ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দেশের জন্য ওদের আছে অনেক অর্জন, কিন্তু মূল্যায়ন নেই

প্রকাশিত: ০৫:১০, ৮ মার্চ ২০১৮

দেশের জন্য ওদের আছে অনেক অর্জন, কিন্তু মূল্যায়ন নেই

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে নারী খেলোয়াড়রা বাংলাদেশের জন্য নানা অর্জন নিয়ে আসলেও তার যথাযথ মূল্যায়ন পান না। উল্টো নানা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন নারী খেলোয়াড়রা। আবার সরকার, পৃষ্ঠপোষক, পরিবার কিংবা সমাজ থেকে আর্থিক, সামাজিক কিংবা উন্নয়নগত সহযোগিতা পান না নারী খেলোয়াড়রা। যে কারণে নারীরা ক্রীড়া ক্ষেত্রে আসতে উৎসাহিত হন না। আর্ন্তজাতিক নারী দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার একশনএইড বাংলাদেশ আয়োজিত ‘ক্রীড়াঙ্গনে নারী: সংগ্রামে, মুক্তিতে’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে হাজির হন বাংলাদেশের এগারো জন নারী খেলোয়াড়। তারা জাতীয় পর্যায়ে উঠে আসার গল্প তুলে ধরেন। এই ১১ জন নারী খেলোয়াড় হলেন- বাংলাদেশ জাতীয় কাবাডি দলের দলনেতা- শাহনাজ পারভীন মালেকা, বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের দলনেতা- রুমানা আহমেদ, বাংলাদেশ জাতীয় অনুর্ধ্ব ১৫ ফুটবল দলের দলনেতা- মারিয়া মান্দা, ভারোত্তোলনে মাবিয়া আক্তার সীমান্ত, পর্বতারোহী -ওয়াসফিয়া নাজরীন, শূটিং-এর উম্মে জাকিয়া সুলতানা টুম্পা, এ্যাথলেট- শিরীন আক্তার, সাঁতারু- সোনিয়া আক্তার, টেবিল টেনিস-এর সোনাম সুলতানা সোমা, বাংলাদেশ জাতীয় বাস্কেটবল দলের দলনেতা-আসিন মৃধা গলফ-এর সামাউন আনজুম অরণি এবং ঘোড় সওয়ার- তাসমিনা আক্তার। এদের সঙ্গে দুইজন সাংবাদিক, একজন রেফারি এবং একজন সাবেক শূটারকেও সম্মাননা দেয় প্রতিষ্ঠানটি। শিরিন আক্তার বাংলাদেশের দ্রুততম মানবী। ১০০ মিটার নয় ২০০ মিটারেও। সাতক্ষীরার মেয়ে শিরিন আক্তারের পথচলাটা মোটেও সহজ ছিল না। রক্ষণশীল এক পরিবারে তার বেড়ে ওঠা। বাবা-মায়ের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে চুরি করে অনুশীলন করতেন। ঢাকায় যতই শর্টস পড়ে ট্র্যাকে দৌড়াক না কেন এখনও সাতক্ষীরায় গেলে রীতিমত বোরকা পরে বাইরে বের হতে হয় তাকে। এতকিছুর পরও অবশ্য দমেননি শিরিন। স্বপ্ন দেখে চলেছেন দুর্বার গতিতে। তাইতো সাতক্ষীরার সেই মেয়ে চলে গিয়েছেন রিও অলিম্পিকে। তিনি জানান, ‘পরিবারের পক্ষ থেকে মেয়েদেরকে অবশ্যই সাপোর্ট দিতে হবে। আমি অনেক যুদ্ধ করে এ জায়গায় এসেছি। আমার এলাকার এক শিক্ষক আমাকে বিকেএসপিতে ভর্তি করতে সাহায্য করেন। এরপর থেকেই আমার পথচলা শুরু।’ বাংলাদেশ বাস্কেটবল দলের দলনেতা আসিন মৃধা। বাস্কেট বলটা আসিনদের নেশা। তবে খুব হতাশ হয়েই ওরা জানান ইচ্ছে থাকলেও এটাকে পেশা হিসেবে নিতে পারেন না তারা। তবে হাল ছাড়েন না তাতে। পথটা দেখিয়ে যেতে চাই বাকিদের। ২০১৬ সালে নেপালে হয়েছে প্রথম সাউথ এশিয়ান উইমেন বাস্কেটবল টুর্নামেন্ট। সেখানে অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশের আসিন ও তার সঙ্গীরা। এটা তো কেবল যাত্রা শুরু। ওরা চাইছেন কোন কিছুর বিনিময়ে না হোক ওরা একটা পথ দেখিয়ে গিয়েছেন, যেখানে অন্তত পাঁচ বছর না হলেও অন্তত দশ পরেও ওদের দেখানো পথ ধরেই বহুদূর এগিয়ে যাবে বাংলাদেশের মেয়েরা। বাস্কেটবল খেলোয়াড় হিসেবে তারা যেসব প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন তা জানাতে গিয়ে আসিন মৃধা বলেন, ‘নারীরা যে বাস্কেটবল খেলতে পারে এটাই অনেকে বিশ্বাস করতে চায় না। আমরা খেলার জন্য নিরাপদ জায়গা পাই না। আবার একজন নারী যখন এই খেলায় আসে তখন তার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় থাকে। কারণ জাতীয় পর্যায়ে খেলোয়াড়দের কোন আর্থিক নিরাপত্তা নেই।’ রুমানা আহমেদ অধিনায়ক বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাম্প্রতিক পারফরমেন্স সবই যখন নিরাশ করে তখন কিছু অর্জনের কথা শোনান রুমানা। এই বছরই প্রথমবারের মত অস্ট্রেলিয়ায় জনপ্রিয় টি-টোয়েন্টি লীগ বিগ ব্যাশে ডাক পেয়েছেন তিনি। তিনি স্বপ্ন দেখেছেন আর সেটাকে ছুঁয়েও দেখেছেন। জানালেন, ‘প্রিমিয়ার লীগে খেলা ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা এক সঙ্গে চালিয়েছেন। এমনও হয়েছে যে পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে বাসে উঠে আবার এসে খেলার মাঠে। আবার খেলা শেষ করে খুলনা। এই আসা যাওয়ার মাঝেই যতটুকু পড়া। রুমানা আহমেদের গল্পটা সিনেমার মত শোনালেও এই পথটা তার জন্য কিন্তু এতটা মসৃণ ছিল না। সমাজ, সংসার সবকিছুই ছিল বিপক্ষে। মেয়ে পড়াশুনা কর, নতুবা সংসার কর এ কথাগুলোই পরিবার সবসময় বলেছে তাকে! কিন্তু রুমানা থেমে থাকেননি। তিনি পড়ার পাশাপাশি খেলাও চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি নিজের প্রতিভা দেখাতে চেয়েছেন, আর তাইতো ঘুরে এসেছেন বিগ ব্যাশ থেকে। বাংলাদেশ জাতীয় অনুর্ধ্ব ১৫ ফুটবল দলের দলনেতা- মারিয়া মান্দা। যার অধিনায়কত্বে বাংলাদেশ সেরা। বাবার কোন অস্তিত্ব নেই মারিয়ার স্মৃতিভা-ারে। বাবা দুনিয়া ছাড়ার পর গৃহপরিচারিকার কাজ নেন মা ও বোন। হতদরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা মারিয়ার হাতেই উঠেছে দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের স্মারক। ৬ বছর আগে বঙ্গমাতা স্কুল ফুটবল দিয়ে ক্যারিয়ারের শুরু। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পরিণত হয়েছেন তিনি। সেই সিঁড়ি বেয়ে এখন অনূর্ধ্ব-১৫ দলের অধিনায়ক। এফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপ ও এফসি অনূর্ধ্ব-১৬ মূলপর্বে দলের অধিনায়ক ও সহ-অধিনায়ক ছিলেন এই মিডফিল্ডার। নেতৃত্বটা শুধু দলকে সুশৃঙ্খল রাখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। মাঝমাঠ থেকে খেলা গড়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। কখনও রক্ষণ দূর্গ আগলে আবার কখনও উঠে আসেন আক্রমণে। এখানে থেমে যাওয়া নয় আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে চান দেশের নারী ফুটবল দলকে। এছাড়া হালটা শক্ত হাতে ধরতে চান নিজের অভাবী পরিবারের। সামাউন আনজুম অরণি গলফার। বাংলাদেশের প্রথম পেশাজীবী নারী গলফার তিনি। স্কুলে পড়াশোনার সময় অতটা খেলাপ্রীতি ছিল না। একবার মায়ের হাত ধরে কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবে খেলা দেখতে যান। এরপরই উৎসাহ পান। শুরু করেন গলফ খেলা। সেটা ২০১০ এর দিকে। গোটা এক দশক এ্যামেচার হিসেবে পরিশ্রমের পর বাংলাদেশের প্রফেশনাল গলফার এ্যাসোসিয়েশন অরণির হাতে তুলে দিলেন প্রোকাট। এ্যামেচার হিসেবে ওপেনে খেলার পর ২০১৩ সালে সর্বপ্রথম বাংলাদেশ গেমসে সেনাবাহিনীর হয়ে যেতেন ব্রোঞ্চ। আর দলগতভাবে সোনা। ২০১৬ সালে ডি’গ্রেডেড সার্টিফিকেট প্রাপ্ত হন অরণি। তার পরের বছরে পান সি’গ্রেড। তাকে এনে দেয় পেশাদারের মর্যাদা। অথচ এই অরণির গলফের পথচলাটাও কিন্তু সহজ ছিল না। অরণি জানান, তিনি যখন প্রথম গলফ খেলতে আসেন সমাজ সংসার তাকে বলেছিল রোদে পুড়ে কালো হয়ে যাবে। ছেলেদের পোশাক পরে ঘুরলে কেউ বিয়ে করবে না। কিন্তু সেই অরণিকেই বিয়ে করেছেন এমন একজন, যিনি এই গলফ দিয়েই বিশ্বকে চেনান বাংলাদেশকে। সেই সিদ্দিকুর রহমান। তবে শুধু সিদ্দিকুর রহমানের পরিচয়ে নন নিজের পরিচয়েও গর্বিত হতে চান এই নারী গলফার। দুরন্ত ঘোড়ার পিঠে ছোট্ট মেয়ে তাসমিনা আক্তার। কোন মেয়ে ঘোড়াই চেপে বাতাসে চুল এলিয়ে পথ-ঘাট প্রান্তর পেরিয়ে তীরের বেগে ছুটে যাচ্ছে। এমন দৃশ্য সিনেমায় সম্ভব হলেও বাংলাদেশে ছিল অকল্পনীয় যা ১২ বছরের তাসমিনা আক্তার সম্ভব করে দেখিয়েছেন। দেশের উত্তরাঞ্চল তো বটেই গাজিপুর, ময়মনসিংহেও ছিপছিপে গড়নের এই বালিকা এখন তুখোড় ঘোড়সওয়ার হিসেবে পরিচিত। নওগাঁ জেলার চকসুবল ছোট্ট গ্রাম থেকে উঠে আসা এই মেয়েটার স্বপ্ন অবশ্য বেশি কিছু নয়। তাসমিনার সাহস, শক্তি, সংকল্প এদেশের অন্য মেয়েদের প্রেরণা যোগায়। বর্তমানে জীবনের স্বপ্ন কী জানতে চাইলে তাসমিনা বলে, ‘আমার নিজের একটা বড় ঘোড়া চাই। আর কিছু না।’ তাসমিনা শঙ্করপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। সে জানায়, একটি প্রথম শ্রেণীর জাতীয় দৈনিকের কাছ থেকে একটা ঘোড়া পেয়েছে সে। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে একমুঠো ভাত খেয়ে ঘোড়ার পিঠে ওঠে। দুপুরে এসে দুটো খেয়ে আবার ঘোড়া নিয়ে বের হয়। সারা দিন ঘোড়ার পিঠেই থাকে। শাহনাজ পারভীন মালেকা। প্রায় এক দশক ধরে বাংলাদেশের মহিলা কাবাডি দলের অপরিহার্য সদস্য তিনি। এই আসনটা কিন্তু তাকে কেউ দেয়নি, অর্জন করে নিয়েছেন নিজ দক্ষতায়। মালেকা ২০০৮ থেকেই জাতীয় কাবাডি দলকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন বাংলাদেশ আনসারের হয়ে। তার নেতৃত্বে গুয়াহাটি শিলং সাউথ এশিয়ান গেমসে সোনা জিতেছিল বাংলাদেশ, ২০১৪ সালে আনসার রাষ্ট্রপতি পদক পান মালেকা। এছাড়াও অসংখ্য আন্তর্জাতিক ও জাতীয় অর্জন আছে মালেকার। এখানেই থেমে থাকা নয় যেতে চান বহুদূর। তিনি জানান, ‘আমাদের অনেক অর্জন আছে তবে তার মূল্যায়ন হয় না। বিনিয়োগ করা হয় না আমাদের খেলায়। প্রচার হয় না আমাদের সাফল্যের। সঠিকভাবে আমরা ভাতা পাই না।’ উম্মে জাকিয়া সুলতানা টুম্পা। পেশাদার শূটার। ১৯তম জাতীয় শূটিংয়ে মেয়েদের ১০০ মিটার রাইফেলে সেরা হয়েছেন ঢাকা রাইফেল ক্লাবের উম্মে জাকিয়া সুলতানা টুম্পা। ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে ৪০৫ দশমিক ০৮ পয়েন্টে তৃতীয় হয়েছেন সাউথ এশিয়ান গেমসে লালমনিরহাটের মেয়ে টুম্পা। তিনি বিকেএসপির ছাত্রী। তারা অবশ্য কিছুটা ক্ষেপে আছেন। শূটিং দিয়েই বাংলাদেশের অনেকখানি আন্তর্জাতিক অর্জন। কিন্তু তাদের ক্ষোভ তাদেরকে সেভাবে হাইলাইট করা হয় না। টুম্পা জানান, ‘ফুটবল কিংবা ক্রিকেটের মত শূটিংটাও টেলিভিশনে দেখানো হোক, যাতে বাংলাদেশের আরও অনেক মেয়ে পেশা হিসেবে বেছে নিতে পারে শূটিংটাকে। তবে ক্ষোভ প্রকাশ করে এই শূটার বলেন, ‘আমাদের জন্য কোন বেতন নেই। আমাদের খেলার কোন মূল্যায়ন নেই। পুরুষ খেলোয়াড়রা কোন খেলায় জিতলেই তাদের গাড়ি-বাড়ি দেয়া হয়। কিন্তু আমরা এত অর্জন করেও সেটির মূল্যায়ন পাই না।’ সোনিয়া আক্তার। জলের বুকে আগুন জ্বালান। এসএ গেমসে ব্রোঞ্জ জিতেছেন ২০১৬ সালে। তার আগে ইন্দো-বাংলায় গোল্ড মেডেল জিতেছেন। এরকম আরও অসংখ্য অর্জন আছে সোনিয়ার। কিন্তু জলে দাপিয়ে বেড়ানোর আগে কম বাধা কি সহ্য করতে হয়েছে তাকে? জলে নামলেই যে পাড়া-প্রতিবেশী থেকে শুরু করে সবাই বলত, ‘তোমার কাজ তো জলে নামা নয়, তোমার কাজ ঘরের ভেতরে’। তবে ঘরের ভেতরে বসে থাকেনি সোনিয়া। জলের বুকে আগুন জ্বালিয়েছেন তিনি। বিশ্বকে দেখাতে চাইছেন জল পাড়ি দিয়ে তিনি কতদূর যেতে পারেন সেই ক্ষমতা। বিজয়ীর মঞ্চে উঠে অঝোরে কাঁদছিলেন মাবিয়া আক্তার সীমান্ত। গলায় মেডেল ঝুলানোর পরও সেই কান্না থামছিল না। জাতীয় সঙ্গীতের সময় কান্না আরও বেড়ে গিয়েছিল। ১২তম এশিয়ান গেমস ২০১৫ সালের আসরে ময়েদের ৬৩ কেজি ওজন শ্রেণীতে শ্রীলঙ্কা এবং নেপালের প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে সোনার পদক জিতেছিলেন বাংলাদেশের মেয়ে মাবিয়া। সেদিন তার সঙ্গে কেঁদেছিলো সারা বাংলাদেশ। নেপালের এশিয়ান চ্যাম্পিওনশিপে ব্রোঞ্জ এবং মালয়েশিয়ায় কমনওয়েল্থ চ্যাম্পিওনশিপে রৌপ্য পদক জিতেন। ২০১৪ সালে এফ্রোএশিয়ান কাপ-উজবেকিস্তান এবং প্রাইসকাপ থাইল্যান্ড-এ যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় হন। পর্যায়ক্রমে তার ধারণক্ষমতা বাড়তে থাকে। ৬৩ কেজির পরে সর্বচ্চো অর্জন আসে ২০১৬ সালের এসএ গেমস-এ যখন তিনি ১৭৬ কেজি ভার উত্তোলন করে হারিয়ে দেন তার ভারতীয় প্রতিপক্ষকে। এই ভারোত্তলোকের জন্মস্থান বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলা। ভারোত্তোলনের হাতেখড়ি হয় তার শাহাদত আঙ্কেলের মাধ্যমে। ধীরে ধীরে তিনি তার খেলাকে ভালবাসতে শুরু করেন এবং ফেডারেশন তাকে যথেষ্ট সহযোগিতা করে। ফেডারেশন-এর সচিব তাকে নিজ খরচে যাতায়াত ভাড়া দিতেন। এমনকি মাঝপথে থেমে গিয়েছিল তার উচ্চশিক্ষা। শুরুর পথটা এত মসৃণ না হলেও বর্তমানে মাবিয়া আবার তার পড়ালেখা শুরু করেছেন, যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশ আনসারের গর্বিত বাহিনীতে। ‘পর্বতারোহণ আমার নেশা, উন্নয়নকর্ম আমার পেশা, আমি দুটোকেই এক করেছি এটা প্রমাণ করতে যে এদেশের নারীরা কত এগিয়ে এসেছে এবং একই সময়ে দেখা যে এখনও আমাদের কতদূর এগিয়ে যেতে হবে’। প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে ২০০৬ থেকে পর্বতারোহণ শুরু করে ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্বের সাত অঞ্চলের সর্বোচ্চ সাত শৃঙ্গ জয় করেছেন অভিযাত্রী ওয়াসফিয়া নাজরীন। তিনি দ্বিতীয় বাংলাদেশী নারী হিসেবে ২০১২ সালে বিশ্বের সর্বোচ্চ চূড়ায় আরোহণ করেন। একজন উন্নয়নকর্মী এবং পর্বতারোহী হিসেবে টেকসই