ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

১০০ দিনে কাটা যাবে হেক্টরে ৩ টনের বেশি উৎপাদন হবে

আঁশ হবে সুতোর মতো ॥ আঁশ হবে সুতোর মতো

প্রকাশিত: ০৫:০৪, ৫ মার্চ ২০১৮

আঁশ হবে সুতোর মতো ॥ আঁশ হবে সুতোর মতো

কাওসার রহমান ॥ সোনালি আঁশের খ্যাতি অর্জনে বড় অগ্রগতি হয়েছে পাটের। টানা চার বছর পরিশ্রম করে দেশের বিজ্ঞানীরা জন্মরহস্যের (জেনম) তথ্য দিয়ে পাটের নতুন বীজ উদ্ভাবন করেছেন। বাংলাদেশ জুট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (বিজেআরআই) মাঠে ট্রায়ালের পর আগামী পাট মৌসুমেই সেই বীজ কৃষকের আবাদের জন্য মাঠে যাচ্ছে। রবি-১ নামের ওই জাত আবাদ করে কৃষক ১০০ দিনের মধ্যেই তার পাট কাটতে পারবে। ফলন পাওয়া যাবে প্রতি হেক্টরে তিন টনেরও বেশ। এই জাতের পাট সুতা হবে অনেক সূক্ষ্ম। এই আঁশ অনেকটাই তুলার কাছাকাছি, যা দিয়ে উন্নত মানের কাপড় তৈরি করা সম্ভব হবে। বিজ্ঞানীরা জানান, জেনমের তথ্য ব্যবহার করে দেশী ও তোষা জাতের বীজ থেকে তারা চারটি জাত উদ্ভাবন তথা অগ্রবর্তী সারি উন্নয়ন করতে সক্ষম হয়েছেন। এগুলো হলো- রবি-১ ও রবি-২ এবং শশী-১ ও শশী-২। এর মধ্যে রবি-১ থেকে ভাল ফল পাওয়া গেছে। এই পাটের আঁশ দেখতে অনেকটাই সুতার মতো। যার লিগাসিন বিদ্যমান পাটের চেয়ে অনেক কম এবং দৈর্ঘ্য (লেনথ) অনেক বেশি। যা তুলার অনেকটাই কাছাকাছি। সরেজমিনে দেখা গেছে, বাংলাদেশের কৃষক সাধারণত বিজেআরআই ০৯৯৭ ও ভারতীয় জাত জিআরও ৫২৪ ব্যবহার করে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে ভারতের জিআরও ৫২৪ জাতটি। কারণ একটি ১০০ দিনে কাটা যায়। অন্যদিকে বিজেআরআই ০৯৯৭ জাতটি কাটতে হয় ১২০ দিন পর। বর্তমানে বাংলাদেশে বিদ্যমান জাতগুলোর গড় ফলন প্রতি হেক্টরে ২.০৪ টন। রবি-১ এর মাঠ পর্যায়ের ট্রায়ালে বিজ্ঞানীরা এর তিনটি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেছেন। এগুলো হলো- এই পাট ১০০ দিনে কাটা যায়। একশ’ দিনে কাটলে সবচেয়ে বেশি ফলন পাওয়া যায়। ফলন আসে হেক্টর প্রতি ৩ টনেরও বেশি। আর এর আঁশ বিজেআরআই কিংবা জিআরও জাতের চেয়ে অনেক উন্নত। নিজস্ব মাঠ পর্যায়ের ট্রায়াল শেষে এখন রবি-১ কৃষক পর্যায়ে ছাড় করার উদ্যোগ নিয়েছে বিজেআরআই। আগামী পাট মৌসুমে কৃষক পর্যায়ে এই বীজ দেয়া হবে আবাদের জন্য। তার আগে জাতীয় বীজ বোর্ডের অনুমোদন নেয়া হবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিজেআরআইয়ের মহাপরিচালক ড. মোঃ মনজুরুল আলম বলেন, ‘জেনমের তথ্য ব্যবহার করে আমরা ৪টি অগ্রবর্তী সারি উন্নয়ন করতে সক্ষম হয়েছি। এর মধ্যে রবি-১ জাতটি আগামী বছর কৃষক পর্যায়ে ছাড় করা হবে। সীমিত পর্যায়ে হলেও আমরা এই বীজ কৃষকদের দেব আবাদের জন্য।’ তিনি বলেন, ‘পাট জেনম আবিষ্কারের পর আমরা বসে নেই। জেনমের তথ্য ব্যবহার করে প্রতিনিয়ত কাজ চলছে। কি করে পাটকে আরও বড় কাজে ব্যবহার করা যায়।’ এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ড. আলম বলেন, ‘পাট থেকে শুধু কাপড় উৎপাদন করেই আমরা বসে থাকতে চাই না, পাট থেকে আমরা কাঠ বানাতে চাই। যে কাঠ ব্যবহার করে আমরা ঘরের আসবাবপত্র তৈরি করতে পারব। তাহলেই আমাদের জেনম আবিষ্কার সার্থক হবে।’ বিজ্ঞানীরা জানান, রবি-১ এর আঁশগুলো উজ্জ্বল সাদা রঙের। এগুলো তোষা বা দেশী সাধারণ মানের পাটের চেয়ে অনেকটাই চিকন। একই সঙ্গে মসৃণও। বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন পাটগাছের আঁশের পরিমাণ বাড়াতে। যদি এটি করা যায় তাহলে অল্প জমিতেই চাহিদামতো বেশি পাট উৎপাদন করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন তারা। এ প্রসঙ্গে ড. আলম বলেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে পাটকে টেক্সটাইলে ব্যবহার করতে হবে। এজন্য পাটকে সুতার সমতুল্য করতে হবে। কিন্তু পাট টুইট করলে ভেঙ্গে যায়, কারণ এর লিগাসিন বেশি। কটন ভাঙ্গে না কারণ এর লিগাসিন কম। আবার কটনের আশের দৈর্ঘ্যও (লেনথ) বেশি। এ দুটোকে সমন্বয় করতে পারলেই আমরা পাটকে কটন হিসাবে ব্যবহার করতে পারব।’ তিনি বলেন, পাটকে টেক্সটাইলে ব্যবহার করতে হলে এর লিগাসিন কমাতে হবে এবং আঁশের দৈর্ঘ্য (লেনথ) বাড়াতে হবে। আমরা জেনম আবিষ্কারের মাধ্যমে জেনে গেছি কোন জিন এগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। চিহ্নিত করেছি, কোন জিন আশ গঠনে জড়িত। এগুলোকে সমন্বয় করেই আমরা নতুন পাট বীজ রবি-১ উদ্ভাবন করেছি।’ আগামীকাল মঙ্গলবার জাতীয় পাট দিবস। এবারের পাট দিবসে উন্নতমানের উচ্চফলনশীল রবি-১ পাট বীজই হবে দেশবাসীকে দেয়া এ সরকারের উপহার। পাট সম্পর্কে দেশবাসীর মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নানা আয়োজনে দ্বিতীয়বারের মতো এবারও পাট দিবস পালিত হবে। এ উপলক্ষে রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়ক পাট ও পাটখড়ি দিয়ে সজ্জিত করা হয়েছে। ছেয়ে গেছে পাটের ব্যানার ফ্যাস্টুন বড় ক্যানভাসে। নতুন প্রজন্ম পরিচিত হচ্ছে পাট ও পাটখড়ির সঙ্গে। বয়স্করা পাটের স্মৃতি রোমন্থন করছেন। সংসদ ভবনের সামনে পাটখড়ির বেড়া দেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তার ছোট বেলার স্মৃতির কথা জানিয়েছেন পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজমকে। পাট দিবসকে সামনে রেখে গত পহেলা মার্চ থেকেই শুরু হয়েছে নানা কর্মসূচী। এসব কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে পাট ও পাটখড়ি দিয়ে রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়ক সজ্জিতকরণ, রোডশো, র‌্যালি, নৌ র‌্যালি, পাটের ক্যানভাসে চিত্রাঙ্কন, পাট নিয়ে কবিদের কবিতা পাঠ, সেমিনার, জাতীয় পাট মেলা ও পাট সংক্রান্ত সকল স্থাপনা তথা মিল কলকারখানা, গুদাম, ক্রয় কেন্দ্র, বহুমুখী পণ্য উৎপাদন কেন্দ্র প্রভৃতিতে সজ্জিতকরণ। এ প্রসঙ্গে পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম জানান, ইতোমধ্যে ঢাকায় পাট র‌্যালি এবং ঢাকা থেকে ফরিদপুর পর্যন্ত এবং ঢাকা থেকে জামালপুর পর্যন্ত রোড শো অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব রোডশোতে শতাধিক গাড়ি গান বাজনা বাজিয়ে পাট সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। জামালপুরে রোড শো শেষ হয়েছে পাট বিষয়ক কনসার্টের মাধ্যমে। গতকাল ঢাকার শিল্পকলায় শিল্পী হাশেম খানের নেতৃত্বে একদল চিত্রশিল্পী পাটের ক্যানভাবে চিত্রাংকন করেছেন। এসব চিত্রাঙ্কন ৬ মার্চ পাট মেলায় প্রদর্শন করা হবে। পাট দিবস উপলক্ষে রবিবার সন্ধ্যায় শিল্পকলায় অনুষ্ঠিত হয় পাট বিষয়ক কবিতা পাঠের আসর। পাট নিয়ে যারা কবিতা লিখেছেন তারা এই আসরে কবিতা পাঠ করেন। এছাড়া সোমবার পাট নিয়ে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। আর মঙ্গলবার পাট দিবসের দিনে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারে শুরু হবে তিন দিনের পাট মেলা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই পাটমেলার উদ্বোধন করবেন। এছাড়া এদিন দেশের সকল জেলা উপজেলায় পাটের সকল স্থাপনা সজ্জিতকরণ করা হবে। আয়োজন করা হবে বিশেষ খাবারের। পঁচাত্তর পরবর্তী গত প্রায় চার দশকে সোনালি আঁশের খ্যাতি হারিয়েছিল আমাদের পাট। দুর্দিন জেঁকে বসেছিল এক সময়ে অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি এই শিল্প খাতে। তবে সেই দিন কাটিয়ে আবারও সোনালি আঁশের সেই সোনালি দিন ফিরিয়ে আনতে চায় সরকার। এরই মধ্যে পাটের উৎপাদনে এসেছে গতি। পাটজাতীয় পণ্যের উৎপাদনও বাড়ছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে। পাট থেকে পচনশীল পলিথিন ও ভিসকসের মতো বৈচিত্র্যময় পণ্য উৎপাদনে সরকার দিয়েছে বিশেষ নজর। ফলে পাট নিয়ে দেশে আবার গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। যা বাংলাদেশের সমৃদ্ধশালী অর্থনীতির-ই বার্তা দিচ্ছে। ২০১৩ সালে দেশীয় ও তোষা পাটের জন্মরহস্য (টোটাল জিনোম) আবিষ্কারের পর থেকেই আবারও ইতিবাচক আলোচনায় আসে পাট। তৈরি হয় পাটের নতুন সম্ভাবনা। সেই জেনমের তথ্য ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা কটনের মতো সূক্ষ্ম সুতার মতো আশ তৈরির পাট বীজ উদ্ভাবনের প্রচেষ্ঠা চালান। সেই প্রচেষ্টারই সফল রূপ রবি-১ পাট বীজ। যা দিয়ে কটনের চেয়েও উন্নত মানের সুতা তৈরি সম্ভব বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন। জেনম আবিষ্কারের পর পরই সরকার সিদ্ধান্ত নেয় বিভিন্ন পণ্যের মোড়া হিসেবে বাধ্যতামূলক পাটের ব্যাগ ব্যবহারের। ২০১৫ সালে ১৭ ডিসেম্বর পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন ২০১০ বাস্তবায়নে যে কোন পরিমাণ ধান, চাল, গম, ভুট্টা, সার ও চিনি সংরক্ষণ ও পরিবহনে বাধ্যতামূলকভাবে পাটের ব্যাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে সরকারী নির্দেশনা জারি করা হয়। শুধু তাই নয়, এই ছয়টি পণ্যে পাটের ব্যাগ ব্যবহারে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা শুরু হলে ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয় এসব পণ্যে পাটের ব্যাগ ব্যবহার। আর এতেই পাটের চিত্র পাল্টে যায়। বাড়তে থাকে পাটের ব্যাগের চাহিদা। পরবর্তীতে ওই ছয় পণ্যের সঙ্গে আরও ১১ পণ্য অর্থাৎ পেঁয়াজ, আদা, রসুন, ডাল, আলু, আটা, ময়দা, মরিচ, হলুদ, ধনিয়া এবং তুষ-খুদ-কুড়ার মোড়ক হিসেবে পাটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। সবমিলিয়ে এখন ১৭ পণ্যে পাটের মোড়াক ব্যবহার বাধ্যতামূলক। কোন প্রতিষ্ঠান এই আইন না মানলে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদন্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দ-ের বিধান রয়েছে। দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে শাস্তি সর্বোচ্চ দন্ডের দ্বিগুণ হবে। মূলত এই আইন বাস্তবায়নের কারণেই দেশে পাটের চাহিদা বেড়ে যায়। পাটের চাহিদা বৃদ্ধির করণে কৃষক এখন তার উৎপাদিত পাটের ভাল দাম পাচ্ছে। যে কারণে কৃষক আবার পাট চাষে ঝুঁকছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ২০১৭ সালে রেকর্ড পরিমাণ জমিতে অর্থাৎ আট দশমিক ১৭ লাখ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে। অথচ ২০১৫ সালে মোট পাট চাষ হয়েছিল ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৬৭৮ হেক্টর জমিতে। আশা করা হচ্ছে, এবার রেকর্ড পরিমাণ অর্থাৎ ৯১ দশমিক ৭২ লাখ বেল পাট উৎপাদিত হবে। অথচ ২০১৫ সালে মোট পাট উৎপাদন হয়েছিল ৭৫ লাখ ৫৮ হাজার ৯৩৪ বেল। পাট থেকে ১৩৩ পণ্য ॥ পাটজাত পণ্য গবেষণার ফলে নিত্যদিন নানা চমক আসছে। পাট থেকে সেই প্রথাগত কার্পেট, চট ও সুতার বাইরে এখন নানান ধরনের বাহারি পণ্য তৈরি হচ্ছে। জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন কাউন্সিল (জেডিপিসি) সূত্রে জানা গেছে, আমাদের উদ্যোক্তারা এখন পর্যন্ত ১৩৩ প্রকার পাটপণ্য উৎপাদন করেছেন। এগুলো অনেক সুন্দর ও পরিবেশবান্ধব। এসব পণ্য ইউরোপ ও আমেরিকায় বাজারজাত হচ্ছে। এমনও উদ্যোক্তা আছেন, যাঁরা ১০০ ভাগ উৎপাদিত পণ্যই ইউরোপে রফতানি করেছেন। অথচ আমরা নিজেরাই অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার করছি না। অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশের বস্ত্র কারখানাগুলোয় এখন তুলার সঙ্গে পাট মিশিয়ে সুতা তৈরি করা হচ্ছে। সেগুলো দিয়ে তৈরি হচ্ছে কাপড়। এসব পোশাক বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। উদ্যোক্তারা