ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জঙ্গীবাদী যন্তর মন্তর

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ৭ মার্চ ২০১৮

জঙ্গীবাদী যন্তর মন্তর

নোবেল বিজয়ী মিসরীয় লেখক নাগিব মাহফুজ জঙ্গী হামলার শিকার হয়েছিলেন গত শতকের নব্বই দশকে। মৌলবাদী খড়গ্ তার প্রাণ কেড়ে নিতে না পারলেও ডান হাতে আঘাতের কারণে তিনি হারিয়েছিলেন লেখার ক্ষমতা। তার পরবর্তী লেখালেখির কাজ চলেছে অনুলিখনের মাধ্যমে। যে তাকে ছুরিকাঘাত করেছিল ধরা পড়ার পর তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, নাগিব মাহফুজের লেখা পড়েই সে ক্রুদ্ধ ও উত্তেজিত হয়ে আঘাত করেছিল কিনা। সে জানিয়েছে, মাহফুজের কোন লেখাই সে পড়েনি। সে বিষয়ে কোন ধারণাই তার নেই, তার উত্তেজনার কারণ ধর্মীয় নেতাদের অনর্গল বক্তৃতা। ক্রমাগত ওসব শুনেই সে হিংস্র হয়ে উঠেছে, উত্তেজিত ও আঘাত করেছে। মোহাম্মদ জাফর ইকবালের ওপর পুলিশকথিত হামলাকারিও ঠিক একই কথা বলেছে। জাফর ইকবালের কোন লেখা সে পড়েনি। তিনি ধর্মবিরোধী কথা লিখেছেন কিনা তাও তার জানা নেই। যাদের হয়ে এবং যাদেরকে এরা হত্যা করতে চেয়েছিল তাদের মধ্যে গুরুত্বের পার্থক্য বোঝেনি। কারণ এদের ব্রেনওয়াশ হয়ে গিয়েছে জঙ্গীবাদী ‘যন্তর মন্তরে’। এই ব্রেনওয়াশের কাজ নানা রূপে নানা নামে পৃথিবীজুড়ে চলছে। বাংলাদেশেও এর একটি ধারা বহমান রয়েছে। এদেশে মৌলবাদী রাজনৈতিক দল মূল পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে স্বৈরাচারি সামরিক সরকারের সময়। তবে গণতান্ত্রিক সরকারের সময়ও তারা তা পেয়েছে এবং পাচ্ছে। যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর নৃশংস অত্যাচার করেও স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম ঠেকাতে পারেনি অন্য সব রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি তারাও এ দেশে রাজনীতি করার সমানাধিকার পেয়েছে এবং ধীরে ধীরে রাজনীতিতে এর প্রভাব স্পষ্ট হয়েছে। প্রথমে সংবিধান থেকে উধাও হলো ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি। পরের সামরিক সরকার সংবিধানকে আরেকটু ধর্মীয়করণ করে তাদের বিচরণকে আরও স্বচ্ছন্দ করে দিল। পাকিস্তান, সৌদি আরব ও অন্যান্য সহযোগী দেশ থেকে তাদের জন্য অর্থ সাহায্য আসার সোনালি দিগন্ত খুলে গিয়েছিল মূলত সামরিক শাসকদের সময় থেকেই। শুধু সাংগঠনিকভাবে নয়, প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও এরা শক্তিশালী হয়েছে। ব্যাংক, বীমা, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে একদিকে সমাজের মূলস্রোতে মিশে গেছে; অন্যদিকে সন্ত্রাসী কার্যক্রম দিয়ে মাঝে মাঝে ঝলসে উঠে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। সুবিধাভোগী বুদ্ধিজীবী বা সুশীলরা ও নিজেদের সুবিধা বুঝে নিতে ব্যস্ত থেকেছেন। বলা যায়, পরোক্ষে এদের সহযোগিতা করেছেন। একদিকে প্রকাশ্য রাজনীতি করার আইনী অধিকার, অন্যদিকে সামাজিকভাবে মিশে যাওয়ার সাংস্কৃতিক অভিঘাতের মধ্যে বেড়ে উঠেছে গোটা একটি প্রজন্ম; পরিণত হয়েছে। এদের অনেকে ইসলামী ভাবধারা বা জিহাদের প্রতি সহানুভূতিশীল শুধু ধর্মীয় দুর্বলতার কারণে। একই কারণে টুপি-দাড়ি ও হিজাবের আধিপত্য বেড়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে ইসলামী জঙ্গীবাদের উত্থান এর পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে। আশির