উন্নয়ন, আদিবাসী সংস্কৃতি, নারীর যে কোন মানবাধিকার সংক্রান্ত সচেতনতামূলক আন্দোলনে খেলাকে তিনি কৌশল হিসেবে দেখেন। তিনি বাংলাদেশের নারীদের নামে উৎসর্গ করেন তার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ আরোহণ-মাউন্ট কিলিমানজারো (আফ্রিকা), ডিনালি (উত্তর অমেরিকা), মাউন্ট ইলব্রাস (ইউরোপ), একোনকাগুয়া (দক্ষিণ আমেরিকা), কার্টেন্স পিরামিড (অস্ট্রেলিয়া), ভিনসর (এন্টার্কটিকা) এবং মাউন্ট এভারেস্ট (এশিয়া)। শৈশব এবং কৈশোরে নানামুখী ট্রমার শিকার ওয়াসফিয়া চিরকাল নারী এবং কিশোরীদের ক্ষমতায়নে কাজ করেছেন। তিব্বত ও ভারতের আদিবাসী নারী কিংবা সমুদ্র উপকূলের নারীদের কাছে গিয়েছেন যারা শিল্পকে ট্রমা উপশমকারী হিসেবে ব্যবহার করেন। যৌনপল্লীতে যাদের জন্ম কিংবা যাদের বাধ্য করা হয়েছে এখানে কাজ করতে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। ২০১৬ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ওসেল ফাউন্ডেশন। এর মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের তরুণীদের পর্বতারোহণসহ এর আনুষঙ্গিক-এর ওপর প্রশিক্ষণ দেন। একজন লেখিকা, উন্নয়নকর্মী এবং পর্বতারোহী হিসেবে ওয়াসফিয়া বাংলাদেশসহ বিশ্বের তরুণীদের পর্বতারোহণের মাধ্যমে ক্ষমতায়নের বার্তা দিয়ে চলেছেন। সামাজিক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি সমুজ্জ্বল করার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে এদেশের নারী এবং কিশোরীরা। তাদের এগিয়ে যাওয়ার সাহস এদেশের যুবাদের প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। সমাজ পরিবর্তনে তাঁদের এই বলিষ্ঠ ও অনুকরণীয় ভূমিকা নারীর এগিয়ে চলার পথকে আর সুগম করতে সহায়তা করেছে। নারীনেত্রী খুশি কবির বলেন, ‘বাস্তবতা হলো একজন নারী বা কিশোরী খেলোয়াড়কে নানা ধরনের বৈষম্যের সম্মুখীন হতে হয়। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে লিঙ্গ-বৈষম্য, সমালোচনা এবং সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রেও বৈষম্যের শিকার হন নারী খেলোয়াড়রা। ক্রীড়া ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের ভেদাভেদ খুবই দুঃখজনক। এটি নারীর ক্ষমতায়নের অন্তরায়। নারী খেলোয়াড়দের প্রতি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।’ যুবা ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী আরিফ খান জয় বলেন, ‘জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০-এ খেলাধুলাকে উন্নয়নের অন্যতম নির্দেশক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে যা কিনা নারী এবং কিশোরীর ক্ষমতায়নসহ একটি সমন্বিত সমাজ গঠনে সহায়ক। সরকার নারী খেলোয়াড়দের উন্নয়নে কাজ করছে। নারী খেলোয়াড়দের উন্নতি হলে আমরা আরও এগিয়ে যাব।’ একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, ‘নারীরা প্রথমে পরিবারেই খেলাধুলায় বাধা পান। এরপর যখন তারা একটু একটু এগিয়ে আসে তখন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বৈষম্যের শিকার হন। যখন তারা জাতীয় পর্যায়ে আসেন তখন তারা পান না পৃষ্ঠপোষক। তাদের উন্নয়নে পাওয়া যায় না বিনিয়োগকারী। ফলে নারীরা এগিয়ে যেতে পারে না।’
×