এ লেখা ছাপা হবে শনিবার। মাঝে একদিন। লিখছি আজ বৃহস্পতিবার ১ মার্চ ২০১৮। অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা, অনেক ঐতিহাসিক দিন, অনেক স্মরণীয় অর্জনের মাস মার্চ। এ মাসেই বাঙালী জাতির হাজার বছরের বিচ্ছিন্ন ইতিহাসগুলো একই মোহনায় মিলিত হয়ে কালজয়ী মহাকাব্যটি রচনা করেছিল যার নাম বাঙালীর আপন জাতি-রাষ্ট্র বাংলাদেশ এবং যার স্রষ্টা এক ক্ষণজন্মা পুরুষ টুঙ্গিপাড়ার শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালী তাঁকে ডাকে হাজার বছরের সবচে সাহসী, সবচে দূরদর্শী, সবচে দেশপ্রেমিক সন্তান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলে। পরিবারে তাঁকে ডাকা হতো খোকা বলে আর গ্রামবাংলার মানুষ ডাকত শেখের বেটা, শেখ মুজিব বা মুজিব ভাই বলে। রাজনৈতিক অঙ্গনেও ছিলেন সকলের মুজিব ভাই। এই মার্চ মাস এমন যে, এ মাসে যেমন স্বপ্ন পূরণের দিনক্ষণ আছে, তেমনি রক্তঝরার বেদনা আছে। এমন একটি দিনও ছিল না বা এমন একটি রাজপথ ছিল না যেখানে মিছিল হয়নি, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বা ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ বলে স্লোগান উচ্চারিত হয়নি, বুকের রক্ত ঝরেনি। ২৫ মার্চ রাতে কেবল ঢাকায় পাকিস্তানী হানাদার মিলিটারির বুলেটে রক্ত ঝরেছে হাজারে, হাজারে লাখে লাখে। সেইসব শহীদের সন্তানদের কাছে দিনটি আসে কালো ছায়া নিয়ে। এই মার্চ মাস এক একটি দিন, এক একটি ক্ষণ এক একটি ইতিহাস রচনা করেছে, যা আজও প্রতিটি বাঙালীর হৃদয়তন্ত্রীতে নাড়া দেয়, রক্ত ঝরায়। এখানে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিন আলোচনা করব এ জন্যে যে, নতুন প্রজন্মের সামনে দিনগুলো তুলে ধরতে চাই। তাদের মনোজগতে মূলধারার চিত্র এঁকে দিতে। একটা গোষ্ঠী আছে যারা জাতির পিতার হত্যার পর মিলিটারি শাসক জিয়াউর রহমানের হাত ধরে আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হয়। এই গোষ্ঠীর নাম মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটি, মুসলিম লীগ, জামায়াত, ছাত্রসংঘ। এদের মনোজগতে সেদিনেও ‘চাঁদ-তারা’ পতাকা আঁকা ছিল, আজও আছে। জিয়া সাম্প্রদায়িক দেশদ্রোহীদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে ঢ়ড়ষরঃরপং ড়ভ নধষধহপব (ভারসাম্যের রাজনীতি)-এর কথা বলে সেদিন যে চারা গাছটি রোপণ করেছিলেন পরবর্তীতে খালেদা, সাত্তার, এরশাদের পরিচর্যায় বিশেষ, করে খালেদা জিয়ার হার্ট-টু-হার্ট সম্পর্কের সুযোগে আজ তা জঙ্গীবাদের বিষবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। জাতির সৌভাগ্য যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে আওয়ামী লীগ তথা মূলধারার বাঙালীকে নিশ্চিহ্ন করা যায়নি, তেমনি আল্লাহর রহমতে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার হাতে জাতির হাল তুলে দিয়েছে বাঙালী। তিনি জিরো টলারেন্সের মাধ্যমে জঙ্গীবাদ নির্মূল করে চলেছেন। অনুন্নত দেশকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যা আজ বিশ্বের বিস্ময়, এটা যেমন সত্য তেমনি যাদের মনে এখনও ‘চাঁদ-তারা’ পতাকা তা সম্পূর্ণ দূর করতে শেখ হাসিনাকে আরও সময় দিতে হবে। এটি আজ অনস্বীকার্য, এমনকি বহির্বিশ্বও শেখ হাসিনার মেধা ও দক্ষতায় বিস্মিত এবং সঠিক পথে রাষ্ট্র পরিচালনায় তার কোন বিকল্প এখনও জন্ম হয়নি। আমরা তো অনেককেই দেখলাম কই তাদের হাতেগড়া একটি দৃশ্যমান উদাহরণ কি আছে? নেই। থাকবে কোত্থেকে? এদের কেউ মিলিটারি স্বৈরাচার, কেউ দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত, কেউ কারাভ্যন্তরে, কেউ সাজা কাঁধে করে ফিউজিটিভ (পলাতক)। অবশ্য এটি ওপেন সিক্রেট যে, এই ফিউজিটিভি লন্ডনের এক পশ এলাকায় সস্ত্রীক সসন্তান আয়েশের জীবনযাপন করছেন। দুর্নীতি তাদের আয়েশী জীবন দিয়েছে। শেখ হাসিনা এখানেই এক এবং ব্যতিক্রম। এই সুযোগে দু’একটা উদাহরণ দিতে চাই (২০০৮-এর নির্বাচন ভিত্তি ধরে)। তখন মাথাপিছু আয় ছিল ৫২০ মার্কিন ডলার আর এখন ১৬১০ ডলার; তখন খাদ্য ঘাটতি ছিল প্রায় ৩০ লাখ টন আর এখন বাংলাদেশ খাদ্য রফতানি করছে; তখন জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ প্লাস-মাইনাস আর এখন ৭ প্লাস-মাইনাস এবং তাও অব্যাহতভাবে ২০০৮-এর নির্বাচন থেকে আজ পর্যন্ত। প্রথম পদ্মা সেতুর কাজ ৫০ শতাংশ সম্পন্ন করে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দিয়ে প্রস্তুতি চলছে। পায়রা বন্দর, রামপাল বিদ্যুত প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প, ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েতে ৩টি বিকল্প সেতু, মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুযায়ী সীমান্ত সঙ্কট তথা সিটমহল সঙ্কটের সমাধান, সমুদ্রসীমা নির্ধারণ- এ সব কি আর কারও সঙ্গে তুলনা হয়? বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, বিডিআর হত্যাকান্ডের বিচার- এসব কারও দ্বারা সম্ভব হতো কি? যে কারণে বিশ্বের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট ডিগ্রী, স্টার অব দ্য ইস্ট, চ্যাম্পিয়ন্স অব দ্য আর্থ, সেরেস- এমনি পুরস্কার এনে বাঙালী জাতি ও রাষ্ট্রকে গৌরবান্বিত করেছেন। বিশেষ করে রোহিঙ্গা শরণার্থী সঙ্কট সমাধানে তার কূটনৈতিক সাফল্য, মানবিকতা বিশ্বকে বাংলাদেশের পাশে এনে দাঁড় করিয়েছে। ব্রিটিশ মিডিয়া তো Mother of humanity (মানবিকতার জননী) সম্মানে ভূষিত করেছে। যদিও কেবল বাংলার নেত্রী হওয়ায় এখনও নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়নি। গত বছর যখন আলোচনায় আসেন তখন আবার এই বাংলাদেশ থেকেও বিরোধিতা করা হয়েছে। শেখ হাসিনা মূলধারার নেতা বলেই এত অর্জন এনেছেন, এত বিরোধিতা সত্ত্বেও।
এই মার্চ মাসে কয়েকটি দিনের তাৎপর্য যা আমাদের স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মাইলফলক হয়ে আছে-
১. এই মার্চ মাসেরই ১৭ তারিখ (১৯২০ সাল) বাঙালীর মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্ম হয় ভূমি রাজনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ দক্ষিণ বাংলার গোলাপগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে বনেদি শেখ পরিবারে। গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুলে ৯ম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে তাঁর মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা জাগে। সেই থেকে তিনি তাঁর লক্ষ্য অর্জনে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক জেল-জুলুম-নির্যাতন তোয়াক্কা না করে এগিয়ে গেছেন এবং বাঙালীর আপন জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন্তু যাঁকে পাকিস্তান-আমেরিকা হত্যা করতে সাহস পায়নি তাঁকেই হত্যা করল কতিপয় বাঙালী কুসন্তান মিলিটারি। মাত্র ৫৫ বছর বয়সে। তাঁকে সেদিন হত্যা না করলে বা তিনি বেঁচে থাকলে ৭০/৮০র দশকেই বাংলাদেশ ফবাবষড়ঢ়রহম country বা উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হতো। তবু আল্লাহ পাকের প্রতি শুকরিয়া কাজটি সম্পন্ন হলো তাঁরই কন্যার হাত দিয়ে।
