ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী

ব্যাংকিং সেক্টরে প্রোপাগা-া বন্ধ হওয়া উচিত

প্রকাশিত: ০৪:০১, ৫ মার্চ ২০১৮

ব্যাংকিং সেক্টরে প্রোপাগা-া বন্ধ হওয়া উচিত

দেশের আর্থিক খাত নিয়ে মিথ্যা প্রোপাগা-া বন্ধ হওয়ার সময় এসেছে। বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় জোড়াতালি দিয়ে অর্ধ সত্যকে সত্য বলে চালানোর প্রয়াস চলছে। বিশেষ করে ব্যাংকিং সেক্টর। আর্থিক এই সেক্টরের সঠিক চালচিত্র তুলে ধরা উচিত। যদিও এই খাতে গত এক দশকে ঋণ খেলাপীর হার হ্রাস পেলেও ঋণের একই প্রবাহ বেড়েছে। সুচতুরভাবে নানা কলা-কৌশল অবলম্বনে বিএনপি-জামায়াতের পাশাপাশি একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী, অর্থনীতিবিদ যেভাবে গেল গেল রব তুলছে প্রকারান্তরে তা দেশ ও জাতি এবং বর্তমান সরকারকে নানামুখী সমস্যার উদ্রেক করছে। এটি কিন্তু দেশের সম্মুুখ যাত্রায় বর্তমান সরকারের যে শুভ প্রয়াস তার সঠিক চিত্র চিত্রায়িত করছে না। বরং ব্যাংকিং সেক্টরে বর্তমান গবর্নরের ভাষায় অযথা ‘প্যানিক’ সৃষ্টি করেছে। সমাজের দায়িত্বশীল অবস্থানে থেকে দায়িত্বশীল পরামর্শ সবার কাম্য। প্রায়ই দেখা যায়, সরকারবিরোধী থাকা আসনে সরকার যখন দেশে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বিস্তৃতি ঘটাতে চাচ্ছে, তখন একটি স্বার্থান্বেষী মহল যেমন তলে তলে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে এ ধরনের চরমপন্থার সঙ্গে সখ্য থেকে যাচ্ছে। গত নয় বছরে ব্যাংকিং সেক্টরের মাধ্যমে যে ব্যাপক আর্থিক লেনদেনের গতিপ্রকৃতি বিধৃত হয়েছে তা প্রশংসনীয়। কেবল বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঋণ নিয়ে সমস্যা থাকে। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য বিশেষ পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়। সরকার যখন দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মকা- পরিচালনা করতে নির্দেশ দিচ্ছে তার অর্থ হচ্ছে মানুষের কল্যাণের ব্যাপ্তি গভীরভাবে সৎ যুক্ত করা। তবে সম্প্রতি জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ নিয়ে যা হয়ে গেল তা বিএনপি-জামায়াত এবং সুবিধাবাদী গোষ্ঠীকে মিথ্য প্রপাগা-া ছড়াতে সাহায্য করেছে। জরুরী ভিত্তিতে অর্থ উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান এবং প্রাক্তন গবর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করতে হবে। বিএনপি-জামায়াত যেখানে ২০০১ সালে শ্রেণীকৃত ঋণের হার ছিল ৩১.৪৯% সেখানে ২০১৭ (সেক্টরে) তা হচ্ছে ১০.৬৭%। ২০০২ সালে শ্রেণীকৃত ঋণের হার ছিল ২৮.১০%, ২০০৩ সালে ২২.১৩%, ২০০৪ সালে ১৭.৩৩%, ২০০৫ সালে ১৩.৫৫%, ২০০৬ সালে ১৩.১৫, ২০০৭ সালে ১৩.২৩%, ২০০৮ সালে ১০.৭৯%, ২০০৯ সালে ৯.২১%, ২০১০ সালে ৭.২৭%, ২০১১ সালে ৬.১২% ২০১২ সালে ১০.০৩%, ২০১৩ সালে ৮.৯৩%, ২০১৪ সালে ৯.৬৯%, ২০১৫ সালে ৮.৭৯%, ২০১৬ সালে ৯.২৩%, ২০১৭ (সেপ্টেম্বর) ১০.