ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রিপোর্টারের ডায়েরি

প্রকাশিত: ০৪:২০, ৭ মার্চ ২০১৮

রিপোর্টারের ডায়েরি

২৩ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার। রাজধানীর বসুন্ধরা আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের পুনর্মিলনী। ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এক্স স্টুডেন্ট ক্লাব, ঢাকা’ আয়োজন করে এ পুনর্মিলনীর। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বিপুলসংখ্যক প্রাক্তন শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে বসুন্ধরা আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রটি পরিণত হয় বড় ধরনের মিলনমেলায়। উৎসবমুখর পরিবেশে পুরনো বন্ধুদের নিয়ে আনন্দঘন একটি দিন কাটায় সবাই। সকাল ১০টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত এই মিলনমেলা উপভোগ্য হয়ে ওঠে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের কলকাকলিতে। জমকালো এ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে সবাই যেন পেছনে ফিরে তাকায় ফেলে আসা শিক্ষা জীবনের কথা মনে করে। নিজ নিজ ক্লাসমেটদের নিয়ে আবেগঘন পরিবেশে আনন্দে মেতে উঠে তারা। দীর্ঘদিন পর প্রিয় বন্ধুদের কাছে পেয়ে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। আর সবাই মিলে একের পর এক ছবি তুলতে থাকে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে কিছুক্ষণ মধ্যাহ্ন ভোজের বিরতি দিয়ে টানা রাত ১১টা পর্যন্ত চলে অনুষ্ঠান। সারাদিন মন মাতানো আবেগ আর উল্লাসের মাত্রায় যখন সবাই নতুন কিছু আয়োজনের অপেক্ষায় তখনই মঞ্চ বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক উৎসবের ঘোষণা আসে। সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে থাকা সবাই মঞ্চের কাছাকাছি চলে আসে। প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পীদের গানের তালে সবাই নেচে-গেয়ে উল্লাসে ফেটে পড়েন। পুরো অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এক্স স্টুডেন্ট ক্লাব, ঢাকা’ এর সভাপতি আমিন হেলালী, সাধারণ সম্পাদক মারুফ মনসুর, সংগঠনের নেতা মনজুর আলম শাহীন, মজুমদার শাহীন, পারভীন রাব্বানিসহ বেশ ক’জন। ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ উদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী, চাকসু ভিপি শাহ মোহাম্মদ মাজহারুল হকসহ বেশ ক’জন সিনিয়র ভাই আমাদের সঙ্গ দিয়ে অনুষ্ঠানকে প্রাণবন্ত করেছেন। আমাদের একুশতম ব্যাচের বন্ধুদের সরব উপস্থিতি ছিল উল্লেখ করার মতো। আমরা যারা এক সঙ্গে থেকে আনন্দ উপভোগ করেছি তারা হলো -চট্টগ্রামের বন্ধু জহির, বাবু, মাহবুব, মার্লিন, ফয়সাল, ইয়াকুব, শফিউল, সিলেটের বন্ধু শোয়েব, চিনু, ইমরান, মিলি, হাফিজ, মোহসীন, ঢাকার বন্ধু রঞ্জু, সাহীদ, নীলু, জাকির, জেসী, তোফা, মিহির, সানা, সাব্বির, লুসি, শিপন, জনি, সমীর, খোকন, শিল্পী, ঝুমুর, নাসির, কুমিল্লার বন্ধু