ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বোরহান বিশ্বাস

অভিমত ॥ ‘বঙ্গবন্ধু’ নামের যথেচ্ছ ব্যবহার কাম্য নয়

প্রকাশিত: ০৪:০০, ৫ মার্চ ২০১৮

অভিমত ॥ ‘বঙ্গবন্ধু’ নামের যথেচ্ছ ব্যবহার কাম্য নয়

গণআন্দোলনের মুখে নতিস্বীকার করে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার আইয়ুব খান তথাকথিত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবুর রহমানসহ অভিযুক্ত সব আসামিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে রমনার রেসকোর্স ময়দানে বিশাল গণসংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। ওই সভায় তৎকালীন ডাকসুর সভাপতি এবং শেখ মুজিবুর রহমানের একনিষ্ঠ সহচর তোফায়েল আহমেদ তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ধীরে ধীরে শেখ মুজিবুর রহমানকে ছাপিয়ে ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে ওঠেন বাঙালীর প্রাণপুরুষ। টুঙ্গিপাড়ার শেখ মুজিব কিভাবে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন? বর্তমান সময়ে রাজপথে মিছিল করা কিংবা মঞ্চ কাঁপানো অনেক ভুঁইফোড় তরুণ নেতা জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলে বক্তৃতা শেষ করলেও বাংলার জন্য একজন নিবেদিত রাজনীতির বন্ধু বঙ্গবন্ধুর কথা কতটুকু জানেন? ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট আন্দোলন, ৬৬’র ৬ দফা, ৬৯’র ১১ দফা, গণঅভ্যুত্থান, ৭০’র সাধারণ নির্বাচন এবং ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ। কিভাবে একটি জাতিকে স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। সে স্বপ্ন সফল করার জন্য কিভাবে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, কিভাবে তিনি বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন- এসব ইতিহাস আমাদের তরুণদের নিজেদের প্রয়োজনেই জানতে হবে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল অলিখিত। ইতিহাসখ্যাত সেই অমর ভাষণটি বাঙালীর সঙ্গে তার নাড়ির টান ছিল বলেই সম্ভব হয়েছিল। বাঙালীর মুক্তির কবিতাখানি মানসপটে এঁকেছিলেন বলেই সেদিন সবাইকে তিনি তা শোনাতে পেরেছিলেন। অসাম্প্রদায়িক বঙ্গবন্ধুকে শেষবারের মতো দেখতে চেয়েছিলেন ফরিদপুর জেলে থাকা অসুস্থ চন্দ্র বাবু। সেই কথা বঙ্গবন্ধু লিখেছেন তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেÑ ‘ফরিদপুর জেলে ফিরে এলাম। দেখি চন্দ্র বাবু হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, অবস্থা খুবই খারাপ। তাঁর হার্নিয়ার ব্যারাম ছিল। পেটে চাপ দিয়েছিল। হঠাৎ নাড়ি উল্টে গেছে। ফলে গলা দিয়ে মল পড়তে শুরু করেছে। যে কোন সময় মারা যেতে পারেন। সিভিল সার্জন সাহেব খুব ভাল ডাক্তার। তিনি অপারেশন করতে চাইলেন, কারণ মারা যখন যাবেনই তখন শেষ চেষ্টা করে দেখতে চান। আত্মীয়স্বজন কেউ নেই যে, তাঁর পক্ষ থেকে অনুমতিপত্র লিখে দেবে। চন্দ্র ঘোষ নিজেই লিখে দিতে রাজি হলেন। বললেন, ‘কেউ যখন নাই তখন আর কি করা যাবে!’ সিভিল সার্জন সাহেব বাইরের হাসপাতালে নিতে হুকুম দিলেন। চন্দ্র ঘোষ তাঁকে বললেন, ‘আমাকে বাইরের হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন। আমার তো কেউ নেই। আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে একবার দেখতে চাই, সে আমার ভাইয়ের মতো। জীবনে তো আর দেখা হবে না।’ সিভিল সার্জন এবং জেলের সুপারিনটেন্ডেন্ট, তাঁদের নির্দেশে আমাকে জেলগেটে নিয়ে যাওয়া হলো। চন্দ্র ঘোষ স্ট্রেচারে শুয়ে অছেন। দেখে মনে হলো, আর বাঁচবেন না, আমাকে দেখে কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, ‘ভাই এরা আমাকে সাম্প্রদায়িক বলে বদনাম দিল; শুধু এই আমার দুঃখ মরার সময়। কোনদিন হিন্দু মুসলমানকে দুই চোখে দেখি নেই। সকলকে আমায় ক্ষমা করে দিতে বলো। আর তোমার কাছে আমার অনুরোধ রইল, মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখ। মানুষে মানুষে কোন পার্থক্য ভগবানও করেন নেই। আমার তো কেউ নেই, আপন ভেবে তোমাকেই শেষ দেখা দেখে নিলাম। ভগবান তোমার মঙ্গল করুক।’ এমনভাবে কথাগুলো বললেন যে সুপারিনটেন্ডেন্ট, জেলার সাহেব ডেপুটি জেলার ডাক্তার ও গোয়েন্দা কর্মচারী সকলের চোখে পানি এসে গিয়েছিল। আর আমার চোখেও পানি এসে গিয়েছিল। বললাম, ‘চিন্তা করবেন না, আমি মানুষকে মানুষ হিসাবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রীস্টান বলে কিছু নেই। সকলেই মানুষ।’ (পৃ.-১৯১)। এই ছিলেন বঙ্গবন্ধু। যাকে দেখলেও অনেকের চোখ জুড়িয়ে যেত। সুস্থতা বোধ করতেন। পরম আস্থার জায়গা ফিরে পেতেন। শুধু স্বাধীনতা আন্দোলন নয়, এর অনেক আগে বঙ্গবন্ধু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে সেই সময় বলেছিলেন, ‘বাংলা পাকিস্তানের শতকরা ছাপ্পান্ন ভাগ লোকের মাতৃভাষা। তাই বাংলাই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত। তবুও আমরা বাংলা ও উর্দু দুইটা রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেছিলাম। পাঞ্জাবের লোকেরা পাঞ্জাবি ভাষা বলে, সিন্ধুর লোকেরা সিন্ধি ভাষায় কথা বলে, সীমান্ত প্রদেশের লোকেরা পশতু ভাষায় কথা বলে, বেলুচরা বেলুচি ভাষায় কথা বলে। উর্দু পাকিস্তানের কোন প্রদেশের ভাষা নয়, তবুও যদি পশ্চিম পাকিস্তানের ভায়েরা উর্দু ভাষার জন্য দাবি করে, আমরা আপত্তি করব কেন? যারা উর্দু ভাষা সমর্থন করে তাদের একমাত্র যুক্তি হলো উর্দু ‘ইসলামিক ভাষা’। উর্দু কি করে যে ইসলামিক ভাষা হলো আমরা বুঝতে পারলাম না। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। আরব দেশের লোকেরা আরবী বলে। পারস্যের লোকেরা ফার্সি বলে, তুরস্কের লোকেরা তুর্কি ভাষা বলে, ইন্দোনেশিয়ার লোকেরা ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় কথা বলে, মালয়েশিয়ার লোকেরা মালয় ভাষায় কথা বলে, চীনের মুসলমানরা চীনা ভাষায় কথা বলে। এ সম্বন্ধে অনেক যুক্তিপুর্ণ কথা বলা চলে। শুধু পূর্ব পাকিস্তানের ধর্মভীরু মুসলমানদের ইসলামের কথা বলে ধোঁকা দেয়া যাবে ভেবেছিল, কিন্তু পারেনি।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ.- ৯৮ ও ৯৯)। দেশ স্বাধীনের পর পেছন দরজা দিয়ে ক্ষমতা দখলের যে মহরত শুরু হয় তা চলে দীর্ঘ ২১টি বছর। এই সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে বাংলার বুক থেকে মুছে ফেলার হেন চেষ্টা নেই যা করা হয়নি। এত সবের মধ্যেও ১৯৭৪ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত এক লেখায় জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক বলে উল্লেখ করেন। জিয়া নিজেই লেখেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণই ছিল তার স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা।’ ক্ষমতা দখলের ধারাবাহিক প্রতিযোগিতায় এক সময় এরশাদ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন। তার স্বৈরশাসনামলে তার নামের আগে ‘পল্লীবন্ধু’ তকমাটি জুড়ে দেয়া হয়। আদতে তা কতটুকু মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে- সেটি প্রশ্ন সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে, ওই সময় বঙ্গবন্ধুকে হেয় করে পল্লীবন্ধুকে প্রতিষ্ঠিত করার বিষয়টি স্পষ্টতই ফুটে ওঠে। এরশাদ আমলে বহুল প্রচারিত দৈনিক ইনকিলাবসহ সুবিধাভোগী অনেক পত্রিকা এরশাদের নামের আগে অবলিলায় ‘পল্লীবন্ধু’ ব্যবহার করলেও আওয়ামী লীগ কিংবা বঙ্গবন্ধু সংক্রান্ত কোন সংবাদ প্রকাশ করত দায়সারাভাবে। যেমনÑ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকা- সংক্রান্ত সংবাদ পেছন অথবা মাঝের কোন পৃষ্ঠায় এক কলামে ‘শেখ মুজিবের মৃত্যুবার্ষিকী’ শিরোনাম করে যেনতেনভাবে প্রকাশ করা হতো। বাংলাদেশবিরোধী, বাংলাবিরোধী এবং বঙ্গবন্ধুবিদ্বেষী ভূমিকার জন্য ইনকিলাবকে বর্জন করার আহ্বান জানিয়ে ১৯৯৭ সালের ১৩ এপ্রিল বিবৃতি দিয়েছিলেন কবি সুফিয়া কামাল, প্রফেসর শওকত ওসমান, প্রফেসর কবীর চৌধুরী এবং কবি শামসুর রাহমান। সময়ের আবর্তে আজ আমাদের গণমাধ্যম শুধু বঙ্গবন্ধুই নয় জাতির জনক বলতেও দ্বিধা করে না। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের বাইরে অনেক ভুঁইফোড় সংগঠনের অস্তিত্ব আছে। যারা বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করে আসছে। সাইনবোর্ড সর্বস্ব এসব সংগঠনের কর্মকা- অনেকেরই জানা। বঙ্গবন্ধুকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। সংগঠন গড়ে কেউ যদি বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে জানাতে চান তাহলে শ্রদ্ধাবনতচিত্তে তাদের নিজেদের আগে জানতে হবেÑ বঙ্গবন্ধু কে ছিলেন, কিভাবে একটি জাতিকে তিনি স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে তিনি বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নাম ও ছবির যথেচ্ছ ব্যবহার বিষয়ে সরকার যদি নীতিমালা করে দিত তাহলে ভাল হতো। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক তরুণ রাজনীতিকই বক্তব্য রাখেন, কিন্তু গভীর কোন বক্তব্য নয়। ভাসা ভাসা ভাষায় বঙ্গবন্ধু তাদের কথায় উপস্থাপিত হয়। বঙ্গবন্ধুর জীবনী পাঠ করে কেউ যদি তার রাজনৈতিক জীবন গড়তে চান তবে তা শুধু ব্যক্তিরই নয়, দেশ ও দশেরও উপকারে আসবে, মঙ্গল হবে। বঙ্গবন্ধুুর নামে অবশ্যই আমরা কিছু করবো। তবে, সেটা যেন স্তুতির পর্যায়ে না যায়। ভালবাসা আর স্তুতি এক কথা নয়। নিজেকে প্রকাশ না করেও ভালবাসা যায়। কিন্তু তোষামোদ গোপনে হয় না। লেখক : সাংবাদিক
×