ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ইলিয়াস বাবর

কবিতা ভাবনা ও গুচ্ছ কবিতা ॥ সভ্যতার মানবিক দলিলের নাম কবিতা

প্রকাশিত: ০৭:২৩, ২ মার্চ ২০১৮

কবিতা ভাবনা ও গুচ্ছ কবিতা ॥ সভ্যতার মানবিক দলিলের নাম কবিতা

না, কবিতা হুট করেই আসে না আমার। দারুণ কোন প্রবন্ধ কি গল্প পড়ার ফাঁকে পেয়ে যেতে হয় উদ্দিষ্ট শব্দ কিংবা ইতিাহাসগ্রন্থ কি বিদেশী বই-পাঠে অথবা মুরব্বিগোছের কারো মুখচলতি প্রায় অপ্রচলিত শব্দের সামাজিক প্রেক্ষাপটে খুড়ে আনি কবিতা। তাতে কবিতার শরীরে লেগে থাকে কাদামাটি, গ্রাম-শহর খেলা, ইতিহাসের সরাৎসার, বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার দলিল, মানুষেরই হৃদয়-হননের খতিয়ান। পুতুপুতু কবিতা যাপনের সময় এখন নয়, টীকা দিয়ে, ছন্দজ্ঞানহীন কবিতা চালনার সময়ও অতীত; ফলে আমাদের যেতে হয় নানামুখী চ্যালেঞ্জের পথে- যেটা কবিতায় খাঁটি করে নিতে হয় উচ্চমার্গীয় চেতনাপুঞ্জে, স্বাদেশিক প্রেক্ষাপট আর অতীতের পাঠমন্থনে। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক মনন থাকতে হয় কবিকে- স্বভাবকবির যুগ শেষ তা ভুলে যাওয়া উচিত হয় না কোনমতেই। তাছাড়া প্রতিনিয়ত অকল্পনীয় সব ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছি আমরা, দৈশিক এবং বৈশি^ক প্রেক্ষাপটে তা নিশ্চয়ই গুরুত্ববহ কিন্তু কবিতার শরীরে তা কতটুকু আসতে পারে সেই পরিমিতিবোধ কবিকে আত্মস্থ করতে হয় নিয়মিত পাঠ আর অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই। মহৎ কবিদের কবিতায় এসব আছে বলেই তারা উদাহরণের বরমাল্যে ভূষিত, দুর্দিনের আশ্রয়দাতা। সে হিসেবে আজকের যে তরুণটি কবিতায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছে সে স্বকালের আর সব কবিদের প্রতিদ্বন্দ্বী তো বটেই তার সমুখের ছায়াগুলোও সরিয়ে স্বাতন্ত্র্যবোধে চিহ্নিত করার বাসনা রাখতে হয়। আমি কবিতাযাপনে বিস্মৃত হতে পারি না আমার মায়ের মুখ- সেই সঙ্গে স্বদেশ আর যাপনের বিবমিষা ও ক্লেদজ কুসুম। ফলে একটা হাহাকার, একটা প্রশ্ন ক্রমশ হেঁটে যায় আমার কবিতা ধরে। হিসেবের গরমিল থাক, পার্থিব চাহিদায় পড়ে থাক অপূর্ণতার ছাপ- তবুও কবিতার ধ্যানে নিজেকে মগ্ন করতে প্রেষণা দেয় জলকদরের জল, ইকোপার্কের সবুজ মায়া। কানকথার উসকানিতে কবিতা হোক আমাদের সময়ের স্বাক্ষর। প্রেমপত্র হারিয়ে যাক তাতে কী! মুঠোফোনের ওয়েলকাম টোনে কবিতা বাজে এখন, এক ক্লিকে ঘুরে আসা যায় পৃথিবীর তাবৎ প্রান্ত থেকে, সময়ের প্রয়োজনে প্রাযুক্তিক সুবিধা নিয়ে কবিকে হতে হবে স্মার্ট, কবিতাকে হতে হবে মানবিক দলিল। ** শরতসঙ্গীত ওসব বুঝি না সোনা, আমার হৃদয়ে এখন জলসা- পৃথিবীর রমনীকূলকে প্রত্যাখ্যান করে মাতোয়ারা আছি বেশ রক্তের... তেলখনির... দখলের হিসেবে আমি নেই! শুভ্রতার নহর আমাকে মানুষ বানায় গাইতে শেখায় কণ্ঠভরা মিলনের সুধা-সুর ঘৃণার জটিল মঞ্চে হাসতে পারাও তো গৌরবের! আমি তোমার গোলাম- সাথে থাকার শর্তে হে শরৎ, বিলিয়ে যাও পবিত্রতা; এ-অমানুষের হৃদয়হীনতার