ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

হাতিয়ে নিয়েছে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা

ভয়ঙ্কর সিন্ডিকেটের কবলে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ৭ মার্চ ২০১৮

ভয়ঙ্কর সিন্ডিকেটের কবলে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার

ফিরোজ মান্না ॥ টাঙ্গাইল সদর থানার কাতুরি ইউনিয়নের মনিরুল। একটু সুখের আসায় পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে গিয়েছিল মালয়েশিয়ায়। এখন মনিরুলের চোখের পানি থামছে না। গত কয়েক মাসে অমানবিক পরিশ্রমে শরীর দুর্বল হয়ে গেছে। এখন সে যে কোন মূল্যে দেশে ফিরে আসতে চায়। কিন্তু তার দেশে ফেরার কোন পথ খোলা নেই। এক ধরনের বন্দী জীবন যাপন করছেন মালয়েশিয়ার পেরাক জেলার আইপ শহরে। কুয়ালালামপুর থেকে ৩ শ’ কিলোমিটার দূরে পাথর ভাঙ্গার কাজ করতে গিয়ে সে এখন গুরুতর অসুস্থ। একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে সাক্ষাতকার দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে মনিরুল। মনিরুল জানায়, জনশক্তি রফতানিকারক ইউনিক ইস্টার্নের হাতে সাড়ে ৫ লাখ টাকা তুলে দিয়ে মনিরুল মাত্র ১৫ হাজার টাকার বেতনে চাকরি পেয়েছে। থাকা খাওয়াতেই এই টাকা শেষ হয়ে যায়। বাড়িতে সে কোন টাকা পাঠাতে পারে না। সকাল ৮ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত ১২ ঘণ্টা সময় তাকে কাজ করতে হচ্ছে। দেশে তৈরি জনশক্তি রফতানিকারক ১০ প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেট মনিরুলের মতো এক লাখের বেশি কর্মীকে মালয়েশিয়ায় পাঠিয়ে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। শুধু মনিরুল নয়, হাজার হাজার কর্মী মালয়েশিয়ায় নির্মম জীবন যাপন করছেন। প্রভাবশালী সিন্ডিকেট প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়কেও জিম্মি করে ফেলেছে। দশটি রিক্রুটিং এজেন্সির সমন্বয় গঠন করা হয়েছে এই সিন্ডিকেট। এর বাইরে কেউ মালয়েশিয়া শ্রমিক পাঠাতে পারবে না। এখন সিন্ডিকেট যা বলে তাই আইন। একে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা কারও নেই। জি টু জি প্লাস প্রক্রিয়ায় মালয়েশিয়ায় কর্মী যাওয়ার সরকার-নির্ধারিত খরচ ৪০ হাজার টাকা। কিন্তু কর্মী প্রতি খরচ হচ্ছে সাড়ে চার থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা। অর্থাৎ, নির্ধারিত খরচের দশ থেকে পনের গুণ বেশি দিয়ে কর্মীদের যেতে হচ্ছে। ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা বলছেন, খরচের বিষয়ে তাদের মুখ খুলতে মানা করে দেয়া হয়েছে। মুখ খুললে তাকে আর মালয়েশিয়া পাঠানো হবে না। এমন কি জমাকৃত টাকাও ফেরত দেয়া হবে না। যারা গেছেন তাদেরও ফেরত পাঠানো হবে। নানা কারণেই কর্মীরা ৪০ হাজার টাকার কথাই সব জায়গায় বলে যায়। বাড়তি ৫ লাখ টাকার কথা আড়াল হয়ে যায়। সিন্ডিকেটের এমন ভয়ে দেশের লাখ লাখ তরুণ নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি হতাশার সুরে জনকণ্ঠকে বলেন, আমি তাদের সঙ্গে পারিনি। তারা খুব শক্তিশালী। তারা যা করছে তা কোন মানুষের