৬৭%। উৎস : বাংলাদেশ ব্যাংক। শ্রেণীকৃত ঋণের বিবরণ থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণকালে যে শ্রেণীকৃত ঋণের হার বেশি ছিল তা হ্রাস পেয়েছিল। ব্যাসেল-২ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক শক্তিমত্তার পরিচয় দিয়েছিল। তৎকালীন বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউ রহমান ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধির জন্য নানামুখী প্রয়াস গ্রহণ করেছিলেন। তার এ প্রয়াস দীর্ঘদিন সরকারের রূপরেখা-২০২১ বাস্তবায়নে সহায়তা করছিল। ঋণের ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পাওয়া এবং শ্রেণীকৃত ঋণের হার হ্রাস পাওয়ায় দেশের উন্নয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে চলছিল। তবে পত্রপত্রিকার রিপোর্ট থেকে সেটি প্রতীয়মান হয় যেভাবে ব্যাংকিং, প্রপাগা-া ছড়াচ্ছে তা আসলে যারা ঋণগ্রহীতা তাদের বরং ঋণ ফেরত দেয়ার বদলে ঋণ ফেরত না দিতে উৎসাহী করে তুলেছে। ড. আতিউর রহমান ঋণ অনাদায়ে দক্ষ নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এদিকে ২০০৩ থেকে শ্রেণীকৃতদের সঙ্গে অবলোকনকৃত ঋণের হার হচ্ছে ২৭.৫৬%, ২০০৪ সালে ২৪.৮৭%, ২০০৫ সালে ২১.৫৩% ২০০৬ সালে ২০.৭১%, ২০০৭ সালে ২০.৪৯%, ২০০৮ সালে ১৮.০৪%, ২০০৯ সালে ১৬.০২%, ২০১০ সালে ১৩.৩৪%, ২০১১ সালে ১১.৭৬%, ২০১২ সালে ১৫.৬২%, ২০১৩ সালে ১৫.৬৯%, ২০১৪ সালে ১৬.৮৪%, ২০১৫ সালে ১৫.৮৪%, ২০১৬ সালে ১৫.৮৬%, ২০১৭ (সেপ্টেম্বর) ১৬.৮০% (সূত্র বাংলাদেশ ব্যাংক)। এখন উপরোক্ত তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে বলা চলে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, টকশোতে জানা-অজানা ব্যাংকিং, সেক্টরের বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদরা যেভাবে ব্যাংকিং সেক্টরকে চিত্রায়িত করছে তা বাস্তবতার সঙ্গে মিল নেই। বরং ক্ষমতাতন্ত্রের ভেতরে ঘাপটি মারা একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর সহায়তায় প্রপাগা-া ছড়াচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। নচেত একটি পত্রিকায় যখন দেখলাম যে, একজন প্রাক্তন গবর্নরের আমলে ১১৮% খেলাপী ঋণ বেড়েছে তখন সত্যাটি জানার জন্যই গবেষণা করি। দেখি বাংলাদেশ ব্যাংকের শ্রেণীকৃত ঋণের বিবরণী ঠিক বিপরীত চিত্র দিচ্ছে। আসলে এদেশে আর্থিক খাতের অগ্রগতি নিয়ে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে বরং এক ধরনের অস্বস্তির সৃষ্টি করছে যাতে দেশের উন্নয়নকে বিতর্কিত করা যায়। এই ক্ষেত্রে মিডিয়াও ভূমিকা রাখছে। দুঃখ লাগে শেখ হাসিনা যখন দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন, তখন মিথ্যাচার ও মিথ্যা প্রপাগা-া দ্বারা দেশের ক্ষতির সৃষ্টি হচ্ছে। যার জন্য দেশ ও জাতি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এ অপতৎপরতায় যারা শামিল হচ্ছে তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। যে পত্রিকায় সঠিক তথ্য না জেনে মিথ্যা উপাত্ত দিয়েছে যার সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের শ্রেণীকৃত ঋণের বিবরণীর কোন মিল নেইÑ তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ দেশের ভুল রিপোর্টিংয়ের জন্য যে ধরনের শাস্তি প্রদেয় তা দেয়া বাঞ্ছনীয় হয়ে পড়েছে। নচেত একের পর এক প্রপাগা-া চলতে থাকলে ব্যাংকিং খাতের প্রতি আস্থা হ্রাস পাচ্ছে। আমি একটি হিসাবে দেখেছি সোনালী ব্যাংক ৫১ ধরনের সার্ভিস জনগণকে দিয়ে থাকে অথচ এর জন্য কোনরূপ সার্ভিস চার্জ নেয় না। আজ সোনালী, জনতা, অগ্রণী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির যে কথা সে ঘাটতি পূরণের জন্য ব্যাংকিং সেক্টরে রক্তের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের প্রয়াস গ্রহণ করা দরকার। জানি না কবে বন্ড সংগ্রহ করে ক্যাপিটাল এডুকেসি নিট করা হবে। মাঝখান থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত পাবলিক লিমিটেড ব্যাংকের গতি-প্রকৃতি অনুসারে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসমূহের গঠন ও কাঠামো পুনর্বিন্যস্ত করা দরকার। পাশাপাশি ব্যাংকিং কার্যক্রম অনুযায়ী যে ধরনের লোকবল প্রয়োজন, তা পদায়ন করা জরুরি। একটি সমীক্ষা পরীক্ষা করে দেখেছি যে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং ঋণ আদায়ের জন্য যে ধরনের লোকবল দরকার সে পরিমাণ লোকবল নেই। বরং একটি গ্রুপ ট্রেড ইউনিয়ন করে যাদের অধিকাংশই ব্যাংকিং কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত থাকে না। আসলে ব্যাংকের কাজে সবাইকে সমানভাবে ও দক্ষতার সঙ্গে কার্যক্রম পরিচালনা করার ব্যবস্থা করতে হবে। যারা বড় ধরনের অন্যায় কর্মকা-ে লিপ্ত থাকে সে সমস্ত ব্যাংকারকে অবশ্যই দ্রুত শাস্তির আওতায় আনা দরকার। যারা অসৎ ব্যাংকার আছেন এবং সহযোগী হিসাবে যারা বিভিন্ন পর্যায়ে থেকে তদ্বির করে ব্যাংকিং সেক্টরের সুবিধা লাভ করে থাকে তাদের দেশের প্রচলিত আইন অনুসারে ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যাংকিং সেক্টরে বিভিন্ন কর্মকা-ে জড়িতদের আরও বেশি করে ব্যাংকিং, আইনকানুন জানা দরকার। টেকনোলজি বেজড হয়ে যাওয়ার পর একশ্রেণীর ব্যাংক কর্মকর্তা ইদানীং ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলারসমূহ দেখার সময় পায় না। সুষ্ঠু এ ব্যাপারে একটি গবেষণায় তারা জানিয়েছেন যে, ইদানীং কাজের চাপ যদিও টেকনোলজি বেজড হয়ে গেছে, কিন্তু কারণে-অকারণে যে পরিমাণ স্টেটমেন্ট তৈরি করতে হয়Ñ তাতে সময় হয় না। আর সার্কুলার সঠিকভাবে আত্মসাত করতে না পারার অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক নিয়ম মেনে কাজ করা হয় না। এ ব্যাপারে জোর সুপারিশ থাকবে-ইনক্রিমেন্ট কিংবা প্রমোশনের সময়ে অবশ্যই ব্যাংকিং সংক্রান্ত সার্কুলার সম্পর্কে জানার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত থাকা দরকার। নচেৎ যথাযথ দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করা সম্ভব নয়। এদিকে ঋণঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করার জন্য যে ধরনের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন তা আজ আর তৈরি হচ্ছে না। সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনাকে মানবকল্যাণের পাশাপাশি কার্যক্রম পরিচালনায় দক্ষতা আনতে প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাপনায় আধুনিকতার ছোঁয়া আনতে হবে। অর্থমন্ত্রী স্বয়ং বলেছেন, বর্তমান যুগে দক্ষ ব্যাংকারের অভাব। মন্ত্রীর এ বক্তব্যটি যথার্থ। পাশাপাশি আগের দিনে যে ধরনের দুর্নীতি হতো আজ তার পরিধি ও কলবের বৃদ্ধি পেয়েছে। সে কারণে অর্থমন্ত্রীর ভাষায় যে সমস্ত ব্যাংকার ‘সাগর চুরি’ করে থাকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। ব্যাংকিং সেক্টরে কর্পোরেট গবার্নেন্স প্রতিষ্ঠা করার জন্য উদ্যোগ নেয়া দরকার। