ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

উত্তাল সারাদেশ ॥ জাফর ইকবালকে হত্যাচেষ্টা- নিন্দা, প্রতিবাদ বিক্ষোভ

প্রকাশিত: ০৫:০৩, ৫ মার্চ ২০১৮

উত্তাল সারাদেশ ॥  জাফর ইকবালকে হত্যাচেষ্টা- নিন্দা, প্রতিবাদ  বিক্ষোভ

শংকর কুমার দে ॥ বিশিষ্ট লেখক ও সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টায় তার ওপর হামলার ঘটনায় জঙ্গী সম্পৃক্ততা তদন্ত করছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট (সিটিটিসি), র‌্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা। তার ওপর হামলার ঘটনায় অন্তত তিন থেকে পাঁচজন ছিল বলে তথ্য পেয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা। আল-কায়েদার অনুসারী আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা আনসার আল ইসলামের (এবিটি) সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন সময়ে তাকে হামলার লক্ষ্যে (টার্গেট) করে অনুসরণ করেছে এবং সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) আনসার আল ইসলামের একটি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে বলে সিটিটিসির দাবি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক টিম তদন্ত শুরু করেছে। এর মধ্যে একটি টিম সিলেটে গিয়ে হামলার সময়ে ঘটনাস্থলে গণপিটুনিতে আহত অবস্থায় আটক হামলাকারী ফয়জুরকে জিজ্ঞাসাবাদের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জাফর ইকবাল এখন আশঙ্কামুক্ত, তবে পুরোপুরি সুস্থ হতে আরও কয়েকদিন সময় নেবে। জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারী ফয়জুর হাসান ওরফে ফয়জুল ওরফে শফিকুর জঙ্গীবাদে বিশ্বাসী বলে র‌্যাবের দাবি। হামলাকারী ফয়জুলের গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার জগদল ইউনিয়নের কালিয়াকাপন গ্রামে অভিযান চালিয়ে ফয়জুলের চাচা আব্দুল কাহারকে এবং সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন কুমারগাঁওয়ের শেখপাড়ায় ফয়জুলের বাসায় অভিযান চালিয়ে তার মামা ফজলুর রহমানকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনায় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সিলেটের জালালাবাদ থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে, যা মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলই জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনাকে চক্রান্ত বলে অভিহিত করেছে। ঢাকাসহ সারাদেশে জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভ চলা অব্যাহত আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওসমানী মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, বিশিষ্ট লেখক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনা যারা ঘটিয়েছে তারা ধর্মান্ধ। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে কোন ধরনের সন্ত্রাস বা জঙ্গীবাদী কর্মকা- চলতে দেয়া হবে না, এ বিষয়ে তার সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। অন্য এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, এ হামলার ঘটনায় বিএনপির হাত থাকতে পারে, এটা চক্রান্ত। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, বিশিষ্ট লেখক ও অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনায় জঙ্গী সম্পৃক্ততা থাকার সন্দেহে তদন্ত করছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। হামলার ধরন দেখে প্রাথমিকভাবে জঙ্গী হামলা হতে পারে বলে সন্দেহ করছেন সিটিটিসির কর্মকর্তারা। সিটিটিসির একটি টিম সিলেট গিয়ে আটক হামলাকারী ফয়জুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন তারা। জাফর ইকবাল দীর্ঘদিন ধরেই জঙ্গীদের লক্ষ্যে (টার্গেটেড) ছিলেন, যা বিশেষ করে আল-কায়েদার অনুসারী আনসরুল্লাহ বাংলা টিম বা আনসার আল ইসলামের সদস্যরা বিভিন্ন সময়ে তাকে হামলার জন্য অনুসরণ করেছে বলে সিটিটিসির কর্মকর্তাদের দাবি। সিটিটিসির এক কর্মকর্তা বলেন, ব্লগার, প্রগতিশীল লেখক, প্রকাশক খুনের ধরনের সঙ্গে জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টার জন্য হামলার ঘটনার সঙ্গে সাদৃশ্য আছে যা এ হামলার সঙ্গে জঙ্গী সম্পৃক্ততা থাকতে পারে বলে মনে করছেন তারা। হামলাকারী ফয়জুলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা গেলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে বলে জানান ওই কর্মকর্তা। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) আনসার আল ইসলামের একটি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে বলে সিটিটিসির দাবি। বিভিন্ন সময়ে শাবিপ্রবির একাধিক শিক্ষার্থীকে জঙ্গী কার্যক্রমে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতারও করা হয়েছে। হামলার ধরনেও মনে হচ্ছে, এ ঘটনার সঙ্গে আনসার আল ইসলাম জড়িত থাকতে পারে। এবিটির হামলার ধরন ॥ তদন্ত সংশ্লিষ্ট সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা বলেন, আনসার আল ইসলামের (এবিটি) সদস্যরা হামলার সময় মাথায় আঘাত করে বেশি। ছুরিকাঘাত বা দা দিয়ে কুপিয়ে আঘাত করাটা তাদের কৌশল। আনসার আল ইসলামের আসকারি বিভাগের সদস্যদের হামলার ধরন নিয়ে প্রশিক্ষণও দেয়া হয়। আনসার আল ইসলামের সদস্যরা সবসময়ই ছুরি বা চাপাতি দিয়ে হামলা করে। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে হামলায় তাদের নজির নেই। ছুরি বা চাপাতি দিয়ে হামলাকে তারা ‘কতল’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। জাফর ইকবালের ওপর হামলার ধরনের সঙ্গে আনসার আল ইসলামের হামলার মিল থাকলেও এখনও নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। শীঘ্রই বিষয়টি পরিষ্কার হবে বলে জানান ওই কর্মকর্তা। এ জঙ্গী সংগঠনটির আসকারি বিভাগের সদস্যরা সরাসরি হামলায় অংশ নিয়ে থাকে। ইন্টারনেটে বা সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করা জঙ্গী হামলার হুমকিপ্রাপ্ত ব্যক্তির তালিকা এবং বিভিন্ন সময় গ্রেফতার হওয়া আনসার আল ইসলামের সদস্যদের কাছ থেকে এমন কিছু নথিপত্র তারা উদ্ধার করেছেন, যাতে অন্তত ৮০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি, লেখক, ব্লগার তথা জঙ্গীদের ভাষায় ইসলামবিরোধীদের নাম রয়েছে। আনসার আল ইসলামের সদস্যরা তাদের নিয়মিত অনুসরণ করত। তারা কখন কোথায় যান এবং কোথায় থাকেন, তার বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেছে। ওই তালিকায় জাফর ইকবালের নামও ছিল বলে জানিয়েছেন ওই কর্মকর্তা। এবিটি এখনও অপ্রতিরোধ্য ॥ জঙ্গী সংগঠনের তদন্তের সঙ্গে একজন কর্মকর্তারা বলছেন, নব্য জেএমবির সদস্যদের কর্মকা- নিয়ন্ত্রণে রাখা গেলেও আনসার আল ইসলাম (এবিটি) ভেতরে ভেতরে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করেছে। নিষিদ্ধ এই সংগঠনের সামরিক কমান্ডার বা সমন্বয়ক সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়া এখনও ধরা পড়েনি। তাকে না ধরা পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। জাফর ইকবালের হামলার ঘটনায় অন্তত তিন থেকে পাঁচ জন অংশ নিয়েছিল বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। হামলার আগে পরিকল্পিতভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হয়। এর ফাঁকেই হামলাকারী জাফর ইকবালের মাথায় চাপাতি দিয়ে আঘাত করে। আনসার আল ইসলামের সদস্যরা জনারণ্যের মধ্যে এরকম হামলাতেও প্রশিক্ষিত। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি লোকসমাগমের মধ্যেই লেখক ব্লগার অভিজিত রায়কে কুপিয়ে হত্যা করে। প্রসঙ্গত: ৩ মার্চ বিকাল ৫টা ৪০ মিনিটে শাবিপ্রবি ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠান চলাকালে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে পেছন থেকে মাথায় ছুরিকাঘাত করে ২৪-২৫ বছর বয়সী এক তরুণ। এরপর তাকে উপস্থিত ছাত্র-জনতা ধরে গণধোলাই দেয়। এতে আহত ওই যুবককে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দেয়া হয়। যুবকের হামলায় আহত অধ্যাপক জাফর ইকবালকে সিলেটের ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এরই মধ্যে সেখানে অস্ত্রোপচার শেষে উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় আনা হয়। এর আগে, তার শারীরিক অবস্থা আশঙ্কামুক্ত বলে জানিয়েছেন সিলেটের ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক ডাঃ দেবপদ রায়। ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পক্ষ থেকেও নিন্দা জানানো হয়েছে। এ ঘটনার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন ‘এ’-এর সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ-মিছিল করেছেন ইলেকট্রিক্যাল এ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা। সন্ধ্যায় রাজধানীর শাহবাগেও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে গণজাগরণ মঞ্চ। প্রেস ব্রিফিংয়ে জাফর ইকবাল আশঙ্কামুক্ত ॥ বর্তমানে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলার শিকার অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল বর্তমানে আশঙ্কামুক্ত। তাকে পুরো সুস্থ হতে তার কয়েক দিন সময় লাগবে। তার মাথা, পিঠ ও হাতে জখমের ক্ষতের চিকিৎসা চলছে। রবিবার এই জনপ্রিয় এই লেখকের শারীরিক অবস্থার চিত্র সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেন সিএমএইচ এর চিকিৎসকরা। সিএমএইচ এর কনসালটেন্ট সার্জন জেনারেল মেজর জেনারেল মুন্সী মোহা. মুজিবুর রহমান বলেন, বর্তমানে তিনি (জাফর ইকবাল) সম্পূর্ণ সজ্ঞান, সচেতন ও আশঙ্কামুক্ত আছেন। তার দ্রুত আরোগ্য এবং সংক্রমণ রোধের জন্য হাসপাতালে দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে আমরা সবার সহযোগিতা চাই। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের স্ত্রী ইয়াসমিন হকও সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। ডাঃ মুজিবুর রহমান বলেছেন, জাফর ইকবালের মাথায় চারটি এবং পিঠ ও বাঁ হাতে একটি করে আঘাতের ক্ষত রয়েছে। তিনি মানসিকভাবে দৃঢ় আছেন এবং পরিস্থিতি বুঝতে পারছেন। আজ সকালে তরল খাবার দেয়া হয়েছে। সম্পূর্ণ সুস্থ হতে তার কয়েক দিন লাগবে। চিকিৎসার জন্য তাকে বিদেশে নেয়ার প্রয়োজন আছে কি না জানতে চাইলে সিএমএইচ এর কনসালটেন্ট সার্জন জেনারেল বলে, আপাতত তেমন সুপারিশ আমরা করছি না। তদন্তের প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখন জাফর ইকবালের সঙ্গে সাক্ষাত করতে পারবে কি না জানতে চাইলে ডাঃ মুজিবুর রহমান বলেন, এখন দেখা না করাই ভাল। জাফর ইকবালের স্ত্রী অধ্যাপক ইয়াসমিন হক, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ডাঃ আবুল কালাম আজাদ, ঢাকা সিএমএইচের কমান্ড্যান্ট ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ মাহবুবুর রহমান, চিফ সার্জন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ মাহবুবুর রহমান, নিউরো সার্জন কর্নেল মু. আমিনুল ইসলাম ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোঃ আমিনুর রহমান এই প্রেস ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন। হামলাকারী ফয়জুর জঙ্গীবাদে বিশ্বাসী ॥ মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারী ফয়জুর হাসান ওরফে ফয়জুল ওরফে শফিকুর জঙ্গীবাদে বিশ্বাসী বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে র‌্যাব। এ কথা জানিয়েছেন সিলেট র‌্যাব-৯ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আলী হায়দার আজাদ। রবিবার দুপুর ৩টায় র‌্যাব-৯ এর সদর দফতরে প্রেস ব্রিফিংয়ে এ কথা জানান তিনি। কর্নেল আলী হায়দার আজাদ বলেছেন, ‘ফয়জুরের কাছ থেকে র‌্যাব বিভিন্ন ধরনের তথ্য পেয়েছে। সেই তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাবের একটি দল কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে র‌্যাব তিন জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এ ধরনের হামলা কেউ একা করতে পারে না। তার সঙ্গে আরও কেউ ছিল না বলে ফয়জুরের কথায় এটা