ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

২৭ মার্চ থেকে যৌথ টহল ;###;বাংলাদেশের পাশে আছে যুক্তরাষ্ট্র ॥ লিসা কার্টিস

তুমব্রু থেকে সেনা সরাল মিয়ানমার

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ৪ মার্চ ২০১৮

তুমব্রু থেকে সেনা সরাল মিয়ানমার

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ তাৎক্ষণিক পতাকা বৈঠক, মিয়ানমার রাষ্ট্রদূতকে তলব করে জোরালো প্রতিবাদ, বিজিবির টহল জোরদার করাসহ সরকারের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে তুমব্রু সীমান্তের ওপারে জিরো লাইনের কাছাকাছি মিয়ানমারের সেনা সমাবেশ গুটিয়ে নেয়া হয়েছে। ফলে ৫৫ ঘণ্টার টান টান উত্তেজনার অবসান ঘটেছে। বিজিবি সূত্রে জানানো হয়েছে, এরপরও সীমান্তে ইতোমধ্যে নিজেদের সক্ষমতা আরও বাড়ানো হয়েছে। আগামী ২৭ মার্চ থেকে বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) ও বিজিপি (বর্ডার গার্ড পুলিশ) সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে যৌথ টহল দেবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল শনিবার ঢাকায় বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি আরও বলেছেন, আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশে আশ্রিত লাখ লাখ রোহিঙ্গা শীঘ্রই নিজের দেশে ফিরে যেতে পারবে। এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক প্রধান উপদেষ্টা লিসা কার্টিস শনিবার উখিয়ায় কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবিলা এবং তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র কাজ করে যাবে। অপরদিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করার আগেই রাখাইন রাজ্যে উগ্র মগরা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বানচাল করতে তৎপর হয়েছে। মংডুতে ৬টি পয়েন্টে আগামীতে প্রত্যাবাসিত হবে এমন রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে সহিংসতা সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন নির্যাতনের প্রক্রিয়ায় সেনা ও পুলিশের সঙ্গে উগ্র মগ সন্ত্রাসীরাও সরাসরি জড়িত ছিল। তুমব্রু সীমান্তের ওপারে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে আকস্মিকভাবে প্রায় ৭শ’ সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছিল মিয়ানমার। ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত এসব সেনা ফাঁকা গুলিবর্ষণও করেছিল। যদিও শুক্রবার অনুষ্ঠিত পতাকা বৈঠকে বিজিপির পক্ষে তা অস্বীকার করা হয়েছে। ঘটনা যাই হোক, তুমব্রু সীমান্তের ওপারে জিরো লাইনে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা ইস্যুটিও যখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচিত হচ্ছে তখন তাদের সেখান থেকে বিতাড়িত করতে এবং এর পাশাপাশি শক্তির মহড়া দেয়া শুরু করে। এ অবস্থায় বিজিবির পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক পতাকা বৈঠকের প্রস্তাব দেয়া হয়, যা শুক্রবার অনুষ্ঠিত হয়েছে। অপরদিকে ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ ঘটানোর ব্যাপারে জোরালো প্রতিবাদ করা হয়। সীমান্তে বিজিবি টহল আগেকার চেয়ে আরও বেশি জোরদার করা হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মিয়ানমার পক্ষের টনক নড়ে। শুক্রবার বিকেল থেকেই উত্তেজনা প্রশমনের পথে এগিয়ে যায়। শনিবার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে মোতায়েনকৃত সেনাদের গুটিয়ে নেয়ার কাজ শুরু হয়ে যায়। সকাল সাড়ে ১০টার মধ্যে সৈন্য সমাবেশের পুরো এলাকা শূন্য হয়ে যায়। ফলে এপার ও ওপারের স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। জিরো লাইনে অবস্থানকারী যেসব রোহিঙ্গা এখনও অবস্থান করছে তারাও শঙ্কামুক্ত হয়েছে। কক্সবাজার বিজিবি ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান জানিয়েছেন, শনিবার সকাল ৯টার আগ পর্যন্তও তুমব্রু সীমান্তের ওপারে ৫ শতাধিক সেনা সদস্যের অবস্থান ছিল। এ অবস্থায় ইতোমধ্যে জোরদারকৃত বিজিবি টহল ‘মিট পতাকা’ নিয়ে কোনারপাড়া হয়ে তুমব্রু জিরো পয়েন্টের দিকে এগিয়ে গেলে মিয়ানমার সেনা সদস্যরা ট্রাকযোগে সরে পড়তে থাকে। একপর্যায়ে পুরো এলাকাটি খালি হয়ে যায়। বিজিবির এই অধিনায়ক