ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

৯ বছর পর পরিবারে ফিরল প্রতিবন্ধী লাকি

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ৪ মার্চ ২০১৮

৯ বছর পর পরিবারে ফিরল প্রতিবন্ধী লাকি

নিজস্ব সংবাদদাতা, পটুয়াখালী, ৩ মার্চ ॥ ২০০৯ সালের চৈত্র মাসের ভরদুপুর ! সোলেমান মাঝি মাঠের কাজ সেরে ঘরে ফিরে এলেন প্রতিদিনের মতোই। তার সঙ্গেই মাঠ থেকে ফিরে এলো একমাত্র ছেলে রুহুল আমিন। সোলেমান মাঝির এক ছেলে আর দুই মেয়ে। ঘরে অসুস্থ স্ত্রী। ছেলে রুহুল আমিনের বয়স তখন ১৫ আর ছোট মেয়ে সোনিয়ার বয়স ৩ বছর। বড় মেয়ে লাকি। বড়ই অবুঝ। সবকিছুই দেরিতে বোঝে। অনেক কিছু বোঝেই না। নিজের মনে হাসে নিজের মনে কাঁদে। আট বছরের বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। ঘরে ফিরে সোলেমান মাঝির মন আনচান করে উঠল। সবকিছু আগের মতোই আছে তো। কিন্তু এমন লাগছে কেন তার ? হঠাৎ লক্ষ্য করল তার অবুঝ মেয়েটা কোথাও নেই। পুকুরপারে ছোটেন। উঠোনে আসেন। দৌড়ে পাশের বাড়ি যান। কোথাও নেই। কেউ জানে না লাকির খবর। কেউ দেখেনি তাকে। কি হলো মেয়ের? সে তো কোন পথ চেনে না। বাবার বুক ভেঙ্গে অচেনা পথে নিরুদ্দেশ মেয়ে লাকি। এদিন শেষ বিকেল পটুয়াখালী সরকারী মহিলা কলেজের হোস্টেল সুপার আব্দুস সালাম লক্ষ্য করলেন ছাত্রী হেস্টেলের সামনে ৮-৯ বছরের একটি মেয়ে ভারসাম্যহীনভাবে ঘোরাঘুরি করছে। মেয়েটি নাম ছাড়া কিছুই বলতে পারছে না। কোথা থেকে এসেছে, কিভাবে এসেছে কিছুই বলতে পারছে না। শুধুই ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। পিতৃত্ব জেগে উঠল আব্দুস সালাম স্যারের। অসহায় মেয়েটিকে তিনি ফেলে যেতে পারলেন না। গ্রামের অবুঝ মেয়েটির আশ্রয় জুটল নতুন জীবনে-নতুন ঘরে। শহুরে জীবনে অভ্যস্ত হতে শুরু করে লাকি। আব্দুস সালাম স্যার বিভিন্নস্থানে খোঁজাখুঁজি করেন। কোথাও কোন হারানো বিজ্ঞপ্তি আছে কিনা জানার চেষ্টা করেন। এর মধ্যেই স্যার বরিশাল বিএম কলেজে বদলির আদেশ পান। সংকুচিত হতে থাকে লাকির পরিচয় জানার পথ। কিন্তু স্যার হাল ছাড়েননি। হতাশও হননি। নতুন কর্মস্থলে যোগদান করেন। সঙ্গে থাকে স্যারের পরিবার। সঙ্গে থাকে লাকি। অসহায় বাবা, যেখানে যেটুকু খবর পান ছুটে যান সেখানে। সবই উড়ো খবর, বিফল হয়ে ফিরে আসেন। মেয়েকে পাওয়া হয় না। হুজুরের কাছে ছোটেন, মানত করেন। মায়ের কান্না থামে না। ঘরে কোন উৎসব হয় না। মেয়েকে পাওয়া হয় না। লাকির সন্ধান জানতে থেমে নেই সালাম স্যার। বড় হতে থাকে লাকি। সালাম স্যারের পরিবারকেই তার নিজের পরিবার মনে হতে থাকে। সালাম স্যারের স্ত্রী, ছোট দুই ছেলেমেয়ে সবাই তাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। কেটে যায় ৮টি বছর। নিরাপত্তা আর ভালবাসার ছোঁয়ায় ধীরে ধীরে মনে পড়তে থাকে তার শৈশবের কথা। বুঝতে পারে, মনে পড়তে থাকে নিজের শিকড়ের কথা। হঠাৎ একদিন লাকি বলতে পারে তার বাবার কথা-বাবার নাম সোলেমান মাঝি। শুধু এটুকুই। এর কিছুদিন পর মায়ের কথা। ভরসা দিতে থাকেন সালাম স্যার। আরও একটু চেষ্টা করো, আরও কিছু মনে পড়ে কিনা। গ্রামের নাম বা অন্য কিছু। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে লাকি বলতে পারে তার গ্রাামের কথা-পাজাখালী মাঝিবাড়ি। সবকিছু মিলিয়েই যা দাঁড়ায় সেও খুব অল্প তথ্যই। তবুও ভরসা করা যায়। বাবার নাম পাওয়া গেছে, গ্রাামের নাম পাওয়া গেছে। আব্দুস সালাম স্যার তার এক নিকট আত্মীয়ের বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আত্মীয়ের বন্ধু বাংলাদেশের বৃহত্তম বেসরকারী আইনগত সহায়তাদানকারী সংস্থা বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এ্যান্ড সাভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) পটুয়াখালী ইউনিটে কর্মরত। তারা লাকির শেকড়ের সন্ধান করার চেষ্টা করেন। পেয়েও যান লাকির বাবা-মা কে। মেয়ে বেঁচে আছে। ভাল আছে, বিশ্বাস হয় না বাবা সোলেমান মাঝির। মা সূর্য ভানু শিশুর মতো কাঁদতে থাকেন। বাবার চোখে আনন্দাশ্রু। গত ১ মার্চ এক নতুন দিন। খুশির দিন। আব্দুস সালাম স্যার, স্যারের আত্মীয়ের বন্ধু আর বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এ্যান্ড সাভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) পটুয়াখালী ইউনিটের সহযোগিতায় এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি হলো। মেয়েকে দেখার জন্য, পাবার জন্য বাবা সোলায়মান মাঝি এসেছে। নয় বছরের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান। বড়ই অবুঝ-সবকিছুই দেরিতে বোঝে কিন্তু বাবাকে দেখার পর-বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে লাকি বুঝিয়ে দিয়েছে - সবচেয়ে অপদার্থ সন্তানও তার বাবা- মায়ের বুকের মাঝেই আশ্রয় খুঁজে নিতে জানে। আব্দুস সালাম স্যার লাকির অনাগত ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে পঞ্চাশ হাজার টাকা ব্লাস্ট, পটুয়াখালী ইউনিটে জমা দিয়েছেন। জমা দিয়েছেন নয় বছরের পিতৃস্নেহ, মায়া-মমতা আর লাকিকে আগলে রাখার অধিকার। সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন শুধু- ঝাঁপসা হয়ে আসা দু’চোখ।
×