ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কাট আউট বা লোন উলফ পদ্ধতিতে ব্যবহার করা হয় ফয়জুরকে

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ৭ মার্চ ২০১৮

কাট আউট বা লোন উলফ পদ্ধতিতে ব্যবহার করা হয় ফয়জুরকে

শংকর কুমার দে ॥ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) স্লিপার সেলের সদস্য হিসেবে কাট আউট পদ্ধতিতে বিশিষ্ট লেখক ও অধ্যাপক ড. জাফর ইকবালকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করেছিল কী না সেই বিষয়ে হামলাকারী ফয়জুরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তদন্তকারীরা। সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায়, জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টাকারী ফয়জুর একা ছিল না, তার সঙ্গে অন্তত আরও দুইজন ছিল যারা বহিরাগত, অপরিচিত মুখ। রহস্যময় বহিরাগত দুই অপরিচিত মুখ কারা সেই প্রশ্ন করা হলে আহত অবস্থায় আটক ফয়জুর নিরুত্তর থাকে। সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যাওয়া ঘটনাস্থলে থাকা বহিরাগত অপরিচিত দুই মুখকে খুঁজছে পুলিশ। ফয়জুর মাঝে মধ্যেই বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গিয়ে এক সপ্তাহ, দশ দিন, পনেরো দিন নিখোঁজ থাকত বলে তদন্তকারীদের জিজ্ঞাসাবাদের উত্তরে তথ্য দিয়েছেন ফয়জুরের মা মিনারা বেগম ও বাবা আতিকুর রহমান। ফয়জুর রহমান হঠাৎ করেই মাঝে মধ্যে বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে কোথায় যেত, কার কাছে যেত, কী করত তা আর এক রহস্যময় বলে যার উত্তর পেতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে তাকে। হামলার সময়ে গণপিটুনিতে আহত হওয়ার পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ফয়জুরকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ, র‌্যাব, পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট ও গোয়েন্দা সংস্থা। দেশজুড়ে আলোচিত এই ঘটনাটির রহস্য উন্মোচনে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের পাশাপাশি, র‌্যাব, সিআইডি, পিবিআই এবং ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট একযোগে কাজ করছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, অধ্যাপক জাফর ইকবালকে হত্যার উদ্দেশে যখন তার ওপর হামলা করা হয় তখন সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায় অন্তত পনেরো জনের ছবির মধ্যে পুলিশ, ছাত্র-শিক্ষকের ছবি থাকালেও বহিরাগত অপরিচিত দুইজনের মুখ কেউই চিনতে পারছেন না। তদন্তকারীরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছাড়াও ছাত্র-শিক্ষক, পুলিশদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন আহত অবস্থায় আটক হামলাকারী ফয়জুরকেও। সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায়, মঞ্চে সোফায় বসে আছেন ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তার পাশে বসা শিক্ষক, পেছনে ছাত্র, পুলিশ যার মধ্যে ফয়জুরের ছবি ও তার পেছনে দুইজন অপরিচিত বহিরাগত মুখ। গত ৩ মার্চ বিকেলে শাবির ইলেট্রিক্যাল এ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ট্রিপল ই) বিভাগের ফেস্টিভ্যাল চলাকালে জাফর ইকবালের ওপর হামলার সময়ের সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যাওয়া দুই অপরিচিত মুখের সন্ধান পাওয়া গেলে জাফর ইকবালকে হত্যা চেষ্টার উদ্দেশ্য কী, কারা জড়িত, সব প্রশ্নের উত্তরই মিলবে, সব রহস্যের জটও খুলে যাবে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, তদন্তকারীদের জিজ্ঞাসাবাদের মুখে আহত অবস্থায় আটক ফয়জুর নিজেকে জঙ্গী স্বীকার করে জাফর ইকবাল ইসলামের শত্রু বলে অভিহিত করে হত্যার চেষ্টা করার কথা স্বীকার করেছে। এরপর তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন, ফেসবুক ওয়েবসাইট, এ্যাপসসহ নানা বিষয়ে পরীক্ষা করা ছাড়াও জিজ্ঞাসাবাদ অনুসন্ধান করছেন তদন্তকারীরা। তবে জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনাটি ‘লোন ওলফ’ (নিজে থেকে জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধ আক্রমণকারী) না ‘টার্গেটেড হামলা’, সে বিষয়ে ফয়জুরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে সে নিজে থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে একাই হামলা করেছে বললেও তা বিশ্বাস করছেন না তদন্তকারীরা। তবে জঙ্গীবিরোধী কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এটি একটি ‘টার্গেটেড’ হামলা। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, জঙ্গীরা সাধারণত টার্গেট করা ব্যক্তির মাথা ও ঘাড়ে কোপায়, যেন অল্প সময়েই টার্গেটেড ব্যক্তি মারা যায়। জাফর ইকবালের ক্ষেত্রে একই ধরনের ঘটনা দেখা গেছে। তবে সৌভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে গেছেন। পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলেন, আহত অবস্থায় গ্রেফতার হওয়া ফয়জুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তার দাবি অনুযায়ী, সে একাই এই কাজে অংশ নিয়েছে। কিন্তু সে একা ছিল, না তার সঙ্গে আরও লোকজন ছিল, তা জানার চেষ্টা চলছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘জাফর ইকবালকে যে মঞ্চের ওপর হামলা চালান হয়, সেখানে বহিরাগত আর কারা উপস্থিত ছিল, তা আমরা খতিয়ে দেখছি। এ সংক্রান্ত ছবি ও ভিডিওগুলো বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। আর কারা ছিল তাদের পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা চলছে। ধারাবাহিক জঙ্গীবিরোধী অভিযানের কারণে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠনগুলো কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। এ কারণে জঙ্গী মতাদর্শে বিশ্বাসী কেউ কেউ নিজ সিদ্ধান্তেই এই ধরনের হামলা চালাতে পারে। এ কারণে একাধিক লোকজনের বদলে ‘লোন উলফ’ বা ‘সিঙ্গেল এ্যাটাকে’র মতো হামলা চালান শুরু করেছে জঙ্গীরা। এই কর্মকর্তার মতে, জঙ্গীদের হামলার নতুন এই ‘ট্রেন্ড’ ভয়ঙ্কর। কারণ কখন কে কোথায় কীভাবে হামলা করবে তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরাপত্তা থাকলেও আঁচ করতে পারবেন না। অতএব, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য এ ধরনের হামলা ঠেকানও অনেক কঠিন। জঙ্গী বিষয়ক তদন্তের সঙ্গে বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বজুড়েই জঙ্গী হামলার ধরন পাল্টে যাচ্ছে। বর্তমানে জঙ্গীবাদের পরিভাষায় লোন উলফ বা সিঙ্গেল এ্যাটাকের ঘটনা ঘটছে বেশি। বাংলাদেশের ‘হোম গ্রোন’ জঙ্গীরাও এই ট্রেন্ড বেছে নিয়েছে। এর আগে ২০১৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর আহমদিয়া জামে মসজিদে ‘লোন উলফ’ হামলার ঘটনা ঘটেছিল। ‘লোন উলফ’ হামলার অর্থ হলো একা একজন ব্যক্তির ‘টার্গেটেড’ কোন স্থানে গিয়ে আত্মঘাতী হামলা করা। এ ধরনের হামলার কারণে হামলাকারী জীবিত থাকেন না কিংবা জীবিত থকালেও তার কাছ থেকে কোন তথ্য সংগ্রহ করতে পারে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ‘লোন উলফ’ হামলাকারী একা টার্গেটেড স্থানে যাওয়ার কারণে মানুষের সন্দেহও কম থাকে। সম্প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ‘লোন উলফ’ হামলার ঘটনা ঘটেছে। এই ধরনের জঙ্গীরা কেবল এনক্রিপ্টেড মেসেঞ্জার এ্যাপসের মাধ্যমে যোগাযোগ হয়ে থাকে। এ কারণে একজন ‘লোন উলফ’ জঙ্গী নিজের বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে থেকেও গোপনে গোপনে হামলার প্রস্তুতি নিতে পারে। বর্তমান সময়ে যে আত্মঘাতী হামলা দেখা যাচ্ছে, সেগুলো অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক। এর আগে আশকোনায় র‌্যাবের নির্মাণাধীন সদর দফতরে দেয়াল টপকে প্রবেশ করে এক যুবক আত্মঘাতী হামলা চালায়। বোমা বিস্ফোরণে শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে মারা যায় হামলাকারী। এতে দুজন র‌্যাব সদস্য আহত হয়েছেন। র‌্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, হামলাকারী জঙ্গী দলের সদস্য। তবে কোন দলের, তা নিশ্চিত করা যায়নি বলে জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা।
×