জানান, গত ১৫ বছর ধরে বিশ্বে পরিবেশবান্ধব (গ্রিন) পন্যের চাহিদা বাড়ছে। প্রতিবছর ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে এই চাহিদা। স্বাধীনতার পর থেকে আমরা মোড়কসহ মাত্র কয়েকটি পণ্য উৎপাদন করে আসলেও বিশ্ববাজারে ওয়াল কাভারিং, হোম টেক্সটাইল, হাউসহোল্ড প্রোডাক্টস, লাইফস্টাইল, ফুটওয়্যার ইত্যাদি বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা রয়েছে। তবে আমাদের সীমাবদ্ধতা হলো, এ ধরনের পণ্য আমাদের নেই, তাই এ বাজারে প্রবেশ করতে পারছি না। কিন্তু নব্বইয়ের দশক থেকে ভারতে প্রচলিত পণ্যের পাশাপাশি এসব পণ্য তৈরির জন্য তাদের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ সহযোগিতা পেয়ে আসছে। ফলে ভারত বহুমুখী পণ্য উৎপাদনে আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে। বর্তমানে সারা বিশ্বে শুধু ৫০০ বিলিয়ন বাজারের ব্যাগেরই চাহিদা রয়েছে। এর মাত্র কয়েক শতাংশও যদি আমরা সরবরাহ করতে পারি, তাহলে কয়েক বিলিয়ন ডলার আয় করতে পারি। তবে আশার কথা হলো, বর্তমান সরকারের আমলে পাটপণ্যের বৈচিত্র্যকরণের ক্ষেত্রে অনেক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এ খাতে গবেষণা বাড়ানো, নতুন পাটনীতি প্রণয়ন, জুটমিল কর্পোরেশনকে সংস্কারের আওতায় আনা, পাট পণ্যের ব্যবহার উদ্বুদ্ধ করতে পলিথিনের ওপর ইকো টক্স আরোপ ইত্যাদি উদ্যোগ নিয়ে সরকার কাজ করছে। পাটজাত পণ্যের ব্যবহার দেশে বাড়ানোর পাশাপাশি এসব পণ্য বিদেশে রফতানির দিকেও মনোযোগ রয়েছে সরকারের। এর মাধ্যমে এ খাতের বিশাল বাজার তৈরি করে কর্মসংস্থান বাড়াতে চায় সরকার। এক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত মাত্রায় সাফল্য অর্জন করতে হলে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিতে হবে। পাট থেকে পলিব্যাগ ॥ দেশে উৎপাদিত পাট দিয়ে বছরে ১৬০ বিলিয়ন মেট্রিক টন পচনশীল পাট পলিব্যাগ উৎপাদন করা সম্ভব। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের পরমাণু বিজ্ঞানীরা এ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন। এ ব্যাগ তিন মাসের মধ্যে মাটিতে মিশে যাবে। ১৬০ বিলিয়ন মেট্রিক টন পচনশীল পাট পলিব্যাগ বিশ্বের চাহিদার চার ভাগের এক ভাগ। আর এ বাজারকে ধরতে পাট থেকে পচনশীল পলিমার ব্যাগ উৎপাদনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়। পাটের জন্মরহস্য আবিষ্কারের পর থেকেই পাটকে কীভাবে আরও বড় পরিসরে কাজে লাগানো যায় সে চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ডক্টর মোবাররক হোসেনের নেতৃত্বে বিশ্বে প্রথমবারের মতো দেশীয় বিজ্ঞানীরা উদ্ভাবন করেছেন পাট থেকে পচনশীল পলিব্যাগ। পাট থেকে প্রথমে সুতার মতো সেলুলোজ তৈরি হয়। এরপর তা পর্যায়ক্রমে গুঁড়া করে তরল পদার্থে রূপান্তর