ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

৬৬-তে পা রাখলেন ‘বাংলার মোহাম্মদ আলী’...

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ৩ মার্চ ২০১৮

৬৬-তে পা রাখলেন ‘বাংলার মোহাম্মদ আলী’...

রুমেল খান ॥ মারামারির খেলা বক্সিং বিশ্বে অনেক জনপ্রিয় খেলা। এ খেলাটিতে অসংখ্য গ্রেট বক্সার এসেছেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে সেরা বক্সার যুক্তরাষ্ট্রের মোহাম্মদ আলী। বাংলাদেশেও একবার এসেছিলেন এই ‘গ্রেটেস্ট’। একটি ছবি উঠিয়েছিলেন আবদুল হালিমের সঙ্গে, যাকে বলা হতো ‘বাংলার মোহাম্মদ আলী’। আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের পক্ষে যিনি সর্বপ্রথম পদক জিতেছিলেন, তিনি হচ্ছেন এই হালিম। ১৯৭৭ সালে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় অনুষ্ঠিত ‘এশিয়ান বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপে’ অংশ নিয়ে হালিম জিতেছিলেন তাম্রপদক। সেই হালিমের ৬৫তম জন্মদিন ছিল শুক্রবার। যদিও তার সার্টিফিকেটের জন্মদিন ভিন্ন। এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে তিনি মজা করে বলেন, ‘বাঙালীদের আসলে দু’বার জন্ম হয়। একবার মায়ের পেটে, আরেকবার স্কুলে। স্কুলের সার্টিফিকেট অনুযায়ী আমার জন্ম তারিখ ১৫ জানুয়ারি, ১৯৫৫। আর প্রকৃত জন্ম তারিখ ২ মার্চ, ১৯৫৩।’ যাহোক, নিজের ফেসবুকে প্রকৃত জন্ম তারিখই দিয়েছেন এক ছেলে, এক মেয়ের জনক হালিম। শুভেচ্ছা কেমন পেয়েছেন? অনুভূতি কেমন? ‘প্রচুর শুভেচ্ছা পেয়েছি। অনেকে ফোনে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। খুব ভাল লাগছে। তবে আমি নিজে জন্মদিন পালন করি না। কিন্তু বাসায় গেলে আমার স্ত্রী ভালমন্দ কিছু রান্না করে খাওয়ায়। পরিবারের সবাইকে নিয়ে এক সঙ্গে খাই। এটাই আমার জন্মদিন পালনের নমুনা।’ বাংলাদেশের অনেক ক্রীড়াবিদ বর্তমানে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ক্রীড়ায় অনেক পদক পাচ্ছে। ভবিষ্যতেও পাবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রীড়ায় বাংলাদেশের প্রথম পদক জয়ী ক্রীড়াবিদ হিসেবে হালিমের নামটি স্বমহিমায় থেকে যাবে চিরকাল। ১৯৭৭ সালে ইন্দোনেশিয়ার জার্কাতায় অনুষ্ঠিত ‘এশিয়ান বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপে’র অষ্টম আসরে লাইট ফ্লাইওয়েটে ১০৫ পাউন্ড (তখন কেজির চল ছিল না) ওজন শ্রেণীতে সেমিতে ইন্দোনেশিয়ার হেরি মাইতিমুর কাছে মাত্র ১ পয়েন্টে হেরে তাম্রপদক লাভ করেন হালিম। আন্তর্জাতিক যে কোন ক্রীড়ায় ওটাই ছিল বাংলাদেশের প্রথম কোন পদক জয়ের ঘটনা। আন্তর্জাতিক কোন খেলায় সফল হওয়ায় বাংলাদেশের পতাকা উড়তে দেখে সেদিন তার যা অনুভূতি হয়েছিল তা কোনদিনও ভুলবেন না। ওই সময় গ্যালারিতে উপস্থিত বাংলাদেশী অসংখ্য দর্শক এবং বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূত আবেগে কেঁদে ফেলার দৃশ্য আজও মনে আছে তার। ’ বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সব পুরস্কারই পেয়েছেন হালিম। যেমন : ১৯৭৬ সালে বক্সিং ফেডারেশনের বর্ষসেরা বক্সার পুরস্কার, ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতি পুরস্কার, ১৯৭৭ সালে জগন্নাথ কলেজের ‘ব্লু’, ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ব্লু’, ২০০৪ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার এবং ২০১৬ সালে ‘আমাদের প্রথম’ প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কার। জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। মোট কথা, নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে পুরোপুরি সন্তুষ্ট এবং গর্বিতই হালিম। ১৯৬৮ সালে বক্সিং শুরু করে অবসর নেন ১৯৮০ সালে। এই সময়ে ঘরোয়াভাবে খেলেছেন যথাক্রমে বস্ত্রশিল্প সংস্থা, মেট্রোপলিশ (বর্তমানে মহানগর), বিওএম (বক্সার অব মতিন) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যানেজমেন্টে ১৯৮০ সালে মাস্টার্স করা হালিম বক্সার হিসেবে অবসর নেয়ার পর ১৯৮৪ সালে বিয়ে করেন। সে জন্য তার স্ত্রী এবং সন্তানরা কেউই হালিমের খেলা দেখেনি। এ জন্য আক্ষেপ হয় হালিমের। অন্য ক্রীড়াবিদরা যা সচরাচর করেন না, সেটাই করেছেন হালিম। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে চাকরি করেছেন (১৯৮৯-২০১৪) জেলা ক্রীড়া অফিসার হিসেবে। মোট ১২ জেলায় বহু বছর চাকরি করেছেন। এছাড়া বক্সিং ফেডারেশনেও যুগ্ম সম্পাদক, নির্বাচক কমিটির সদস্য, বক্সিং রেফারিজ-জাজ এ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক, বাংলাদেশ পাঞ্জা ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক হিসেবেও বিভিন্ন সময়ে কাজ করেছেন। জাতীয় বক্সিং কোচ হিসেবেও হালিমের কাজ করার অভিজ্ঞতা ব্যাপক। জার্মানিতে থেকে বক্সিং কোচেস কোর্সও করেছেন। কদিন পর বাংলাদেশ যুব গেমস শেষ হলেই বিকেএসপিতে ২১ দিনের একটি কোচেস ট্রেনিং কোর্স করবেন তিনি। হালিমের আগে দু’বার (একবার সরকারী কর্মকর্তা ও আরেকবার ক্রীড়াবিদ হিসেবে) রাজউকের প্লটের জন্য আবেদন করেছিলেন। কিন্তু কোনবারই প্লট পাননি। এ নিয়ে বিস্তর আক্ষেপ আছে তার। থাকেন ভাড়া বাসায়। পেনশন যা পান তা দিয়ে কোনমতে সংসার চালান। ছেলেমেয়ের পড়াশোনায় প্রচুর খরচ জোগাতে হিমশিম খান। ওদের পড়াশোনার খরচ জোগাতে বিভিন্ন সার্ভিসেস সংস্থায় বক্সিংয়ের খ-কালীন কোচ হিসেবে কাজ করেন। সরকারীভাবে প্লট পাওয়ার সৌভাগ্য আদৌ হবে কী আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের প্রথম পদক জয়ী ক্রীড়াবিদ হালিমের?
×