জানান, সীমান্তে যদি কোন ঘটনা ঘটে তা নিয়ে সতর্ক থাকা এবং সীমান্ত পাহারা দেয়াই বিজিবির মূল কাজ। গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে তুমব্রু সীমান্তে যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয় বর্তমানে সেখানে স্বস্তির পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এরপরও আমাদের সতর্ক থাকা দরকার। বিজিবি সব সময় সতর্ক অবস্থায় আছে। আতঙ্কিত হওয়ার মতো কোন পরিস্থিতি হয়নি। তিনি জানান, আগামী ২৭ মার্চ থেকে উভয় দেশের সীমান্তরক্ষীরা যৌথভাবে টহল দেবে। বিজিবির পক্ষ থেকে সীমান্ত পরিস্থিতি পুরোপুরিভাবে স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত নোম্যানসল্যান্ড থেকে স্থানীয়দের নিরাপদ দূরত্বে থাকার অনুরোধ জানানো হয়েছে। রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনে ট্রাম্প উপদেষ্টা লিসা ॥ এদিকে বাংলাদেশ সফররত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক প্রধান উপদেষ্টা লিসা কার্টিস শনিবার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে বলেছেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলায় এবং এদেশে আশ্রিতদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করবে যুক্তরাষ্ট্র। রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশকে সব ধরনের সহযোগিতা দেবে যুক্তরাষ্ট্র। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যরা যাতে নিরাপদ ও সম্মানের সঙ্গে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে সে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করবে যুক্তরাষ্ট্র। লিসা কার্টিস শনিবার উখিয়ায় কুতুপালং আশ্রয় শিবিরে অবস্থানরত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কিছু সদস্যের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট। সকাল ৮টার দিকে তিনি টেকনাফের শামলাপুর অস্থায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। দশটার দিকে যান টেকনাফের কেরুণতলীতে প্রত্যাবাসনের জন্য তৈরি ট্রানজিট ঘাট দেখতে। বেলা বারোটার দিকে তিনি যান উখিয়ায় ইউএনএইচসিআর পরিচালনাধীন ট্রানজিট ক্যাম্প পরিদর্শনে। এরপর যান বালুখালী ক্যাম্প পরিদর্শনে। লিসা কার্টিস বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে কোফি আনান কমিশনের প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে হবে। রোহিঙ্গা সঙ্কটে মানবিক সাড়া দেয়ায় তিনি বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ সরকারের জনগণের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। এ সময় মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট বলেন, ‘আমরা সীমান্তে রোহিঙ্গা পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছি।’ সম্প্রতি সীমান্তে মিয়ানমারের সেনা মোতায়েন এবং রোহিঙ্গাদের ঠেলে দেয়ার সামগ্রিক বিষয় নিয়েও আমরা অবগত আছি। বার্নিকাট বলেন, রোহিঙ্গারা যাতে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে সে জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলে কাজ করছে। শুধু মিয়ানমারে নয়, নিজেদের বসতভিটায় ফিরে যেতে পারে সে লক্ষ্যেও আমরা সে সরকারের সঙ্গে কাজ করব। রোহিঙ্গাদের অধিকার বাস্তবায়নে মিয়ানমার কি করছে তাও আমরা জানতে চাইব। প্রত্যাবাসন ঠেকাতে রাখাইনে উগ্র মগরা তৎপর ॥ মিয়ানমার সরকার রাখাইনদের প্রত্যাবাসনে সমঝোতা স্মারক সই করেছে। প্রত্যাবাসনের জন্য ট্রানজিট পয়েন্ট প্রতিষ্ঠা করেছে। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার পর নির্দিষ্ট ক্যাম্পে রাখার ব্যবস্থাও করছে বলে ঘোষণা দেয়ার পর সেখানকার উগ্র মগরা এতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে তৎপর হয়েছে। রাখাইন জনগোষ্ঠীর উগ্রবাদীদের অনেকে এর বিরোধিতা শুরু করেছে। ফলে মংডু জেলার নির্দিষ্ট ছয়টিসহ বিভিন্ন পয়েন্টে সহিংসতা সৃষ্টির আশঙ্কাও করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার তথ্যানুযায়ী, গত বছর ২৫ আগস্ট রাতের পর থেকে সেনা অভিযানে যে বর্বরতা শুরু হয় সে থেকে কমপক্ষে ৪৫৫ গ্রামের সব অবকাঠামো ও ফসলের ক্ষেত ধ্বংস করা হয়েছে। এরপরে পাহাড় কেটে মাটি এনে রোহিঙ্গা বসতির চিহ্নও মুছে ফেলা হচ্ছে।
×