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায় যে, ২/৩ বছর আগে ডেপুটি গবর্নর পদে নিয়োগের সময়ে দুর্নীতি দমন কমিশন পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহ এগিয়েছিল। সরকার ইচ্ছে করলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জিএম এবং তদুর্ধ্ব উচ্চপদস্থ নির্বাহীদের ক্ষেত্রে আর্থিক নিয়ম-অনিয়ম সম্পর্কে গোয়েন্দাদের কাছ থেকে রিপোর্ট সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন। ব্যাংকিং সেক্টরে বিশেষত সুইফটের মাধ্যমে অর্থ পাচারের বিষয়টির সঙ্গে দোষীদের প্রকাশ্য আইনের আওতায় আনা দরকার ছিল। বঙ্গবন্ধু যখন ১৯৭২ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন তখন তার মূল উদ্দেশ্য ছিল দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে, মুদ্রানীতি পরিচালনা এবং ব্যাংকিং সেক্টরের মাধ্যমে সঞ্চয় বিনিয়োগের উৎকর্ষ সাধন করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও সমতাভিত্তিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করা। বিভিন্ন সময়ে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় দেশে-বিদেশে ওঠানামা ঘটে থাকে। কিন্তু ব্যাংকিং সেক্টরকে সুচতুরভাবে যারা প্রশ্নবিদ্ধ করে থাকে তারা সত্যিকার আইনানুগ কাজ করছে কি-না তাদের সম্পর্কে জানতে চাওয়া দরকার। নচেত সরকরের ভাবমূর্তি নষ্ট করার মাধ্যমে বিএনপি-জামায়াত ও কুশীল এক শ্রেণী ব্যক্তিবর্গ বেশ জাঁকিয়ে মিথ্যাকে সত্য বলছে। একটি কথা না বললেই নয়, অবলোপনকৃত ঋণ কখনও শ্রেণীকৃত ঋণের সঙ্গে সংযুক্ত করে যারা স্ফীত করে জনমনে প্যানিক সৃষ্টি করছেন, সরকারের অগ্রযাত্রাকে প্রশ্নবৃদ্ধি করার একটি ষড়যন্ত্র ঘটছে বলে প্রতীয়মান হয়। প্রবর্তন গবর্নর মহোদয়ের আমলে ভিশন ২০২১কে বাস্তবায়নে বেশ সক্ষমতা সৃষ্টি তৈরি হয়েছিল। প্রথাগত মুদ্রানীতি আজকাল বিশ্বের অধিকাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পালন করার পাশাপাশি আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে একটি উন্নয়নের স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন। এই অবস্থাটি আর ব্যাপক হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। যে পরিবর্তনের সূচনা দেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে কার্যকর ছিল, তা এগিয়ে নিতে হবে। তবে বিআইডিএসের একটি অনুষ্ঠানে কতিপয় শীর্ষ ব্যাংকার যেভাবে দশ টাকা দিয়ে ব্যাংকের হিসাব খোলার সমালোচনা গত বছর করেছিলেন তাতে মনে হয়, নব্বই সালে আমরা যখন ব্যাংকে ঢুকি তখন ফান্ডামেন্টাল কোর্সে আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার বিষয়টি এসে দাঁড়ায় ইতোমধ্যে অধিকাংশ শীর্ষ স্থানীয় ব্যাংকার তাদের দর্শনে জনকল্যাণের বিষয়টি বাদ দিয়ে মুনাফামুখী করার জন্য ব্যস্ত রয়েছে। তাদের এ প্রয়াস কিন্তু সাংঘর্ষিক। পরিচালনা পর্ষদ কখনও ব্যাংকিং সেক্টরের দৈনন্দিন কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ করার কথা নয়। এ নিয়মটি মেনে চললে, দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় ব্যাংকিং কার্যক্রম আরও গুরুত্ব পাবে। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ব্যাংকারদের নৈতিকতা এবং দক্ষতার সঙ্গে কর্মকা- পরিচালনা করার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। যখন ভাল উদ্যোগের সমালোচনা করা হয়, তখন যার ওপর অর্পিত দায়িত্ব থাকে তিনি সঠিকভাবে কাজ করতে পারেন না। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকে জিএম এবং নির্বাহী পরিচালকদের পর্যায়ে অযথা ফাইল আটকে রেখে কালক্ষেপণ করার ব্যাপারে পত্রিকান্তরে যে রিপোর্ট বেরিয়েছে সেগুলোর সত্যতা যাচাই করে ভাল কাজ যারা করবেন তাদের পুরস্কৃত করা আর যারা বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর কাজ করবেন তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা দরকার। বাংলাদেশে আর্থিক খাতে বৈশ্বিক মন্দার কুপ্রভাব কিন্তু ইমিডিয়েট পাস্ট গবর্নর মহোদয় লাগতে দেননি। কিন্তু তার এ সাফল্যকে তেমন করে প্রশংসাও করা হয়নি। এটি এমন একটি পর্যায়ে উন্নীত করেছিল যে, দেশে ব্যাংকিং সেক্টরে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং ব্যাংকিং খাতের সার্বিক স্থিতিশীলতা অর্জনে সহায়তা দিয়েছিল। এর ফলে বর্তমান সরকারের সাফল্য গাঁথায় অনেক পালকের মধ্যে একটি পালকও যুক্ত হয়েছিল। ব্যাসেল-২ নীতিমালা সফল বাস্তবায়ন ঘটেছিল। তবে ব্যাসেল-৩ অনুসারে কিভাবে মূলধন ঘাটতি মোকাবেলায় রাষ্ট্রায়ত্ত পাবলিক মিলিটেড ব্যাংকসমূহ দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী কাজ করতে পারে, সে জন্য জরুরী ভিত্তিতে কর্মপন্থা তৈরি করতে হবে। বন্ড ছেড়ে প্রতিটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মূলধনের ঘাটতি পূর্ণ করতে হবে। ব্যাংকগুলোতে যে পরিমাণ লোকবলের অভাব রয়েছে তা পূরণ করতে হবে। এদিকে ব্যাংকিং সেক্টরে সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রয়াস গ্রহণ করা হয়েছে। তবে ব্যাংকিং সেক্টরে ইন্টারনাল ও এক্সটানাল স্টেকহোল্ডাররা যাতে সুশাসন প্রক্রিয়া, জবাবদিহিতার পরিচয় দেয় সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত পাবলিক লিমিটেড ব্যাংকসমূহে পরিচালনা পর্ষদে পরিচালক নিয়োগ ও তাদের আচরণ পদ্ধতি ঠিক রাখা দরকার। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিভিন্ন পদে যারা আছেনÑ তারা অনেক সময় নিজেদের জবাবদিহিতার উর্ধে মনে করেন- এদের অধিকাংশ মধ্যম পর্যায়ে। এরা জনকল্যাণ কিংবা সরকারের সদিচ্ছাকে দুর্বলতা ভাবেন। এদের জবাদিহিতার আওতায় আনা দরকার। তখন দেখি ফাইল সেকশনে এক মাসের অধিককাল ধরে আটকে রাখা হয়Ñ তখন বিষয়টি অবশ্যই কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদন্ত করে দেখবেন। নচেত এ ধরনের ঘটনা আসলে দেশে পর্যাপ্ত মানবসম্পদ তৈরির ক্ষেত্রে সক্ষমতা তৈরিতে অন্তরায়। আসলে এ ধরনের ক্লারিক্যাল মেটারলিটি শেষ পর্যন্ত ভিশন-২০২১ বাস্তবায়নে দক্ষ ব্যাংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যম পর্যায়ে অন্তরায় তৈরি হচ্ছে। এ ধরনের মনমানসিকতার পরিবর্তন হওয়া দরকার। বর্তমান সরকার শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রয়াসে দেশকে এগিয়ে নিচ্ছে। এই এগিয়ে নেয়ার পথে ব্যাংকিং সেক্টরকে আরও গতিময়তা ও উদ্ভাবনী কলা-কৌশলের আওতায় আনতে হবে। ব্যাংকিং সেক্টরে ওঠানামা থাকতে পারেÑ তবে এ জন্য প্যানিক হওয়ার নেই। বরং ধীরে ধীরে অটো কারেকশনের জন্য পর্যাপ্ত সময় এবং প্রপাগা-াবিহীনভাবে কাজ করার ব্যবস্থা করতে হবে। গত নয় বছরে দেশে যেভাবে অর্থনীতির ব্যাপ্তি বাড়ছেÑ ঋণের পরিমাণ বাড়ছেÑ সে ক্ষেত্রে কিছু দুর্নীতি হয়েছেÑ এগুলোকে অবশ্যই যথানিয়মে ব্যবসা করতে দিতে হবে। যে বেসরকারী ব্যাংকগুলোর দৈন্যদশা সেগুলোকে মার্জার করার যে প্রয়াস অর্থমন্ত্রী দিয়েছিলেন তা যেন বাস্তবায়িত হয়-সেদিকে বাংলাদেশ ব্যাংককে কাজ করতে হবে। পত্রিকায় যেভাবে বর্তমানে কয়েকটি ব্যাংকের চেয়ারম্যানকে চিত্রিত করা হচ্ছে তাতে দেখা যায়Ñ চেয়ারম্যানরাই বুঝি সকল ঋণ প্রদানের জন্য দায়ী। এটি মোটেই ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে সত্য নয়। ঋণ গ্রহীতার আবেদনপত্র