ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

স্বপ্ন দেখাচ্ছে সিরামিক পণ্য

প্রকাশিত: ০৬:০১, ৪ মার্চ ২০১৮

স্বপ্ন দেখাচ্ছে সিরামিক পণ্য

বিশ্ববাজারে বাংলাদেশে তৈরি সিরামিক পণ্যের কদর বাড়ছে। শুধু তাই নয়, একই সঙ্গে নতুন নতুন বাজারও সৃষ্টি হচ্ছে। এমনকি এই শিল্পে বড় উৎপাদনকারী দেশ চীন ও ভারতের নজরও এখন বাংলাদেশের দিকে। বিশ্বকে চমকে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। আদি মৃৎ শিল্পের পথ ধরে সিরামিক শিল্পের আবির্ভাব। হাজার বছরের পুরনো এ শিল্পের বহু প্রাচীন নিদর্শন ঠাঁই করে নিয়েছে দেশ-বিদেশের জাদুঘরে। এদেশের প্রধান রফতানি পণ্যের তালিকায় সিরামিকের অবস্থান সপ্তম। বিদেশে সমাদৃত হচ্ছে বাংলাদেশের সিরামিক পণ্য। এ খাতে রফতানি আয় বাড়ছে। বাড়ছে বিনিয়োগও। শিল্প-বাণিজ্য, প্রযুক্তি, অবকাঠামোসহ সব ক্ষেত্রেই উন্নয়নের ছোঁয়া। মানব সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তার পণ্য ব্যবহারেও বিবর্তন আসে। মাটির তৈজসপত্র, সৌখিন পণ্য তৈরিতে আধুনিক যন্ত্র যুক্ত হয়ে তার রূপ, মান ও উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ায়। সেই ধারাবাহিকতায় এক সময় সিরামিক পণ্যের উদ্ভাবন করে মানুষ। বিবর্তনের ধারায় সিরামিক শিল্পে যুক্ত হতে থাকে মানুষের সৌন্দর্যবোধ জ্ঞান ও প্রযুক্তি। নতুন নতুন শিল্প নৈপুণ্যে বাড়ে মান, পাল্টায় রূপ। এ দেশে বাণিজ্যিকভাবে সিরামিকের যাত্রা শুরু হয় প্রায় ষাট বছরের অধিক সময় ধরে। প্রথমে এমসিআই ও ন্যাশনাল সিরামিক কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে ঢাকা সিরামিক ও তাজমা সিরামিক কারখানা হয়। ১৯৬২ সালে যাত্রা শুরু করে পাকিস্তান সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ। স্বাধীনতার পর থেকে সেটি পিপলস সিরামিক নামে পরিচালিত হচ্ছে। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের (বিসিআইসি) আওতায় মিরপুরে বাংলাদেশ ইনস্যুলেটর এ্যান্ড স্যানিটারি ওয়্যার ফ্যাক্টরি (বিআইএসএফ) হয়। বেসরকারী খাতে প্রথম কারখানা মুন্নু সিরামিক হয় ১৯৮৫ সালে। পরে আরও অনেক উদ্যোক্তা সিরামিক খাতে বিনিয়োগ করেন। উন্নতমানের সিরামিক পণ্য উৎপাদনে মুন্নু, শাইনপুকুর, পিপলস, ফার, প্রতীক, আরএকে, সিবিসি, স্ট্যান্ডার্ড, আবুল খায়ের, ইউরো বাংলা, চার, মধুমতি, স্টার, প্যারাগনসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বর্তমানে আমেরিকা, কানাডা, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালিসহ বিশ্বের ৫০টির বেশি দেশে বাংলাদেশের সিরামিক পণ্যসামগ্রী রফতানি হচ্ছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৪ কোটি ১৮ লাখ কোটি ডলার বা ৩৩৮ কোটি টাকার সিরামিক পণ্য রফতানি করেছে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। এই আয় আগের অর্থবছরের চেয়ে সাড়ে ১৪ শতাংশ বেশি। সিরামিক পণ্যের মধ্যে তৈজসপত্র বেশি রফতানি হচ্ছে। গত অর্থবছরে ৩৩৮ কোটি টাকার রফতানির মধ্যে ছিল তৈজসপত্র ২৮৮ কোটি ও টাইলস ৫০ কোটি টাকার। এক সময় সৌখিনতা হলেও কালের পরিক্রমায় তা এখন নিত্য ব্যবহার্য। এই শিল্পপণ্যে বাড়ছে বৈচিত্র্য, কমছে বিদেশী সিরামিক পণ্যের ওপর নির্ভরতা। তৈজসপত্র, স্যানিটারি ও টাইলস