ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিউটি পারভীন

লঙ্কায় টাইগারদের ফেরার সংগ্রাম!

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ৭ মার্চ ২০১৮

লঙ্কায় টাইগারদের ফেরার সংগ্রাম!

দলটিকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছিল। টানা সাফল্য আসছিল তিন ফরমেটের ক্রিকেটেই। দেশের মাটিতে ভাল নৈপুণ্য দেখানোর পাশাপাশি বিদেশের মাটিতেও ক্রমেই নিজেদের মেলে ধরছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। কিন্তু হঠাৎ করেই যেন সেখানে বিপরীত দিকে বইতে শুরু করেছে হাওয়া। এখন এক আঁধার ঘিরে ধরেছে টিম বাংলাদেশকে। সেখান থেকে ফিরে আসার চ্যালেঞ্জটা এবার শ্রীলঙ্কা সফরে। শ্রীলঙ্কার স্বাধীনতার ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষে তারা আয়োজন করছে নিদাহাস ট্রফি। এখানেই নতুন অগ্নি পরীক্ষার সামনে বাংলাদেশ দল। নিজেদের অস্তিত্ব যেখানে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গেছে সেখানে এখন সম্মান ও মর্যাদা ফিরে আনার লক্ষ্য। বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ হিসেবে যে ভারতীয় দল ও স্বাগতিক শ্রীলঙ্কা তাদের চেয়ে শক্তিমত্তা কম না হলেও এখন সেটাকে দৈত্যাকারই মনে হচ্ছে। কারণ, সাম্প্রতিক টানা ব্যর্থতা। ভারত নিয়মিত অধিনায়ক বিরাট কোহলি ও অভিজ্ঞ মহেন্দ্র সিং ধোনীসহ নিয়মিত ৫ পারফর্মারকে ছাড়াই দল নিয়ে শ্রীলঙ্কায় এসেছে এই সিরিজে খেলার জন্য। আর লঙ্কানরা দীর্ঘ ব্যর্থতা কাটিয়ে সবেমাত্র কিছুটা ফিরে পেয়েছে নিজেদের রং। এ কারণে শক্তির বিচারে বাংলাদেশকে খুব পিছিয়ে রাখছেন না ক্রিকেট বোদ্ধারা। কিন্তু ঘরের মাটিতে সম্প্রতিই শ্রীলঙ্কার কাছে যেভাবে নাস্তানাবুদ হয়েছে বাংলাদেশ দল, তাতে করে কোনভাবেই খুব বেশি আশা করা যাচ্ছে না। তাছাড়া অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানকে ছাড়াই এবারও খেলতে হবে এবং স্থায়ী প্রধান কোচ নেই। কোচিং স্টাফেও এসেছে অদল-বদল। সবমিলিয়ে কঠিন অগ্নিপরীক্ষার মধ্যেই পড়তে হবে বাংলাদেশকে নিজেদের প্রমাণ করার জন্য। অনেক আগেই ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশ দল নিজেদের শক্তিমত্তার প্রমাণ বিভিন্ন সময়ে দিয়েছে। আর নিয়মিত বড় দলগুলোর বিপক্ষে দুর্দান্ত নৈপুণ্য দেখিয়ে নাম কামিয়েছে ‘টাইগার’ হিসেবে। কিন্তু বাঘের থাবায় এখন আর যেন সেই ধারালো ভাব নেই। ঝিমিয়ে পড়া একটি দলে পরিণত হয়েছে। শুরুটা গত বছর দক্ষিণ আফ্রিকা সফর থেকে। হুট করেই ছন্দপতনের শুরু হয় সেখানে। তিন ফরমেটের সিরিজেই লজ্জাজনক কিছু রেকর্ডের পরাজয় সঙ্গী হয়। অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে এবারই প্রোটিয়া মাটিতে সবচেয়ে খারাপ নৈপুণ্য দেখায় বাংলাদেশ দল। যার ধাক্কা এবার ঘরের মাটিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজে প্রকট আকার ধারণ করে। খুব বাজেভাবে লঙ্কানদের কাছে নতি স্বীকার করে স্বাগতিক বাংলাদেশ। মাশরাফি