২. পুরো মার্চ মাসে চলছিল বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলন, যা বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে নজিরবিহীন, এমনকি ভারতের মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগও ছিল বঙ্গবন্ধুর অসহযোগের তুলনায় অনেক ছোট। অসহযোগ আন্দোলনের সময় বাংলাদেশের প্রশাসন চলেছে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। তাঁর ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাসভবন বা আওয়ামী লীগের কার্যালয় থেকে যে নির্দেশ যেত রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলেও তা অক্ষরে অক্ষরে পালিত হয়েছে। এমন নজির কি কোথাও আছে?
৩. এই মার্চ মাসেরই তিন তারিখ পল্টন ময়দানে তৎকালীন ছাত্রলীগের সমাবেশে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন। এই সমাবেশে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হবে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের গান ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি...।’ অবশ্য এর বহু আগেই বঙ্গবন্ধু এই গান জাতীয় সঙ্গীত করার কথা অনেককে বলেছেন, যেমন রবীন্দ্র সঙ্গীতজ্ঞ সানজিদা খাতুন এক টিভি সাক্ষাতকারে বলেছেন, ১৯৫৪ সালেই বঙ্গবন্ধু তাকে এই গানটি জনপ্রিয় করার কথা বলেছেন। জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী জাহেদুর রহিমকে ১৯৬২ সালে এই গান জনপ্রিয় করার কথা বলেন। লক্ষ্য একে জাতীয় সঙ্গীত করা।
৪. ৭ মার্চ ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১০ লাখ বাঙালীর উত্তাল জনসমুদ্রে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ার এবং যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার কথা বলেন। তাঁর ঘোষণা ছিল ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ মূলত এটি ছিল স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণা। কিন্তু নেতাজী বা বায়াপ্রার মতো তিনি যাতে ব্যর্থ না হন বা বিচ্ছিন্নতাবাদিতার অপবাদ নিতে না হয় সেজন্যে পার্লামেন্টে যাওয়ার জন্যে ৪ দফা দেন :
ক. সামরিক আইন প্রত্যাহার
খ. সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে প্রেরণ
গ. যত হত্যাকান্ড হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে এবং
ঘ. জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। এটি ছিল তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা।
৫. যেমন ছিল ২৬ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে তিনি আত্মগোপন করেননি। কারণ নেতাজীর উদাহরণ সামনে ছিল।
৬. ২৫ মার্চ আরেকটি দিন আগেই বলেছি এদিন আর্মি ক্র্যাকডাউন হয়। অপারেশন সার্চলাইট নাম দিয়ে ২৫ মার্চ রাত ৮টা থেকেই মিলিটারি ট্যাংক ধানম-ি ৩২ নম্বরের বাসভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স বা পিলখানায় নিরস্ত্র মানুষের ওপর আক্রমণ শুরু করে এবং হাজার হাজার ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে। এ সংখ্যা লাখও হতে পারে।
এই মার্চের ১ তারিখ জল্লাদ ইয়াহিয়া পার্লামেন্ট অধিবেশন স্থগিত করে দেন এবং ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে ঘুমন্ত নিরস্ত্র মানুষের ওপর ট্যাংক তুলে দিয়ে কামান দাগিয়ে মানুষ হত্যা করেন। বলেন, Mujib is a traitor, this time he will not go unpunished.
ঢাকা ॥ ১ মার্চ ২০১৮
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি
জাতীয় প্রেসক্লাব