থেকে শুরু করে যারা ঋণ অনুমোদন দিয়েছেÑ পুরো প্রক্রিয়াটি এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত। এ জন্যই কোন ঋণ যখন খেলাপী হয় তখন যে টিম এটির মঞ্জুরির সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। অযথা জনগণের মনে ভয় ঢুকিয়ে স্বার্থান্বেষী মহল কুচক্রীয় মতো নোংরা খেলায় মত্ত হয়েছে। এটি বন্ধ করা উচিত। ব্যাংকিং সেক্টরের জন্য অর্থ উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান এবং ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করা দরকার। এদিকে ব্যাংকিং সেক্টরের সার্বিক উন্নয়নের জন্য নিম্নোক্ত সুপারিশমালা রাখছি : ১. ঋণ ও আমানতের মধ্যে স্প্রেভ কোনমতেই ২% বেশি হওয়া উচিত নয়। দেশের অনুন্নত অংশ ব্যাংকিং সেবা দিতে হবে। ২. কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে টাকার অবমূল্যায়ন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। নচেত আমদানিপ্রবণ দেশে দ্রব্যের দাম বাড়ার ও মূল্যস্ফীতির বৃদ্ধির হার সৃষ্টি হবে। ৩. খেলাপী ঋণ গ্রহীতাদের বিরুদ্ধে টাকা আদায়ের ক্ষেত্রে সেখান থেকে প্রথম ঋণ এ্যাপ্লিকেশন প্রসেস করা হয়েছে। সেখানের অফিসারকে সংশ্লিষ্ট রাখতে হবে। এদিকে শ্রেণীকৃত ঋণের সঙ্গে অবলোপনকৃত ঋণকে সংযুক্ত করে বিরাট অঙ্ক দেখানো ঠিক নয়। ৪. ব্যাসেল-৩ পূর্ণ করার জন্য মার্কেট ড্রাইভেন রেটে সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক লিঃকে বন্ড ছাড়ার সুযোগ দিতে হবে। ৫. যে সমস্ত বেসরকারী ব্যাংকে মূলধন ঘাটতি রয়েছে তা পূরণে মার্জার করার ব্যবস্থা নিতে হবে। ৬. ব্যাংকিং সেক্টর সম্পর্কে যারা ভুল তথ্য উপাত্ত দেবে তাদের বিরুদ্ধে পত্রিকায় জবলড়রহফবৎ দিতে হবে। প্রয়োজনে প্রেস কাউন্সিলে যেতে হবে। ৭. কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রশিক্ষণে অধিকতর ব্যবস্থা নিতে হবে। বিআইবিএমের এমবিএম প্রোগ্রামটি ঢেলে আধুনিকায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। আইবিবির ডিপ্লোমা পরীক্ষার মূল পরিবর্তন করতে হবে। পাঠদানের ব্যবস্থা এবং সার্কুলার আত্মসাত করে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্সে মাস্টার ইন এন্টারপ্রাইজে ব্যাংকারদের ড়হ লড়ন ঞৎধরহরহম-এর ব্যবস্থা দরকার। ৮. যারা মিথ্যা প্রপাগা-া সুযোগ নিয়ে নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করছে না বা ছলচাতুরী করছে তাদের প্রেষণা ও আইনের প্রয়োগ পাশাপাশি চালাতে হবে। ৯. সঞ্চয়পত্রের সুদের হারের সঙ্গে ব্যাংকের আমানতের সুদের হার কখনও প্রতিযোগিমূলক নয়। ১০. কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চারটি ডেপুটি গবর্নর পদের মধ্যে একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের দক্ষ এমডিকে নিয়োগ করতে হবে। ১১. যারা অন্যায়ভাবে ফাইল আটক রাখে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। ১২. ক্রেডিট কার্ড নিয়ে যে ধরনের জালিয়াতি, অতিরিক্ত চার্জ নিচ্ছে তা রোধ করার ব্যবস্থা করত হবে। ১৩. দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি শক্তিশালী বুনিয়াদ তৈরিতে সবাইকে সচেষ্ট হতে হবে। ব্যাংকিং সেক্টর হোক বর্তমান সরকার প্রদানের উন্নয়নের দর্শনের বাস্তবায়নকারী। শেখ হাসিনার নেতৃত্ব গুণে দেশের অগ্রযাত্রায় ব্যাংক শামিল হোক। লেখক : শিক্ষাবিদ ও ম্যাক্রো ও ফিন্যান্সিয়াল ইকোনমিস্ট [email protected]
×