করা হয়। সেই তরল দিয়ে তৈরি হবে পলিথিনের ব্যাগের চেয়েও শক্ত পচনশীল পলিব্যাগ। আপাতত দিনে ২ হাজারের মতো তৈরির সক্ষমতা সৃষ্টি হয়েছে। ১৭ বছর আগে এই বিজ্ঞানী-ই গবেষণার মাধ্যমে পাট থেকে ঢেউটিন তৈরি করেছিলেন। ২০০০ সালে দেশে ফিরে এসে অনেক গবেষণা করে প্রায় আট বছর পর জুট টিনের প্যাটার্ন (ঢেউটিন) তৈরি করেন। কিন্তু বেসরকারী উদ্যোক্তার অভাবে তা আর এগোতে পারেনি। পাটের তৈরি ফাইবারগুলোর সেলুলোজ দিয়ে তৈরি করা হয় এই ঢেউটিন। এগুলো অনেক শক্তিশালী হওয়ায় সহজে নষ্ট হয় না। এগুলো স্টিলের চেয়ে ৮ গুণ বেশি শক্ত। এসব লাইফটাইম গ্যারান্টি আছে। কিন্তু বড় কিছু তৈরির ক্ষেত্রে মূল সমস্যা হচ্ছে উদ্যোক্তা। পাটের ঢেউটিন তৈরি করতে গেলে প্রাথমিক অবস্থায় ৪ থেকে ৫ কোটি টাকার প্ল্যান্ট তৈরি করে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করতে হবে। তারপর আস্তে আস্তে এর উৎপাদন বাণিজ্যিকভাবে চলে আসবে। এরপর থেকে আলোর মুখ দেখেনি পাটের তৈরি ঢেউটিন। শুধু ঢেউটিনই নয়, পাটের তৈরি ফাইবার দিয়ে চেয়ার-টেবিলসহ বিভিন্ন আসবাবপত্রও তৈরি করা হয়। আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা কেউ গবেষণামূলক কাজে বিনিয়োগ করতে চায় না। সবাই চায় রেডিমেড বিনিয়োগ করতে। তবে বর্তমান সরকার বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী পাটের বিষয়ে বেশ আগ্রহী। তার উদ্যোগে পাটশিল্প অনেক দূর এগিয়েছে। পাটের তৈরি বিভিন্ন পণ্য তৈরি করছে ছোট ছোট উদ্যোক্তরা। কিন্তু পাট দিয়ে বহুমুখী পণ্য তৈরি করতে হলে সরকারের সহায়তা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। এ প্রসঙ্গে পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম বলেন, ‘পাটের হারানো দিন ফিরিয়ে আনতে পাটকল আধুনিকীকরণেও কাজ করছে সরকার। এরই মধ্যে বিজেএমসির অধীন মিলগুলোর মধ্যে প্রাথমিকভাবে তিনটি পাটকলের আধুনিকায়নে চীনের সরকারী একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি সই হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর দেশে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার ভিসকস আমদানি হয়। তাই দেশে পাটের আঁশ ব্যবহার করে ভিসকস উৎপাদন করতে যাচ্ছি আমরা। এ লক্ষ্যে আমরা একটি কারখানা করতে যাচ্ছি। প্রতি বছর এ কারখানায় ৪০ হাজার টন ভিসকস উৎপাদিত হবে। এতে দেশর বস্ত্র কারখানাগুলো লাভবান হবে।’ মির্জা আজম বলেন, ‘পঁচাত্তর-পরবর্তী সময় থেকে পাট নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র শুরু হয়। ওই ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দেশের পাট খাতকে ধ্বংস করা হয়েছে। সবার চেষ্টায় আমরা আবার পাটের হারানো গৌরব আবার ফিরিয়ে আনতে পারব, আশা করছি। সে লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি।’
×