ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অর্থনীতিতে নারীর অবদান বাড়ছে

প্রকাশিত: ০৫:১০, ৮ মার্চ ২০১৮

অর্থনীতিতে নারীর  অবদান বাড়ছে

এম শাহজাহান ॥ ‘এ বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল, নারী দিলো তারে রূপ-রস-মধু গন্ধ সুনির্মল।’ সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতেও নারীর অবদান বাড়ছে। বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে কর্মসংস্থানে নারীদের মজুরি বৈষম্য কমে আসতে শুরু করেছে। এখন অনেক প্রতিষ্ঠানেই পুরুষের সমান মজুরি পাচ্ছেন নারীরা। বর্তমানে দেশে এক কোটি ৬২ লাখ নারী কর্মক্ষেত্রে রয়েছেন। বিদেশে কর্মসংস্থানে বাংলাদেশের নারীদের সংখ্যা গত এক দশকে ১০ গুণ বেড়েছে। নারী উন্নয়নের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় জেন্ডার বাজেটে বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। জানা গেছে, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাজেটে নারী উন্নয়নে ১ লাখ ১২ হাজার ১৯ কোটি টাকার জেন্ডার বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ৪৩টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের জন্য পৃথক জেন্ডার বাজেট ঘোষণা করেছেন। এর মধ্যে ২৭টি মন্ত্রণালয় ও ১৬টি বিভাগকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। গত অর্থবছরে ৪০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের জন্য ৯২ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকার নারী উন্নয়ন বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছিল। আগামী বাজেটে এই বরাদ্দের পরিমাণ আরও বাড়ানো হচ্ছে। এদিকে, জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১ তে সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্রীয় ও জনজীবনের সব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়েছে। এতে নারী-পুরুষের বিদ্যমান বৈষম্য নিরসন করা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিম-লে নারীর অবদানের যথাযথ স্বীকৃতি প্রদান করা, কর্মসংস্থান, বাজার ও ব্যবসায় নারীকে সমান সুযোগ ও অংশীদারিত্ব দেয়া এবং নারী-পুরুষ শ্রমিকদের সমান মজুরি প্রদানের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এখনও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রগুলোতে সমান মজুরি পাচ্ছে না নারী শ্রমিকরা। যদিও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান ও সরকারী চাকরিতে মজুরি বৈষম্য নেই। এক্ষেত্রে সবাই সমান বেতন ও সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আসছেন। তবে দেশের পোশাক শিল্পের ৮০ শতাংশ শ্রমিকই নারী। দেশের প্রধান রফতানিমুখী এ শিল্পখাতে গত ৪ বছরে নারী শ্রমিকের কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি কমেছে বলে জানিয়েছে বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। সম্প্রতি ১৯৩টি প্রতিষ্ঠানের ২ হাজার শ্রমিকদের মধ্যে জরিপ চালিয়ে সিপিডি তাদের গবেষণায় বলেছে ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৪ বছরে পোশাক খাতে কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। যা ২০০৫ থেকে ২০১২ পর্যন্ত ছিল ৪ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। সেই হিসাবে ৪ বছরে কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধির হার কমেছে দশমিক ৭১ শতাংশ। সার্বিকভাবে তৈরি পোশাক খাতে নারী শ্রমিকের সংখ্যাও কমেছে। এছাড়া পুরুষ-নারীদের মজুরির ক্ষেত্রে গড়ে তিন শতাংশ বেতন বৈষম্য রয়েছে বলেও সংস্থাটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। এখানে পুরুষদের বেতন গড়ে সাত হাজার ২৭০ টাকা আর নারীদের সাত হাজার ৫৮ টাকা। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর দেশে পোশাকখাতে সামাজিকভাবে অগ্রগতি হলেও অর্থনৈতিকভাবে অগ্রগতি পিছিয়ে। নারী-পুরুষের বেতন বৈষম্য কমে আসলেও নারী কর্মসংস্থানের হার কমেছে। এদিকে, চলতি বাজেটের মতো এ বছরও জেন্ডার বাজেটকে তিনটি অংশে ভাগ করে নারী উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। এর প্রথম অংশে নারীর ক্ষমতায়ন ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে চারটি মন্ত্রণালয় ও পাঁচটি বিভাগের জন্য বাজেট প্রণয়ন করা হবে। এগুলো হলো-প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, কৃষি মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এ বছরের নারী উন্নয়ন বাজেটে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে দুটি বিভাগ এবং শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে দুটি বিভাগকে জেন্ডার বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দ্বিতীয় অংশে উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং শ্রমবাজার ও আয়বর্ধক কাজে নারীর অধিকতর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আটটি মন্ত্রণালয় ও একটি বিভাগের জন্য বাজেট প্রস্তাব করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। এছাড়া জেন্ডার বাজেটের তৃতীয় অংশে সরকারী সেবা প্রাপ্তিতে নারীর সুযোগ বৃদ্ধির ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এতে ১৫টি মন্ত্রণালয় ও ১০টি বিভাগের জন্য জেন্ডার বাজেট দেয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ইতোমধ্যে আগামী বাজেটেও নারী উন্নয়নে বরাদ্দ বাড়ানোর আভাস দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত এবং রূপকল্প-২১ বাস্তবায়নে নারীর ক্ষমতায়ন ও কর্মসংস্থানে সরকার সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এদিকে, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, এক দশক আগে ২০০৬ সালে বাংলাদেশ থেকে ১৮ হাজার নারী বিদেশে কাজ করতে গিয়েছিলেন। আর ২০১৬ সালে সেই সংখ্যা ১০ গুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৮ হাজারে। বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের নারীরা মূলত লেবানন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও জর্ডানে কাজ করতে যাচ্ছেন। সবচেয়ে বেশি যাচ্ছেন ঢাকা, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, কিশোরগঞ্জ, বরিশাল, হবিগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জ থেকে। গত বছর সবচেয়ে বেশি নারী কর্মী গেছেন সৌদি আরবে। বিএমইটির এক উর্ধতন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, এখন আর নারীদের বিদেশে যেতে কোন খরচ হচ্ছে না। নিয়োগকর্তারাই টাকা দিয়ে দিচ্ছেন। ফলে নারীরা বেশি বিদেশে যাচ্ছেন। এখন নারী কর্মীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। ফলে সমস্যাও কমে আসছে। বিবিএসের জরিপে জানা গেছে, কৃষিতে নারী শ্রম শক্তির মধ্যে ৬৮ শতাংশ নারী। তবে জমির মালিকানায় পুরুষের ৮১, আর নারীর আছে মাত্র ১৯ ভাগ। কর্মক্ষম নারীদের মধ্যে কৃষি কাজে সবচেয়ে বেশি নারী নিয়োজিত রয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করতে হলে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করা অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়ছে। বিআইডিএসের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো নাজনীন আহমেদ বলেন, নারীর ক্ষমতায়নের জন্য ঘরের কাজে পুরুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। কারণ নারীকে অর্থনীতিতে অবদান রাখতে গিয়ে ঘরে-বাইরে সমান দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে, যা তার জন্য বোঝাস্বরূপ।
×