সৌরভ, নোয়াখালীর বন্ধু নোটন, দিদার ও বগুড়ার বন্ধু মাসুদ। অবশ্য আমি বিকেল ৩টার পর অফিসে চলে যাওয়ায় পুরো অনুষ্ঠানের আনন্দ উপভোগ করতে পারিনি। ব্যস্ততার কারণে আগে যেতে না পেরে অনেকে বিকেলে অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ উপভোগ করেছে। আবার কেউ কেউ কেউ রাতেও মিলনমেলায় যোগ দিয়েছে। শরীফুল ইসলাম ভেজাল লেখার ভেজাল লেখক আজ পাঠকদের শোনাব, এক তথাকথিত-বিশিষ্ট লেখকের অসামান্য-অবিস্মরণীয় এক কীর্তিগাথার কাহিনী। সঙ্গত কারণেই তার নামটি এখানে উল্লেখ করছি না। তবে তার নামের মধ্যে মজার একটি ব্যাপার আছে। তার নামটি হচ্ছে তিন শব্দের। প্রথম শব্দের প্রথম অক্ষর হচ্ছে ‘ম’, আর শেষ শব্দের শেষ অক্ষর হচ্ছে ‘ল’। দুটোকে একত্রিত করলে হয় ‘মল’! তবে এই লেখার বিষয়বস্ত তার নাম নয়, তার কাম নিয়ে। তার কাজ-কারবার যেমন বিচিত্র, তেমনি নিখুঁত। মূলত তিনি ক্রীড়ালেখক। আদতে তিনি হচ্ছেনÑ একজন ভেজাল-লেখক (কপি-পেস্টার ফ্রিল্যান্সার)। আমি তাকে খুব ভালমতোই চিনি ও জানি। তিনি বয়সে আমার বছরে তিনেকের জুনিয়র। এক সময় তিনি আমার অধীনে কনট্রিবিউটর ছিলেন একটি পাক্ষিক ম্যাগাজিনে। তখন আমি ম্যাগাজিনটির সহকারী সম্পাদক (২০০৭-২০০৯) ছিলাম। তখনই তার ওই ‘চুরি বিদ্যা’র বিস্ময়কর প্রতিভা আবিষ্কার করি। আমার তো বটেই, বিভিন্নজনের ক্রীড়া বিষয়ক বিভিন্ন ফিচার তিনি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের ফিচার পাতায় নিজের ও বিভিন্ন ছদ্মনামে ছাপাতেন (৭/৮টি নামে) এবং লেখক-সম্মানী বিল থেকে বিস্তর টাকা কামিয়ে নিতেন। আমি নিজে তাকে দু-দুবার আমার নিজের লেখা কপি-পেস্ট করার দায়ে চার্জ করেছি। তারপরও তিনি বিন্দুমাত্র লজ্জিত-দুঃখিত হননি, সরিও বলেননি! তখন আমি বাধ্য হয়ে ওই ম্যাগাজিনটির তৎকালীন সম্পাদককে (এখন তিনি প্রয়াত) বিষয়টি প্রমাণসহ জানাই। তিনিও বজায় ক্ষেপে যান এবং ওই ভেজাল-লেখককে ওই ম্যাগাজিনের অফিসে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেন। এবং তার লেখাও আর কখনও ওই ম্যাগাজিনে ছাপানো হবে না বলে সাফ জানিয়ে দেন। ফলে ২০০৮-০৯ এই এক বছর ওই ম্যাগাজিনে ভেজাল-লেখক মহাশয় নিষিদ্ধ ও অবাঞ্ছিত ছিলেন। তৎকালীন সেই সম্পাদক ২০০৯ সালে কানাডা চলে যাওয়ার পর তার পদে যিনি আসেন, তাকে হাত করে (তার বিয়েতে দামী গিফট দিয়ে) ভেজাল-লেখক আবারও ওই ম্যাগাজিনটিতে দ্বিগুণ উৎসাহে ‘ভেজাল’ লেখালেখি শুরু করে। কিন্তু আমি তখনও ওই ম্যাগাজিনে ছিলাম। তাই তিনি ভয়ে সে ম্যাগাজিনের অফিসে আসতেন না এবং নিজের নামেও লেখা পাঠাতেন না। লেখা পাঠাতেন বিভিন্ন ছদ্মনামে। আমি এটা অনেক পরে জানতে পারি এবং নতুন সম্পাদকের সঙ্গে এ নিয়ে তীব্র মতবিরোধে জড়িয়ে পড়ি। এর কিছুদিন পরেই আমি দৈনিক জনকণ্ঠে (২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে) জয়েন করি। সেখানে গিয়েও দেখি জনকণ্ঠের সাপ্তাহিক খেলার ফিচার পাতায় ‘ভেজাল-মহাশয়’ সমানে লিখে যাচ্ছে। আমার ক্রীড়া সম্পাদককে ভেজাল-লেখকের কাহিনী সবিস্তারে খুলে বলি এবং জনকণ্ঠে তার লেখা ছাপানো বন্ধ করার ব্যবস্থা করি। কথায় আছে- ‘কয়লা ধুলেও ময়লা যায় না।’ ওই ভেজাল-লেখক এখনও আরেকটি পাক্ষিক ম্যাগাজিনে দেদার লিখে বেড়াচ্ছেন। এছাড়া একাধিক দৈনিকের সাপ্তাহিক খেলার ফিচার পাতায়ও লিখে যাচ্ছেন অবিরাম। একটা সময় ছিল যখন তিনি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত সব দৈনিকের খেলার ফিচার পাতাতেই মহাসমারোহে লিখতেন ‘প্রায়’ শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া তার ‘কপি-পেস্ট’ লেখাগুলো (প্রথম আলো, কালের কণ্ঠ বাদে)। শুধু খেলাধুলা নয়, আপনি যদি তাকে সাহিত্য বাদে যে কোন বিষয় (অর্থনীতি, বিশ্ব সংবাদ, রাজনীতি, অপরাধ, বাজারদর, নাগরিক সমস্যা ...) নিয়ে লিখতে বলেন, তিনি ৩০ মিনিটের মধ্যেই কমপক্ষে ১০০০ শব্দের লেখা প্রস্তুত করে আপনাকে মেইলে পাঠিয়ে দেবেন। প্রশ্ন হচ্ছে- কিভাবে তিনি এত দ্রুত একটি লেখা তৈরি করেন? খুব সহজ। গুগুলে বাংলায় লিখে সার্চ দিলে সব নিউজই পাওয়া যায়। সেগুলোকে বিভিন্ন সফটওয়্যারেরে মাধ্যমে সুতুনি এমজেতে রূপান্তর করে ফেলা যায়। তারপর হেডিংটা বদলে দিয়ে নিজের নামটা বসিয়ে দিলেই ব্যস, তৈরি হয়ে গেল মজাদার-সুস্বাদু মেন্যু! এভাবেই প্রচুর লেখা তিনি ‘সাপ্লাই’ দিয়ে থাকেন। তার এই প্রচুর লেখার ‘ক্ষমতা’ যেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেই তুলনীয়! তবে বুঝতেই পারছেন, বিষয়টি আসলে তা নয়। এভাবেই অসাধারণ উদ্ভাবনী প্রক্রিয়া অবলম্বন করে তিনি বছরের পর পর শিল্পচর্চা করে যাচ্ছেন! সত্যি, তাকে তো এই গুণের জন্য সংবর্ধনাই দেয়া উচিত। তবে কথায় আছে, ‘চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা, যদি না পড়ে ধরা।’ কারও কাছেই তিনি ধরা পড়েন না। তবে আমার কাছে ধরা পড়েছিলেন, কারণ তিনি একসময় আমার অধীনে কাজ করেছিলেন এবং তার নাড়ি-নক্ষত্র আমি চিনি বলে। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, বর্তমানে তিনি একই সঙ্গে দুটি মিডিয়া হাউসে কাজ করছেন। একটি ম্যাগাজিনে, আরেকটি অনলাইনে। ম্যাগাজিনের প্রিন্টার্স লাইনে তার নাম দেখা গেছে। আর অনলাইনের বিভিন্ন লেখায় তাকে পরিচিত করানো হয়েছে বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে। তার দুটি পরিচয়ই যদি সঠিক হয়, তাহলে সেটা কতটা যৌক্তিক? আরও পরিতাপের বিষয়- ওই ভেজাল মহাশয়ের কীর্তিকলাপ জেনেও অনেক সম্পাদক ‘প্রবল’ আগ্রহ নিয়ে তার ভেজাল লেখাগুলো নিয়মিতভাবেই ছাপিয়ে থাকেন! এ যেন জেনেশুনে অন্যায়কারীকে সমর্থন-সাহায্য করা। মূলত তাদের কারণেই ‘মল’দের মতো ভেজাল লেখকের উত্থান হচ্ছে, যা ভীষণ পীড়াদায়ক। ওই সম্পাদকরা কি জানেন না, তারা ভেজাল লেখা ছাপিয়ে নিজেদের পত্রিকা-ম্যাগাজিন-অনলাইনের সুনাম, ঐতিহ্য ক্ষুণ্ণ করছেন? তাদের প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ থাকবে, তারা যেন ভেজাল-লেখক মুক্ত মিডিয়া উপহার দেন, পাঠকদের প্রতিনিয়ত প্রতারিত না করেন। -রুমেল খান
×