ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ ও টোকেন অনুদান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী

‘এরা তো ধর্মান্ধ হয়ে গেছে,’ জাফর ইকবাল হত্যাচেষ্টা সম্পর্কে হাসিনা

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ৫ মার্চ ২০১৮

‘এরা তো ধর্মান্ধ হয়ে গেছে,’ জাফর ইকবাল হত্যাচেষ্টা সম্পর্কে হাসিনা

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লেখক-অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলার প্রেক্ষাপটে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, বাংলাদেশে কোন ধরনের সন্ত্রাস বা জঙ্গীবাদী কর্মকা- চলতে দেয়া হবে না। এ বিষয়ে তার সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। যারা এ ঘটনাগুলো ঘটায়, এরাতো ধর্মান্ধ হয়ে গেছে। তারা মনে করে একটা মানুষ খুন করলেই বুঝি তারা বেহেশতে চলে যাবে। তারা কোনদিন বেহেশতে যাবে না, তারা দোজখের আগুনে পুড়বে। কারণ নিরীহ মানুষকে হত্যা করে কেউ বেহেশতে যেতে পারে না। রবিবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় আয়োজিত বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ (এনএসটি) এবং গবেষণা অনুদান প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী কথা বলেন, শনিবার একটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে। বিশিষ্ট লেখক অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল একটা অনুষ্ঠানে বসে ছিলেন, সেখানে তাকে ছুরি মারা হয়েছে। হামলাকারী কারা এটা হামলার ধরন থেকেই স্পষ্ট হয়ে গেছে। যারা এই ঘটনাগুলো ঘটায় তারা তো ধর্মান্ধ। সন্তানদের অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে মুক্ত রাখতে এবং এ বিষয়ে তাদের সচেতন করে গড়ে তুলতে অভিভাবক-শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডাঃ আফম রুহুল হক, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ আনোয়ার হোসেন প্রমুখ। অনুষ্ঠানে ১১৬ জনকে বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ, ২ হাজার ৩৫৮ জনকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ (এনএসটি) এবং ১৪১টি প্রকল্পকে গবেষণা অনুদান প্রদান করা হয়। প্রধানমন্ত্রী টোকেন হিসেবে ২০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হাতে ফেলোশিপ ও অনুদানের চেক তুলে দেন। অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য, আমন্ত্রিত অতিথি, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং ফেলোশিপপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, হামলার খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি এয়ারফোর্সের হেলিকপ্টার পাঠিয়ে তাকে (অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল) ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) এ নিয়ে আসেন উন্নত চিকিৎসার জন্য। জাফর ইকবালের অবস্থা এখন অনেকটাই স্টেবল, ভাল। তিনি বলেন, যারা এই ঘটনাগুলো ঘটায় তারা মনে করে একটা মানুষ খুন করলেই বুঝি তারা বেহেশতে চলে যাবে। এ ধরনের কথা মনে করা মানে অন্ধত্বে ভোগা। তারা এই অন্ধত্বে ভুগছে কেন? যদিও আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই বাংলাদেশে কোন রকম সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ আমরা চলতে দেব না। মাদকের বিরুদ্ধেও আমরা অভিযান চালাচ্ছি। এ ব্যাপারে দেশবাসীকে সজাগ ও সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের শিক্ষক, অভিভাবক, মসজিদের ইমাম থেকে শুরু করে অন্যান্য ধর্মের প্রত্যেককে যেখানেই যাচ্ছি সেখানেই সকলের প্রতি আমি জঙ্গীবাদ বিরোধী হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। এমনকি আমি যেসব পাবলিক মিটিং করি সেখানেও আমি আহ্বান জানাই, মাদক, সন্ত্রাস এবং জঙ্গীবাদ থেকে সকলে মিলে ছেলে-মেয়েকে মুক্ত রাখতে হবে এবং এজন্য যা যা করণীয় সবাইকে তাই করতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার দেশকে জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাস ও মাদক মুক্ত করতে চায়। এ জন্য প্রত্যেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, কি করছে তার প্রতি অভিভাবকদের লক্ষ্য রাখতে হবে। ছেলে-মেয়েদের যেন বাবা-মায়ের সঙ্গে একটা ভাল সম্পর্ক হয়, বাবা-মাকে সন্তানরা মনের কথা খুলে বলতে পারে পরস্পরের মধ্যে সে ধরনের একটা মানসিক যোগাযোগ থাকা প্রয়োজন। তিনি বলেন, ছেলে-মেয়েরা বড় হওয়ার সময় একেক বয়সে তাদের একেক রকম মানসিক বৃদ্ধি ঘটে। সেই বিষয়টির প্রতিও বাবা-মাকে নজর দেয়ার, বাবা-মা’কে আরও সহনশীল হওয়ার এবং ছেলে-মেয়েরা যেন বিপথে না যায় তার প্রতি লক্ষ্য রাখার জন্যও প্রধানমন্ত্রী বাবা-মা, অভিভাবক, শিক্ষকদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমাদের এত মেধাবী ছেলে-মেয়ে তারা যেন কেউ বিপথে না যায় সেটাই আমরা চাই। কারণ দেশকে আমাদের সেভাবে গড়ে তুলতে হবে। আমরা আর পিছিয়ে যাব না। সামনের দিকে এগোবো এবং বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলব। বাংলাদেশের বিপুল সমুদ্র সম্পদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে বিজ্ঞানী ও গবেষকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, দেশে