সম্ভাবনা

পাট দিবস তথা সাড়ম্বরে পাট পণ্য মেলাকে উপলক্ষ করে বঙ্গীয় গৌরব বলে পরিচিত এক সময়ের সোনালি আঁশ আবারও উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের আলোচনায়। বাংলাদেশে যখন কৃষক পাটের ন্যায্য দাম প্রাপ্তি নিয়ে দিশেহারা, তখন বিশ্ব বাজারে প্রতি টন পাটের দাম বেড়েছে ১০ থেকে ২৫ ডলার পর্যন্ত। এর অবশ্য কারণও আছে। বিশ্বের বৃহৎ পাঁচটি মোটরগাড়ি উৎপাদক কোম্পানি তাদের বিলাসবহুল গাড়ির অভ্যন্তরীণ কাঠামো ও সাজসজ্জার বড় একটি অংশ হিসেবে ব্যবহার করছে পাটজাত পণ্য, যা টেকসই দৃষ্টিনন্দন ও আরামদায়ক। বিশ্বে পাটের বাজার পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা ন্যাচারাল ফাইবার ওয়ার্ল্ডের এক প্রতিবেদনে পাওয়া গেছে এই তথ্য। এর পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ঘোষণা দিয়েছে যে, ২০১৯ সালের মধ্যে সদস্যভুক্ত সব দেশ পণ্যের মোড়কসহ বহনের জন্য সব ব্যাগ প্লাস্টিক ও কৃত্রিম আঁশজাত উপজাত দ্রব্যের ব্যবহার বন্ধ করবে। এর পাশাপাশি গত কয়েক বছর ধরে পাটের সোলা বা পাট কাঠি থেকে আহর্যকৃত কয়লা তথা ছাই রফতানি হচ্ছে বিদেশে এবং ব্যবহৃত হচ্ছে ফটোকপি মেশিনের কালি তৈরিতে। এর ফলে বিশ্ব বাজারে পাট ও পাটজাত পণ্যের রফতানিতে দেখা যাচ্ছে উর্ধগতি, যা বাংলাদেশের জন্য আশাব্যঞ্জক নিঃসন্দেহে। অথচ দুঃখজনক হলেও সরকারী পাটকলগুলোর পুরনো যন্ত্রপাতিসহ কম উৎপাদন ক্ষমতা ও অতিরিক্ত শ্রমমজুরির কারণে (বকেয়াসহ) বিজিএমসি প্রতিবছর লোকসান দিচ্ছে ৬০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকা। তবে সুখবর দিয়েছেন বাংলাদেশ জুট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। তারা পাটের জন্মরহস্যের (জেনম) তথ্য দিয়ে উদ্ভাবন করেছেন নতুন জাতের পাটবীজ, যা থেকে প্রায় তুলার সুতার মতো স্বচ্ছ আঁশ উৎপাদন করা সম্ভব হবে অচিরেই। এই সুতা দিয়ে উন্নতমানের কাপড় উৎপাদন করা সম্ভব। উৎপাদনও ভাল, প্রতি হেক্টরে তিন টনের বেশি। তদুপরি আবাদের এক শ’ দিনের মধ্যে আঁশ আহরণ সম্ভব হবে পাট থেকে। অতঃপর পাটের এই অতি সম্ভাবনাকে বহুমুখী ও সর্বতোভাবে কাজে লাগাতে হবে সরকার, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ, পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী দলসহ মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের। আর তা হলেই কেবল ফিরে আসতে পারে একদা বাংলা থেকে প্রায় হারিয়ে যাওয়া স্বর্ণালী গৌরব। ধানের পরই বাংলাদেশের অন্যতম অর্থকরী কৃষিপণ্য পাট। পাটের জেনোম তথা বংশগতির মানচিত্র উদ্ভাবন করে বাংলাদেশের কৃষিবিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম ও তার দল তাক লাগিয়ে দিয়েছেন সারা বিশ্বে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ পাটের মেধাস্বত্ব তথা প্যাটেন্ট রাইট সুরক্ষার জন্য আবেদনও করেছে আন্তর্জাতিক সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে। এই আবিষ্কার ও স্বত্বাধিকারের ফলে বাংলাদেশ উফশী ও উন্নত জাতের পাট উৎপাদনের পাশাপাশি অতি সূক্ষ্ম পাটতন্তু তৈরি করে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় একচ্ছত্র প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম হতে পারে। তবে এর জন্য চাই পাট নিয়ে আরও উচ্চ ও উন্নততর নিরন্তর গবেষণা এবং এর সঠিক ব্যবহার। এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে কর্মরত বিজ্ঞানীদের জন্য চাই আরও প্রণোদনা ও অনুপ্রেরণা। এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানসম্মত গবেষণাগারের বিষয়টি অস্বীকার করা যায় না। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, বাংলাদেশে বিজ্ঞান গবেষণার সুযোগ সীমিত এবং আর্থিক বরাদ্দও সীমাবদ্ধ। ফলে বাংলাদেশের প্রতিভাবান ও মেধাবী বিজ্ঞানীরা প্রায়ই উন্নত বেতন ও গবেষণার আকর্ষণে বাইরে চলে যান। তদুপরি গবেষণাগারে যেসব বিজ্ঞানী দিনরাত কাজ করেন, তাদের সৃজনশীল কাজটি ১০টা-৫টা নিয়মিত অফিসের মতো হলে চলে না। বরং নতুন কিছু একটা আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত এটা নিয়েই ভাবিত থাকতে হয়। নিজের এবং সংসারের দিকেও মন দিলে চলে না তাদের। সেক্ষেত্রে ধান-পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের মতো সৃজনশীল গবেষণাগারে যারা কাজ করেন, তাদের বেতন-ভাতা সুযোগ-সুবিধা-প্রণোদনা নিয়ে আলাদাভাবে ভাবতে হবে সরকার তথা অর্থ মন্ত্রণালয়কে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানের বিজ্ঞান গবেষণাগার স্থাপনে বাড়াতে হবে আর্থিক বরাদ্দ। আর তাহলেই বিজ্ঞান গবেষণায় ইচ্ছুক মেধাবী ও প্রতিভাবানদের আকৃষ্ট করা সম্ভব হবে। সরকার এদিকে সবিশেষ মনোনিবেশ করবে বলেই প্রত্যাশা।
×