এই তিন ধরনের সিরামিক পণ্যের চাহিদার বড় অংশই এখন পূরণ করছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান। তাই প্রতিবছরই এ খাতে নতুন বিনিয়োগ আসছে। দেশে উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সিরামিক পণ্যের আমদানি কমছে। অন্যদিকে রফতানিও হচ্ছে। সব মিলিয়ে সিরামিক খাতে শক্ত ভিত তৈরি করে নিচ্ছে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। সিরামিক খাতের উদ্যোক্তারা বলেছেন, দেশে সিরামিক পণ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বিদেশেও আছে বড় বাজার। সিরামিক খাতে বর্তমানে ৬২টি প্রতিষ্ঠান আছে। এর মধ্যে তৈজসপত্রের ২০টি, টাইলসের ২৬টি ও স্যানিটারি পণ্য উৎপাদনের ১৬টি কারখানা। সিরামিক পণ্য উৎপাদনে মূল্য সংযোজন ৬৫ শতাংশ। সব মিলিয়ে সিরামিক শিল্পে ১০০ কোটি ডলার বা ৮ হাজার ২০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ হয়েছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ খাতটির সঙ্গে জড়িত। তৈজসপত্র উৎপাদনকারী ২৬ প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ কোটি পিস। তারাই তৈজসপত্রের দেশীয় চাহিদার ৮৮ দশমিক ৫৫ শতাংশ পূরণ করে। ২৬টি টাইলস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান দেশীয় চাহিদার ৭২ দশমিক ২৯ শতাংশ জোগান দেয়। তাদের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ১২ কোটি বর্গমিটার টাইলস। স্যানিটারি পণ্যের দেশীয় চাহিদার ৮৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ পূরণ করছে ১৬টি স্যানিটারি পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। বাকিটা বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়। বর্তমানে সিরামিক পণ্যের মধ্যে টেবল পণ্যের বিদেশের বাজারে ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে। এসব টেবল পণ্যের মধ্যে রয়েছে ১৫০ থেকে ২৫০টি ধরন। পাশাপাশি এইচএ্যান্ডএম ও মার্কসের মতো নামীদামী বিদেশী ব্র্যান্ডের অর্ডারও নেয়া হচ্ছে দেশীয় সিরামিকস কারখানায়। ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্তত ৫০টি দেশে রফতানি করা হচ্ছে বাংলাদেশে তৈরি এসব সিরামিক পণ্যের। বিশেষ করে চীনের দখলে থাকা বিশ্ববাজারে এখন বাংলাদেশী সিরামিকস পণ্য প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। তৈজসপত্র, স্যানিটারি পণ্য আর টাইলস এই তিন ধরনের পণ্য সিরামিক কারখানায় উৎপাদিত হয়। টাইলস, বেসিন, কমোড, কিচেন ওয়্যার, স্যানেটারি ওয়্যার, টেবিল ওয়্যার, মাটির জার, কলস, ফুলের টব, মটকা, টেবিল ওয়্যার, স্যানিটারি ওয়্যার, গার্ডেন পট, ভেজ, কিচেন ওয়্যার, ডিনার সেট, টি সেট, কফি মগ, প্লেট, বাটি থেকে শুরু করে গৃহস্থালির বিভিন্ন জিনিসপত্র সিরামিক দ্বারা তৈরি করা হচ্ছে। শাইনপুকুর, মুন্নু, বেঙ্গল ফাইন, স্ট্যান্ডার্ড, পিপলস এবং ন্যাশনাল সিরামিক কারখানা বাংলাদেশের সিরামিক তৈজসপত্রের উৎপাদনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে। আবার আরএকে, ফুয়াং, চায়না-বাংলা, ফার, মধুমতি, এটিআই, সানফ্লাওয়ার, গ্রেটওয়াল, ঢাকা-সাংহাই এবং মীর কোম্পানি টাইলস ও স্যানিটারি পণ্য উৎপাদনে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে।
×