বিশ্বাস হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, ‘ফয়জুর এক সময়ে মাদ্রাসায় দাখিল পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। এরপর সে আর পড়েনি। বিভিন্ন সময়ে সে বিভিন্ন স্থানে কাজ করেছে। তার সঙ্গে আর কারা জড়িত সেগুলো তদন্ত করে দেখছে র‌্যাব। তাকে সিলেট মহানগর পুলিশের জালালাবাদ থানায় হস্তান্তর করা হবে। হামলার ঘটনার মূল বিষয়টি দেখবে পুলিশ। আর পুলিশের পাশাপাশি আলোচিত এ ঘটনার ছায়া তদন্ত করবে র‌্যাব। ফয়জুরের পরিবারের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি ॥ র‌্যাবের প্রেস ব্রিফিং এ জানানো হয়েছে, ফয়জুরের পরিবারের কাউকে এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাদের সন্ধানের জন্য কাজ চলছে। জাফর ইকবালের প্রতি ফয়জুরের দীর্ঘদিনের আক্রোশ ছিল। তিনি নাকি ইসলামের শত্রু। সেই আক্রোশের জের ধরেই তার ওপর হামলা চালায় ফয়জুর। কুমারগাঁওয়ের শেখপাড়ার বাড়ি থেকে র‌্যাব বিভিন্ন ধরনের ইসলামী বই ও বেশকিছু আলামত সংগ্রহ করেছে। সেগুলো র‌্যাবের অপর একটি দল খতিয়ে দেখছে। ফয়জুর সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই থানার কালিয়াকাপন গ্রামের বাসিন্দা সদর উপজেলার টুকেরবাজেরর মাদ্রাসা শিক্ষক হাফিজ আতিকুর রহমানের ছেলে। স্ত্রী ইয়াসমিন হক বলেন ॥ ফেসবুকে এক বার্তায় ইয়াসমিন হক বলেন, জাফর ইকবাল তার শিক্ষার্থীদের শান্ত থাকতে বলেছেন, তিনি ভাল আছেন। তিনি বলেন, আমি আমাদের সব ছাত্রদের বলছি, জাফর ইকবাল আমাকে নিজে বলেছে, তাকে আনা হয়েছে সিএমএইচে, সে একদম ভাল আছে, সুস্থ আছে। সে বলেছে সব ছাত্রছাত্রীকে জানাতে, তোমরা উত্তেজিত হয়ো না। আর চিন্তার কোন বিষয় নেই। ওকে জাস্ট এখানে রাখা হয়েছে অবজারভেশনে। তোমরা সব দোয়া কর। আর ইনশা আল্লাহ, খুব তাড়াতাড়ি ক্যাম্পাসে ফিরে আসব। স্ত্রী ইয়াসমিন হকের পাশে দাঁড়ানো উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমদ বলেন, উনি এখন অনেক ভাল আছেন, আমরা সবাই দোয়া করব উনার জন্য, যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসেন। কেউ যেন এটা নিয়ে কোনভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করে, সবাইকে উনি অনুরোধ জানিয়েছেন। আমরা সবাই আশা করি, উনাকে যারা ভালবাসি, উনার কথাটা শুনব। উনার কথাটা শুনে উনার জন্য দোয়া করব। স্বামীর কাছ থেকেই খবর পাই ॥ অধ্যাপক ইয়াসমিন রবিবার ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে সাংবাদিকদের বলেন, হামলার শিকার হওয়ার কথা স্বামীর কাছ থেকেই প্রথম জানতে পারেন। তিনি বলেন, সাড়ে ৫টা পৌনে ৬টার দিকে আমাকে ফোন করেছে যে, ‘আমার ওপর একটা হামলা হয়েছে। আমি সুস্থ আছি, এখন হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে। আমি চাই না, তোমরা টিভি দেখে খবর পাও, এজন্য আমি তোমাকে বলছি। ব্লিডিং হচ্ছে, আমি যদি পরে কথা বলতে না পারি আমি ফাইন আছি। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে মুহম্মদ জাফর ইকবালের স্ত্রী ইয়াসমিন হক। তিনি বলেছেন, তিনি (প্রধানমন্ত্রী) এখানটায় নিয়ে আসার জন্য এ্যারেঞ্জ করেছেন। তিনি নিজে উদ্যোগী হয়ে কাজ করেছেন। আমি শুনেছি, তিনি নিজে ফোন করে শিক্ষকদের কাছ থেকে খোঁজ নিয়েছেন। ইয়াসমিন হকের বাবাও আর্মি মেডিক্যাল কোরের একজন সিনিয়র ডাক্তার ছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, আমি সেজন্য এখানে কমফোর্ট ফিল করি। জাফর ইকবাল সুস্থ আছেন। তার কেয়ার নেয়া হচ্ছে। দেশের বাইরে পাঠানো হবে কি-না একজন আমার কাছে জানতে চেয়েছে। আমার পুরোপুরি ভরসা আছে এখানকার চিকিৎসায়। ইয়াসমিন বলেন, তার স্বামী মানসিকভাবে দৃঢ় আছেন এবং শীঘ্রই সুস্থ হয়ে তিনি ক্যাম্পাসে ফিরতে পারবেন বলে তারা আশা করছেন। তিনি অঙ্গীকার করে বলেন, হামলা-হুমকিতে দমে না যাবেন না। আমাদের গত দুই বছর না, বছরের পর বছর হুমকি দিচ্ছে, কাফনের কাপড় পাঠাচ্ছে, সব জিনিস বন্ধ করে আমরা কি জেলের ভেতরে থাকব? আমি মনে করি, আমরা আমাদের স্টুডেন্টসদের সঙ্গে ফ্রিলি ইন্টার‌্যাক্ট করব। