ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর ভাষণও একটি মূল্যবান সম্পদ

প্রকাশিত: ০৩:৫৮, ৪ মার্চ ২০১৮

জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর ভাষণও একটি মূল্যবান সম্পদ

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ সম্পর্কে বাংলার সর্বস্তরের মানুষ অবহিত। ভাষণটি ছিল মূলত একটি নির্দিষ্ট ভূ-খণ্ড এবং একটি নির্দিষ্ট জাতির অধিকার আদায়ের মুক্তির সনদ। সেদিনের ঐতিহাসিক ভাষণের হাত ধরেই একটি জাতির জন্ম, স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, একটি জাতীয় পতাকা ও একটি জাতীয় সঙ্গীতের জন্ম। এতদিন ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল শুধু বাঙালী জাতির সম্পদ, স্বাধীনতার এক মূল্যবান দলিল। গত ৩০ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ইউনেসকোর মেমোরি অব ওয়ার্ল্ড রেজিস্ট্রারে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় ভাষণটি এখন আর বাঙালী জাতির একক সম্পদ নয়, বিশ্ব সম্পদ। বিশ্ববাসীর কাছে এক মূল্যবান দলিল। বঙ্গবন্ধুর আরও একটি ঐতিহাসিক ভাষণ রয়েছে। সেটি হলো ২৫.০৯.১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলায় প্রদত্ত ভাষণ। জাতিসংঘে প্রদত্ত ভাষণটিও ছিল ইতিহাস কাঁপানো এক শ্রেষ্ঠ ভাষণ। বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়েছেন এটা আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু অনেকেই জানি না ভাষণের বিষয়বস্তু কি ছিল। ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল বাঙালী জাতির অধিকার আদায়ের সংগ্রাম, স্বাধিকার আন্দোলনের প্রস্তুতি ও দিক-নির্দেশনামূলক ভাষণ। কিন্তু ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ছিল সমগ্র বিশ্বের অধিকার বঞ্চিত নির্যাতিত-নিষ্পেষিত মানুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকার, বিশ্বশান্তি ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার একটি বলিষ্ঠ উচ্চারণ এবং সাহসী পদক্ষেপ। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেন, জাতিসংঘের জন্মের পর এক-চতুর্থাংশ শতাব্দীর অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে, তার আদর্শ বাস্তবায়নে বিরাট বাধার মুখে অবিরাম সংগ্রাম চালাতে হয়েছে। জাতিসংঘের সনদে যে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তা অর্জনের জন্য এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার লাখো লাখো মুক্তি সেনানীকে আত্মাহুতি দিতে হয়েছে। এই সংগ্রাম এখনও চলছে। গায়ের জোরে বেআইনীভাবে এলাকা দখল, জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকারকে নস্যাৎ করার কাজে শক্তির ব্যবহার এবং বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে চলছে এই যুদ্ধ। ...পৃথিবীর বহু স্থানে অন্যায়-অবিচার এখনও চলছে। আমাদের আরব ভাইয়েরা এখনও লড়ছেন তাদের ভূমি থেকে জবরদখলকারীদের সম্পূর্ণ উচ্ছেদের জন্য। প্যালেস্টাইনি জনগণের ন্যায়সঙ্গত জাতীয় অধিকার এখনও অর্জন হয়নি। উপনিবেশবাদ উচ্ছেদের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হলেও চূড়ান্ত লক্ষ্যে এখনও পৌঁছেনি। এ কথা আফ্রিকার জন্য আরও দৃঢ়ভাবে সত্য। যেখানে জিম্বাবুইয়ে ও নামিবিয়ার জনগণ জাতীয় স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য চূড়ান্ত সংগ্রামে এখনও ব্যাপৃত। বর্ণবৈষম্য এই পরিষদে চরম অপরাধ বলে চিহ্নিত হওয়া সত্ত্বেও মানুষের বিবেক তা এখনও ধ্বংস করছে। একদিকে অন্যায়-অবিচারের ধারাকে উৎখাতের সংগ্রাম, অন্যদিকে বিরাট চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে। ফ্যাসিবাদবিরোধী, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী বঙ্গবন্ধুর এই বলিষ্ঠ বক্তব্য ইতিহাসের পাতায় বিশেষ মর্যাদা পাওয়ার অধিকারী। মানুষের কাছে জীবন অত্যন্ত মূল্যবান। প্রত্যেক মানুষ তার নিজের জীবনকে খুব ভালবাসে। একমাত্র বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনকে সারাজীবনই তুচ্ছ মনে করে গেছেন। যেখানেই মানবতার অবক্ষয় দেখেছেন