কাজ না। দানবেও এমন নিষ্ঠুর কাজ করতে পারে না। দেশের গরিব মানুষের টাকা হাতিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের এমন সব ‘ওয়াটজব’ দিচ্ছে যে তারা সেখানে খেয়ে পড়ে এক পয়সাও বাড়িতে পাঠাতে পারে না। যে চাকরির কথা বলে তাদের মালয়েশিয়া পাঠানো হয়েছে তার ধারে কাছেও কেউ চাকরি পায়নি। এসব মনে হলে আমার বুকের মধ্যে চিন চিন করে ব্যথা করে। আমি অনেক বার মালয়েশিয়ার শ্রমমন্ত্রীর সঙ্গে এ নিয়ে রীতিমতো ঝগড়া করেছি। তাতেও কোন কাজ হয়নি। আপনাদের হাতে কলম আছে-আপনারা এই ভয়ঙ্কর জালিয়াতির বিরুদ্ধে লেখেন। দেশের লাখ লাখ মানুষ উপকৃত হবে। হাজার হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার হবে না। এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নমিতা হালদার বললেন, আমরা এমন অনেক ‘কেস ডিল’ করেছি। জনশক্তি রফতানিকারক ও অভিযোগকারী কর্মীকে সামনাসামনি করার পর দেখা গেছে কর্মী যে সাড়ে চার লাখ বা সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছে তা স্বীকার করছে না। তারা সরকারের বেঁধে দেয়া খরচের কথাই বলছে। তখন আর আমাদের কিছু করার থাকে না। আমরা নিজেরাও বুঝতে পারি ওই কর্মী অনেক বেশি টাকা জনশক্তি রফতানিকারকের হাতে তুলে দিয়েছেন। ২০১৩ সালের আইনে যা বলা আছে তাতে আমরা অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আর কোন ব্যবস্থা নিতে পারি না। ১০ টি এজেন্সি নিয়ে গঠিত সিন্ডিকেট সম্পর্কে সচিব বলেন, এই সিন্ডিকেট আমরা হতে দেইনি। সিন্ডিকেট হয়েছে মালয়েশিয়া থেকেই। আমরা মন্ত্রণালয় থেকে ৯ শ’ এজেন্সির তালিকা মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছিলাম। তারা নিজেরা ১০ টি এজেন্সিকে বাছাই করে ৫ লাখ কর্মী নিয়োগের ব্যবস্থা করেছে। মালয়েশিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশনের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়ে ড. নমিতা বলেন, অনেক অভিযোগ আসলে সত্য না। হ্যাঁ কিছু অভিযোগের বিষয়ে আমরা অবহিত। সেগুলো নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। এখন অবশ্য হাইকমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করছে। ৫ লাখ অবৈধ কর্মীর মধ্যে তারা দিন রাত পরিশ্রম করে এক লাখ ৭৩ হাজার কর্মীকে বৈধ করেছে। এটা কিন্তু অনেক বড় কাজ। সিন্ডিকেটের সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে প্রান্তিক ট্রাভেল, ইউনিক ইস্টার্ন, ক্যাথারসিজ ইন্টারন্যাশনাল, ক্যারিয়ার ওভারসিজ, আমিন এ্যান্ড ট্যুরস, এইএসএমটিস হিউম্যান রিসোর্স, সানজারি ইন্টারন্যাশনাল, রাব্বি ইন্টারন্যাশনাল, প্যাজেস এ্যাসোসিয়েটস ও আল ইসলাম ওভারসিজ। বায়রার বর্তমান ও সাবেক কমিটির অনেক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, এই ১০ প্রতিষ্ঠান এ পর্যন্ত এক লাখ ১০ হাজার কর্মী মালয়েশিয়ায় পাঠিয়েছে। বাকি আরও তিন লাখ ৯০ হাজার কর্মী পাঠানোর জন্য তারা প্রায় ১৫ লাখ লোকের কাছ থেকে পাসপোর্ট নিয়েছে। একই সঙ্গে তাদের মেডিক্যাল করার জন্য ৬ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকা নেয়া হয়েছে।
×