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলই মনে করে চক্রান্ত ॥ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সিলেটে অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলাকে সাম্প্রদায়িক শক্তির চক্রান্ত। রবিবার সাংবাদিকদের প্রশ্নে ক্ষমতাসীন দলের এই নেতা ওবায়দুল কাদের বলেন, এ হামলা যে একটা চক্রান্ত এটা সত্য। চক্রান্ত তাদের, যাদের বিএনপি পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। কে ঘটনা ঘটিয়েছে, কারা কারা তাকে দিয়ে ঘটনা ঘটিয়েছে এ বিষয়টা ইতোমধ্যে পরিষ্কার। কিএনপির হাত থাকতে পারে। এ কথা, সে কথা বলে বিভ্রান্তি যারা সৃষ্টি করে, তারা আজকে দেশের স্বার্থের পক্ষে কাজ করছে না। তদন্তে ‘নেপথ্যের কালপ্রিটরাও বেরিয়ে আসবে মন্তব্য করে ওবায়দুল কাদের বলেন, এ ব্যাপারে সরকার কোন ছাড় দেবে না। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছেন জানিয়ে কাদের বলেন, এর নেপথ্যে একটা অশুভ শক্তি আছে, এটা আমাদের বিশ্বাস। তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে হবে। এ ব্যাপারে কোন প্রকার গাফলতির সুযোগ নেই। অপরদিকে জাফর ইকবালের ওপর হামলার নিন্দা জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শনিবার তিনি বলেছিলেন, তারাও এ ঘটনাকে একটি চক্রান্ত বলে মনে করছেন। প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ॥ সিলেটে লেখক-অধ্যাপক জাফর ইকবালের ওপর হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল। রাজধানী ঢাকার শাহবাগে বিক্ষোভ করেছে গণজাগরণ মঞ্চসহ কয়েকটি সংগঠন। এ হামলার খবর ছড়িয়ে পড়ার সন্ধ্যা ৭টার দিকে শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে সমবেত হন গণজাগরণ মঞ্চ ও প্রগতিশীল জোটের নেতাকর্মীরা। সচেতন নাগরিক সমাজ ব্যানারে সাংবাদিক-সাহিত্যিকদের একটি দলও প্রতিবাদ জানাতে উপস্থিত হন সেখানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সংগঠন একাত্তরের সদস্যরাও সেখানে জড়ো হন। রাত ৮টার দিকে মশাল নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন তারা। শাহবাগ থেকে মিছিলকারীরা টিএসসির দিকে যান, রাজু ভাস্কর্য ঘুরে আবার শাহবাগে এসে মিছিল শেষ করেন তারা। জাফর ইকবালের ওপর হামলায় ক্ষোভ প্রকাশ করে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার বলেন, তার ওপর এভাবে হামলা হবে আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। শুধু জাফর ইকবালই নন, আমরা কেউই নিরাপদ না। মুক্ত চিন্তাও বাংলাদেশের প্রগতিশীলতার চর্চাকে নস্যাত করতেই এ হামলা করা হয়েছে। কবি আসলাম সানি বলেন, যেভাবে অভিজিত, দীপনদের ওপর হামলা হয়েছে, সেভাবেই জাফর ইকবালের ওপরও হামলা হয়েছে। তারা একাত্তরে বুদ্ধিজীবীদের যেভাবে হত্যা করেছিল এখনও সেভাবে মুক্তবুদ্ধি চর্চাকারী ও বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করতে তাদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। হামলার ঘটনা তদন্তে শাবি কর্তৃপক্ষের কমিটি ॥ শাবি সংবাদদাতা জানান, জনপ্রিয় লেখক ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জাফর ইকবালের ওপর হামলার ঘটনায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। রবিবার সন্ধ্যায় এ কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানান উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। তিনি জানান, কমটিরি প্রধান হলেন, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল গণি এবং অন্য সদস্যরা হলেন রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম ও কম্পিউটার সায়েন্স এ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. শহিদুর রহমান। উপাচার্য বলেন, ড. জাফর ইকবালের হামলা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ও অনাকাক্সিক্ষত। আমরা ক্যাম্পাসে সবার নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য কাজ করছি।
×