সেখানেই তিনি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন, সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন, বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করার চেষ্টা করেছেন। তৎকালীন তৃতীয় বিশ্বের যে সকল নেতা তাদের জাতিকে স্বাধীন করার পর সাম্রাজ্যবাদের প্রভাবমুক্ত রেখে প্রকৃত স্বাধীনতা বিকাশের পথ গ্রহণ এবং শোষণের হাত থেকে মুক্ত রেখে আর্থ-সামাজিক ও জাতীয় মুক্তির পথ গ্রহণ করেছিলেন তাদের অনেকেই প্রাণ দিয়েছেন সাম্রাজ্যবাদ ও শোষকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের বলি হয়ে। বঙ্গবন্ধু তা জেনেও প্রকৃত স্বাধীনতার বিকাশ শোষণ, বঞ্চনা, অশিক্ষা ও দারিদ্র্য থেকে মুক্তির পথ বেছে নিয়েছেন। এরকম স্বাধীন প্রগতিশীল বিকাশের পথ গ্রহণ করায় চিলির নেতা ও রাষ্ট্রপতি আলেন্দে সত্তর দশকের প্রথমদিকে সাম্রাজ্যবাদ ও শোষক শ্রেণীর প্রতি বিপ্লবে প্রাণ দিয়েছেন। তারা ক্ষমতায় বসিয়েছিল ঘৃণিত স্বৈরশাসক জেনারেল পিনোচেটকে। ঐ সময় চিলির আরেক মহান নেতা লুইস কারবালনকে জেলে বন্দী করে হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে জেনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, জীবনকে আমি ভালবাসি; কিন্তু মানুষের মুক্তির জন্য জীবনকে বিসর্জন দিতে আমি ভয় পাই না। এমন সাহসী এবং সিংহ হৃদয়ের মানুষ না হলে জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে ফ্যাসিবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ওই ধরনের জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতে পারতেন না। পাকিস্তান শাসনামলের ২৩ বছর বঙ্গবন্ধু বাঙালী জাতির অধিকার আদায়ে শাসকের রক্তচক্ষু, নির্যাতন, জেল-জুলুম, এমনকি মৃত্যুকে উপেক্ষা করে সাহসিকতার সঙ্গে সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। তেমনি বিশ্বের অধিকার বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ে ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ পরাশক্তির রক্তচক্ষুকে তিনি ভয় করেননি। অত্যন্ত বলিষ্ঠ কণ্ঠে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে তাদের ন্যায্য অধিকারের কথা তুলে ধরেছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে একদিকে যেমন বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন, তেমনি ক্ষুধার তাড়নায় বুভুক্ষু মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি, অনাহার, দারিদ্র্য, বেকারত্ব দূরীকরণের মাধ্যমে প্রত্যেকটি মানুষের সুখী ও সম্মানজনক জীবনের ন্যূনতম নিশ্চয়তার দাবি জানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু দ্ব্যর্থহীনভাবে সেদিন ঘোষণা দিয়েছিলেন, জাতিসংঘকে একটা ন্যায়সঙ্গত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য যুক্তির শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। এ ব্যবস্থায় থাকবে নিজের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর প্রতিটি দেশের সার্বভৌম অধিকারের নিশ্চয়তা। এ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, বাস্তব কাঠামো, যার ভিত্তি হবে স্থিতিশীল ন্যায়সঙ্গত অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বিশ্বের সকল দেশের সাধারণ স্বার্থের স্বীকৃতি। এখন এমন একটি সময় যখন দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করতে হবে যে, আমাদের একটি আন্তর্জাতিক দায়িত্ব রয়েছে। এ দায়িত্ব হলো বিশ্বের প্রতিটি মানুষ যাতে তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও মর্যাদার উপযোগী অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার ভোগ করতে পারে তার ব্যবস্থা করা। মানবাধিকার সংক্রান্ত ঘোষণা অনুযায়ী আমাদের আন্তর্জাতিক দায়িত্ব এমনভাবে পালন করতে হবে যাতে প্রতিটি মানুষ নিজের ও পরিবারের সুখ-সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় জীবনধারণের মান প্রতিষ্ঠার নিশ্চয়তা লাভ করে। আন্তর্জাতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, সমঝোতা ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশই যে অর্থনৈতিক দুরবস্থা দূর করতে সক্ষম সে সম্পর্কে আমরা সম্পূর্ণ সচেতন। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন, বর্তমান অস্ত্র প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। অস্ত্র প্রতিযোগিতা হ্রাস করা সম্ভব হলে অর্থনৈতিক সঙ্কট দূর করার পরিবেশই শুধু গড়ে উঠবে না, এ প্রতিযোগিতায় যে বিপুল সম্পদ অপচয় হচ্ছে তা মানবজাতির সাধারণ কল্যাণে ব্যয় করা সম্ভব হবে। বঙ্গবন্ধু বিশ্বের অসহায় বুভুক্ষু দরিদ্র মানুষের অধিকার আদায়ে তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকার কথা যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনি তাঁর বক্তৃতায় পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কামুক্ত এক শান্তিময় পৃথিবী গড়ে তোলারও দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তিনি তাঁর ভাষণে বলেন, অনাহার, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, বুভুক্ষুর তাড়নায় জর্জরিত, পারমাণবিক যুদ্ধের দ্বারা সম্পূর্ণ ধ্বংস হওয়ার শঙ্কায় শিহরিত বিভীষিকাময় জগতের দিকে আমরা এগুবো না, আমরা তাকাব এমন এক পৃথিবীর দিকে যেখানে বিজ্ঞান ও কারিগরি জ্ঞানের বিস্ময়কর অগ্রগতির যুগে মানুষের সৃষ্টি ক্ষমতা ও বিরাট সাফল্য আমাদের জন্য এক শঙ্কামুক্ত উন্নত ভবিষ্যত গঠনে সক্ষম। এই ভবিষ্যত হবে পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা থেকে মুক্ত। বিশ্বের সকল সম্পদ ও কারিগরি জ্ঞানের সুষ্ঠু বণ্টনের দ্বারা এমন কল্যাণের দ্বার খুলে দেয়া যাবে সেখানে প্রত্যেক মানুষ সুখী ও সম্মানজনক জীবনের ন্যূনতম নিশ্চয়তা লাভ করবে। ৭ মার্চ ১৯৭১ এবং ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪-এর প্রেক্ষাপট ভিন্ন। ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর স্বাধিকার আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি, যুদ্ধের প্রস্তুতিমূলক দিক-নির্দেশনা। এত সুন্দর, স্বচ্ছ ও অপরূপ বাচনভঙ্গিমাময় বক্তৃতা আজ পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাসে আর কেউ দিতে পারেনি। উক্ত ভাষণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সম্মোহনী শক্তি, যে শক্তি মানুষকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করেছিল। আর এই অনন্য কীর্তির জন্য ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ভাষণ আর বঙ্গবন্ধু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী। ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪-এ জাতিসংঘের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর প্রদত্ত ভাষণটি যেমন ছিল সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ উচ্চারণ, তেমনি বিশ্বের অধিকার বঞ্চিত মানুষের ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠার এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা, পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা হ্রাস, শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান, কোন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এবং সার্বভৌমত্বের প্রতি হস্তক্ষেপ না করা, সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিক-নির্দেশনা ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রদত্ত ভাষণে। জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকে আজ পর্যন্ত কোন রাষ্ট্রনায়ক এত সুন্দর, গঠনমূলক এবং ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সাহসী বক্তব্য দিতে পেরেছেন কি-না সন্দেহ রয়েছে। অথচ বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণটি নিয়ে আজ পর্যন্ত কোন আন্তর্জাতিক সংস্থা গবেষণা করেনি। আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনেসকো ভাষণটির যথাযথ মূল্যায়ন করলে জাতিসংঘে প্রদত্ত সকল রাষ্ট্রনায়কের ভাষণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার দাবি রাখে। লেখক : বীমা ব্যক্তিত্ব, গীতিকার ও প্রাবন্ধিক
×