বিন মর্তুজা ওই দক্ষিণ আফ্রিকা সফর থেকেই টি২০ দলে নেই- অবস্থা বেগতিক দেখে আবার তাকে অবসর ভাঙ্গিয়ে ফেরানোর জোর প্রচেষ্টা চালিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। ফেরেননি তিনি, তাই ইনজুরি আক্রান্ত টি২০ অধিনায়ক সাকিব আল হাসানকে ছাড়াই এবার শ্রীলঙ্কার মাটিতে অগ্নিপরীক্ষার সামনে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের নেতৃত্বাধীন দল। তিনি নিজেও বলেছেন, শ্রীলঙ্কার আয়োজিত নিদাহাস ত্রিদেশীয় টি২০ সিরিজ বাংলাদেশের সামর্থ্য প্রমাণের মঞ্চ। অস্তিত্ব ও মর্যাদা রক্ষার চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশ দলের শুরু হবে বৃহস্পতিবার শক্তিশালি ভারতের বিপক্ষে। তবে এর আগেই আজ স্বাগতিক শ্রীলঙ্কা ও ভারতের মধ্যে ম্যাচ দিয়ে মাঠে গড়াচ্ছে এ ত্রিদেশীয় আসর। ওয়ানডেতে একটা মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে যেতে পারলেও অন্য দুই ফরমেটে বাংলাদেশ দল কখনোই তেমন সুবিধা করতে পারেনি। দীর্ঘ পরিসরের টেস্ট ক্রিকেট এবং ক্ষুদ্রতম পরিসরের টি২০ ক্রিকেটে নিজেদের এখন পর্যন্ত ভাল অবস্থানে নিয়ে যেতে পারেনি বাংলাদেশ দল। তবে মাঝের সময়টাতে পরিস্থিতি বদলাচ্ছিল। উঁকি দিচ্ছিল উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সূর্য কিরণ। এ দুই ফরমেটেও বেশ ভাল দলে পরিণত হচ্ছিল। কিন্তু সেই অবস্থা এখন নাজুক। এবার ঘরের মাটিতে ত্রিদেশীয় ওয়ানডে সিরিজে খুব ভাল শুরু করলেও পরে আর মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো দূরে থাক খুব বাজেভাবে নাস্তানাবুদ হয়েছে। এরপর টেস্ট সিরিজেও হেরেছে এবং ২ ম্যাচের টি২০ সিরিজেও কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেননি। আর যাদের কাছে এমন পরিণতি সেই শ্রীলঙ্কা গত দেড় বছর ধরেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের তিন ফরমেটে রীতিমতো ধুঁকছিল। তারা এখন বাংলাদেশ মিশনে প্রায় শতভাগ সাফল্য পেয়ে উজ্জীবিত একটি দল। অথচ তাদেরকেই গত বছর এপ্রিলে টি২০ ম্যাচে ৪৫ রানে হারিয়ে দিয়েছিল সফরকারী বাংলাদেশ। ওই সিরিজের পরই দলকে আমূল বদলে দিয়ে সুসংবদ্ধ করা অধিনায়ক মাশরাফি টি২০ ক্রিকেটকেই বিদায় বলে দেন। অধিনায়ক হন সাকিব। কিন্তু তার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে চরম ভরাডুবি হয়। তবে মাশরাফির অভাবটা তখনও কেউ সেভাবে টের পায়নি। তার অভাবটা ক্ষণে ক্ষণেই মনে পড়েছে দেশের মাটিতেও লঙ্কানদের কাছে দুই টি২০ ম্যাচে বাজেভাবে হারার পর। সে কারণেই দলকে আবার ভাল অবস্থায় ফেরাতে মাশরাফিকে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছিল বিসিবি। তবে তিনি সিদ্ধান্তে অটল থেকেছেন। ২০১৪ সালের শেষদিকে ওয়ানডে ও টি২০ দলের অধিনায়ক হওয়ার পর থেকেই তিনি দলকে দারুণভাবে সংঘবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল করে তুলেছিলেন। আসতে শুরু করেছিল টানা সাফল্য। সেই কারণে নিজেদের সেরা ওয়ানডে র‌্যাঙ্কিং ৭ নম্বরেও উঠে আসে দল। টি২০ ক্রিকেটেও দারুন কিছু সাফল্য পায়। এ দুই ফরমেটের আত্মবিশ্বাসের ছোঁয়ায় টেস্ট ক্রিকেটেও নিজেদের মেলে ধরতে শুরু করে বাংলাদেশ। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকা সফর থেকে আবার শুরু নি¤œগতির। এবার ঘরের মাটিতে ত্রিদেশীয় ওয়ানডে সিরিজে সাকিব বাঁ হাতের কণিষ্ঠ আঙ্গুলের ইনজুরিতে পড়ে খেলতে পারেননি শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট ও টি২০ সিরিজ। এ কারণেই আরও দুর্বল হয়ে পড়ে বাংলাদেশ দল। যার কারণে দেশের মাটিতে অপ্রতিরোধ্য দলে পরিণত হওয়া বাংলাদেশ খাবি খেয়েছে। এবার নিদাহাস ট্রফিতেও খেলা হচ্ছেনা তার। দেশের মাটিতে ৫টি পরিবর্তন এনেছিল বাংলাদেশ দল। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের দল থেকে বাদ পড়েছিলেন ৭ ক্রিকেটার। এবার নিদাহাস ট্রফিতেও ৫ পরিবর্তন নিয়ে দল গড়া হয়েছে। সাকিবকে ছাড়া এবারও লড়তে হবে। আবারও মাহমুদুল্লাহর নেতৃত্বে খেলবে বাংলাদেশ দল। খারাপ অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চ্যালেঞ্জ নিতে হবে শ্রীলঙ্কার মাটিতে। এখানে প্রতিপক্ষ শক্তিশালী ভারত ও শ্রীলঙ্কা। ভারতীয় দল অবশ্য নিয়মিত অধিনায়ক বিরাট কোহলি ও অভিজ্ঞ মহেন্দ্র সিং ধোনিসহ নিয়মিত ৫ সদস্যকে ছাড়াই দল গড়েছে। এরপরও রোহিত শর্মার নেতৃত্বে বেশ শক্তিধর দলই তারা। এই দলটি সাম্প্রতিক সময়ে আছে দারুণ ফর্মে। দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গিয়ে স্বাগতিকদের বিপক্ষে ২-১ ব্যবধানে টি২০ সিরিজ জিতে এসেছে। আর শ্রীলঙ্কাও ফিরে এসেছে নিজেদের ভাল অবস্থায়। কোচ চান্দিকা হাতুরাসিংহে বদলে দিয়েছেন চেহারাটা। আর বাংলাদেশ দলের কোন প্রধান কোচ নেই। ঘরের মাটিতে দল টেকনিক্যাল ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদ সুজনের কোচিংয়েই খেলেছে। এবার শ্রীলঙ্কা সফরে ফাস্ট বোলিং কোচ কোর্টনি ওয়ালশ প্রধান কোচের দায়িত্ব পালন করবেন। এছাড়া ব্যাটিং কোচ হিসেবে থাকা রিচার্ড হ্যালসলও নেই বলে এইচপি থেকে আনা হয়েছে হেলমটকে। বোলিং কোচের দায়িত্ব নিয়েছেন কালপাগে। এত পরিবর্তন নিয়েই এখন লড়তে হবে বাংলাদেশ দলকে নিজেদের প্রমাণের জন্য। ভারতের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচেই নিজেদের অবস্থাটা কোন পর্যায়ে আছে তা প্রমাণ হয়ে যাবে। এ বিষয়ে অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহও বলেছেন, ‘আমাদের প্রথম লক্ষ্য অবশ্যই টুর্নামেন্ট জেতা। আমাদের অনেক কিছুই করে দেখানোর বাকি আছে। অনেক কিছুর প্রমাণ দেয়ারও বাকি আছে। অনেকের মনে হয়তো টি২০ ফরমেটে আমাদের শক্তি ও সামর্থ্য নিয়ে একটা প্রশ্ন আছে। আমার মনে হয় এটা আমাদের জন্য খুব ভাল মঞ্চ নিজেদেরকে প্রমাণ করার।’ সেই প্রমাণটা কি এবার দিতে সক্ষম হবে বাংলাদেশ দল? নিদাহাস ট্রফিতে লড়াই করাটা খুব জরুরী মর্যাদা ফিরে পাওয়ার জন্য, আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হওয়ার জন্য।
×