দশকে তৃতীয় বিশ্বে সামরিকতন্ত্রের যে উত্থান হয়েছিল তা ছিল দুর্বল দেশগুলোকে গিনিপিগ বানিয়ে সা¤্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্য পূরণের অন্য এক কৌশল। একই উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিকভাবে ধর্মীয় মৌলবাদী জঙ্গীগোষ্ঠীকে পরিপোষণ করা হয়েছে। ইসলামের শান্তি, সাম্য ও প্রগতিশীলতার ধারাকে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। এ উপমহাদেশে একে গতিশীল করেছেন উত্তর ভারতের রায়বেরেলির সৈয়দ আহমদ নামে এক মৌলবাদী নেতা। উনিশ শতকের শুরুর দিকে তার আবির্ভাব। তিনি ইসলামী রাজত্ব পুনর্প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যে পথে এগোচ্ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের সে সময়ের বাস্তবতায় তা যে অসম্ভব তা অল্প দিনেই বুঝেছিলেন। তার আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িকতার মধ্যেই পথ খুঁজেছে। ধর্মীয় আন্দোলন সম্পর্কে আধুনিক উপলব্ধি নিয়ে উত্তর ভারত থেকেই এসেছিলেন আরেকজনÑ সৈয়দ আহমদ খান। আর পশ্চিম বাংলা থেকে সৈয়দ আমির আলী। ইংরেজী শিক্ষিত এ দুই নেতা সংস্কারমুক্ত মন নিয়ে উদার যুক্তিবাদী চিন্তা দিয়ে ইসলামের ব্যাখ্যা করেছেন। আমির আলী মুক্ত মন নিয়ে কোরান পাঠ করার কথা বলেছেন, তার মূল বক্তব্য ছিল জ্ঞানের চর্চা ছাড়া কোন সংস্কার সম্ভব নয়। মানুষের মনকে শৃঙ্খল মুক্ত করতে হলে সেখানে জ্ঞানের আলো প্রবেশ করাতে হবে। সৈয়দ আমির আলী মাদ্রাসা শিক্ষার বিরোধী ছিলেন। মনে করতেন এ ব্যবস্থা একেবারেই পশ্চাৎমুখী এবং মনকে আলোকিত করতে অক্ষম। তিনি মাদ্রাসা তুলে দিয়ে ইংরেজী ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পক্ষপাতি ছিলেন। সৈয়দ আহমদ খান, সৈয়দ আমির আলীর পথ ধরে এসেছিলেন আরও কয়েকজন উদার ও মুক্তবুদ্ধির ইসলামী চিন্তাবিদ। কিন্তু ইসলামের উদার ধারার বদলে সারা পৃথিবীতে এখন রাজত্ব করছে উগ্র ধর্মীয় জঙ্গীবাদ যা ইসলামের সমন্বয়ধর্মী ও মানবতাবাদী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে প্রায় ভুলিয়ে দিয়েছে। সাত চল্লিশে ভারত ভাগের পর সে সময়ে বিশ্বের দুই পরাশক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এ অঞ্চলের রাজনীতিতেও মেরুকরণ হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন যাতে প্রভাব বিস্তার করতে না পারে যুক্তরাষ্ট্র সে জন্য পূর্ব পরিকল্পিতভাবেই পাকিস্তানের ইসলামী সামরিক সরকারকে সমর্থন দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে স্বাধীনতাবিরোধীদের সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু সব বিরোধিতা উপেক্ষা করে ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ নিয়ে এদেশ স্বাধীন হয়। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদকে ভিত্তি করে সংবিধান রচিত হয়। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই এদেশ প্রতিষ্ঠার যারা বিরোধিতা করেছিল নানা কূটকৌশলে তারাই শাসন ক্ষমতার অংশীদার হয়। ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদ শেকড় গাড়তে থাকে। রগকাটা, কুপিয়ে মারার সংস্কৃতি বিস্তার লাভ করে। কখনওই কি নির্মূল হয়েছিল এরা? রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায়ই টিকে থাকে। রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই মাথাচাড়া দেয়।
×