বদলে... ** নদীও মানুষের লাহান মানুষের ভেতরে থাকে নদী- জল ছলছল ঢেউ-এ উন্মাতাল নদীর শরীর দুখ আর সুখের আঁচড় ফেলে... জীর্ণতা নদীরও আছে; অসাড় হয় এক সময় ভালোবাসার ড্রেসিঙের অভাবে হাশপাশ করে ওদিকে- ওপক্ষের যন্ত্রণায় বুকে দেখা দেয় আলসারের আলামত বুকের উপর দিব্যি বয়ে চলা সংসারটি জানে না- কখনোসখনো মাঝিও বোঝে না কেমন চালায়! কেমন জানি অচেনা হয়ে যায় বৈঠা, নাগর... নদীকে বাঁচতে হয় বেদনা নিয়ে- কত নদী মরে, কত নদী মারে, কত নদী জন্মায় তবুও থেকে যায় নদীবিষয়ক বা হৃদয়বিষয়ক বিস্তর থিসিস মানুষ নিয়ে পিএইচডি করা বিশেষজ্ঞটি বলেন- নদীকে ভালোবাসো নদীকে ভালোবাসো নদীকে ভালোবাসো... ** ওজনদার মুখ মুখের দিকে চেয়ে থাকি অপলক- আমার দাদা কিংবা তারও দাদারাও কি এমন ছিলো? কেবলি চেয়ে থাকি- সুরমারঙা মেয়ের মুখে- অপূর্ব কথাসিঞ্চনে ভুলে যাই অপবাদ কোন চন্দনে মাখো কণ্ঠনালী? চর্যাপদের পৃষ্ঠায় জেগে রাখা অমৃত কে ভোগ করাবে আর! গিরিশচন্দ্র সেন হৃদয়ঙ্গম করেছিল সেদিন পৃথিবীতে সুখি হতে চাই- পরানের কিরা অবশেষে আমিও যেনে যাই- সুষমা-স্বরাজ। চেয়ে থাকার চিরনতুন অভিজ্ঞান জানান দেয়- ওর মুখ সুন্দর কেবলি কথার গুনে ‘তোমাকে ভলোবাসি’ বলার ওজনে... ** শহরবানু- শৈশবের রূপবান কবিতার হৃদয়ে এঁকেছি শহরবানুর মুখ- উজ্জ্বল দূর থেকে কাছে ডাকে দিঘীর জল টলোমল! আর শুনি যৌবনভরা মাঠে শেয়ালের আর্তস্বর কুকুর যাই হোক শিয়ালে তবে অরুচি নেই মান্যবর। কাছে আসে অমাবস্যার রাত- অচেনা হাত চোরামির ফাঁকে মালিকও চায় বেগানা জান্নাত! শহরবানু গেঁয়ো হয়েও জানে তিহাত্তুর ফাঁদ ওখানে সাঁতার কাটে, ওখানে নেই কঠিন বাঁধ। পতিহারা দাদি আমার, চেনায় শরীর-পথ মাথায় হাত রেখে সেদিন নিয়েছিল বেদম শপথ! শহরবানুর মানচিত্রে ক্ষুধা আর কামের জোয়ার হলফ কাটি দাদির লাহান তারে খোঁজে বেশুমার... ** রক্তের অনুবাদ ব-দ্বীপের বুক জুড়ে ভেসে আসা বিউগলের সুর ক্ষত-বিক্ষত করে দেয় হৃদয়ের জমিন; দৃষ্টির সীমানায় তাঁর প্রতিবিম্ব যেন- প্রতিক্ষণে পাঠ দিয়ে যায় সবুজ তারস্বরে নিঃসঙ্গ পেঁচাটির চিৎকারের তর্জমা- মধ্যরাতে চুরি হওয়া স্বপ্নের তাবির পাপী বুলেটের অশ্রুসজল কোরাস... সেই থেকে লালের দরিয়ায় সাঁতার কাটছি বলে আমাদের দুঃখগুলোর সুসংবদ্ধ ইশতিহার আজ উদ্ধার হতে চায়-পিতার তর্জনী মহিমায় ক্রমশ : লাল হতে থাকা সবুজ আমাদের ভালবাসা আর বেদনার নিদর্শন; যার ওপিঠে ঘুমায় গণদেবতা- আমাদের পিতা! ** রাষ্ট্র এবং কবি রাষ্ট্র জানে না রাতের জোছনা-রূপ জানে না কখন মেঘ হতে পারে। রাষ্ট্রের জানার লোভ নেই কখন নামবে বৃষ্টি কেবল আবহাওয়া বার্তায় শুনিয়ে দেয় সান্ত¡না... সংবিধানে স্বীকৃত নেই প্রণয়ের কাল কোথায় তবে খোদিত হবে কঙ্কালে দুখ! রাষ্ট্র জানেই না মানুষ কখন প্রেমে পড়ে- কেবল মনে রাখে কাঁটাতারের ইঞ্চি-মিটার অপেক্ষায় থাকে পরাশক্তির স্কেলে উঠার... শুধু কবিই জানে হৃদয়ের দরদাম আঁজলা ভরে মৃত্যুকে ডাকে প্রেমিকার মতোন! কবি কি তবে রাষ্ট্রেরও বড় প্রতিষ্ঠান? একাকী হেঁটে আসা দূরবর্তী পাহাড়!
×