বিপুল সমুদ্র সম্পদ রয়েছে। ব্লু-ইকোনমির এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। এ জন্য বিজ্ঞানী ও গবেষকদের নতুন নতুন গবেষণা এবং উদ্ভাবনে কাজ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সমুদ্র সম্পদ রক্ষায় পদক্ষেপ নিয়েছি। যা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজে লাগবে। চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমুদ্র বিজ্ঞান বিষয়ে পাঠদান করা হচ্ছে। কক্সবাজারে সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা সমুদ্রপাড়ে একটি সি-এ্যাকুরিয়াম গড়ে তুলব। এটি গবেষণায় যেমন প্রয়োজন, তেমনি পর্যটক আকর্ষণেও ভূমিকা রাখবে। তিনি গবেষণার জন্য সরকারের জাহাজ ক্রয়সহ বিভিন্ন উদ্যোগের তথ্য এ সময় তুলে ধরেন। গবেষণায় সরকারের নানা পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে সরকার প্রধান বলেন, আমাদের পাট তো ধ্বংস করেই দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেখান থেকে পাটকে আমরা বহুমুখী করার চেষ্টা করছি। গবেষণা করে পাটের জিনোম উদ্ভাবন করা হয়েছে। ধানেরও গবেষণা করা হচ্ছে। বস্ত্রের উন্নয়নে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বিভিন্ন ইনস্টিটিউট গঠন করা হয়েছে, যারা এসব ক্ষেত্রের উন্নয়নে কাজ করছে। তিনি বলেন, আমাদের পরমাণু কমিশন রয়েছে, যা জাতির পিতা করে দিয়ে গিয়েছিলেন। বর্তমানে আমরা পরমাণু বিদ্যুত কেন্দ্র গড়ছি। এজন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লোকবল দরকার। সেভাবে ট্রেনিংও দেয়া হবে। পরমাণু বিদ্যুত কেন্দ্রের নিরাপত্তার জন্য বিজ্ঞানী ও গবেষক দরকার। কয়েকটা ধাপে এর নিরাপত্তা থাকবে। আমরা সেভাবেই পদক্ষেপ নিয়েছি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। আমরা সমুদ্রের তলদেশে (নেভির সাবমেরিন) গিয়েছি, স্যাটেলাইটও উৎক্ষেপণ হবে। অচিরেই যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোতে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হবে। বিজ্ঞানমনস্ক জাতি গঠনের কথা বিবেচনায় নিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মরণে ‘বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ অন সাইন্স এ্যান্ড আইসিটি’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারই ধারাবাহিকতায় আমরা গঠন করেছি ‘বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ ট্রাস্ট’। জাতীয় পর্যায়ে দক্ষ ও বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ ও গবেষক তৈরিই এ ট্রাস্টের উদ্দেশ। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ ছাড়াও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে এমফিল, পিএইচডি ও পিএইচডি-উত্তর পর্যায়ে ছাত্রছাত্রী ও গবেষকগণের মধ্যে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ প্রদান করা হচ্ছে। তার সরকার দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যাপক প্রয়োগ নিশ্চিত করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০২১ সালের আগেই ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার সব উদ্যোগ সম্পন্ন করেছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের বিজ্ঞানীরা জীব-প্রযুক্তি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে লবণসহিষ্ণু এবং খরা-সহনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে এটি আমাদের মাইলফলক অগ্রগতি। বিজ্ঞানীরা ধানের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে পরিবেশবান্ধব জীবাণু-সার উদ্ভাবন করেছেন। হিউম্যান ডিএনএ প্রোফাইলিং সুবিধা সৃষ্টি সম্ভব হয়েছে। বস্ত্র, চামড়া ও ডিটারজেন্ট শিল্পে ব্যবহারের জন্য এনজাইম তৈরি সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, আগামী দিনে আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। প্রযুক্তিনির্ভর, জ্ঞানভিত্তিক, দারিদ্র্যমুক্ত, মধ্যম আয়ের বাংলাদেশ গড়ার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবায়নে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণের অংশ বিশেষ তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘ঊনিশ শ’ একাত্তর সালের ডিসেম্বর মাসের ১৬ তারিখে আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা সংগ্রামের সমাপ্তি এবং অর্থনৈতিক মুক্তিযুদ্ধের শুরু। এই যুদ্ধে এক মরণপণ সংগ্রাম আমরা শুরু করেছি। এই সংগ্রাম অনেক সময়সাপেক্ষ ও কষ্টসাধ্য। তবে আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ থেকে কঠোর পরিশ্রম করি এবং সৎ পথে থাকি তবে, ইনশাল্লাহ জয় আমাদের অনিবার্য। উল্লেখ্য, গত ২০০৯-১০ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত ৮ হাজার ১২ ছাত্রছাত্রী ও গবেষকের মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে ৪৯ কোটি ৪৫ লাখ ৬ হাজার টাকা ফেলোশিপ প্রদান করা হয়। বর্তমান ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ফেলোশিপ প্রদানের লক্ষ্যে ১৪ কোটি ৭৬ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে গবেষণা অনুদানের জন্য ১৪ কোটি ৪০ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
×