ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আশরাফ পিন্টু

বনফুল ॥ বাংলা অণুগল্পের পথিকৃৎ

প্রকাশিত: ০৭:১৯, ২ মার্চ ২০১৮

বনফুল ॥ বাংলা অণুগল্পের পথিকৃৎ

বাংলা সাহিত্যের বহু শাখা-প্রশাখা রয়েছে। উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, কবিতা প্রভৃতি। অণুগল্পও বাংলা সাহিত্যের একটি নবতর শাখা। এই নবতর শাখাটি বাংলা কথাসাহিত্যে ভিন্নমাত্রা সৃষ্টি করেছে। অণুগল্পে সবকিছু বলে দেয়া হয় না, শুধু ইঙ্গিত করা হয়। পাঠক সেই ইঙ্গিত অনুযায়ী এগিয়ে যায়। অণুগল্প একটি শাণিত শরের নাম; যার একমাত্র উদ্দেশ্য লক্ষ্যভেদী হওয়া। অণুগল্পের প্রতিটি শব্দ-বাক্য এমন কি যতি চিহ্ন পর্যন্ত একেকটি অগ্নিকণার ভূমিকা পালন করে। অণুগল্প অত্যন্ত সুনিয়ন্ত্রিত। এর আকার, অবস্থান, বোধ, ঘনত্ব তথা সার্বিক পরিবেশ বাষ্পীয় মনে হলেও অস্তিত্বমান। সাহিত্যের অন্যান্য শাখার এক ধরনের সংজ্ঞা পাওয়া গেলেও অণুগল্পকে ঠিক সংজ্ঞায়িত করা যায়নি। এ যেন এক মায়াবী ব্যাপার, কিছুটা কুয়াশাচ্ছন্ন আলো-আঁধারির খেলা। স্বপ্নের মতো ঘোর লেগে যায় অণুগল্প সম্পর্কে ভাবতে গেলে। মূলত অণুগল্প এক শক্তিশালী বোধ এবং চিরন্তন প্রজ্ঞার সারসংক্ষেপ। বিশ্বসাহিত্যে প্রথম অণুগল্প পাই আমরা ঈশপের গল্পে। এর পর ভারতীয় উপমহাদেশে পঞ্চতন্ত্র, হিতোপদেশ গল্পগুলো। তবে এগুলো ছিল মৌখিক সাহিত্য। ফ্রানৎস কাফকার অণুগল্প বা প্যারাবোলার বিষয়টি বিশ্বের বিভিন্ন দিকে পরিচিতি লাভ করে। ‘ঝধষব ভড়ৎ ধ নধনু’ং ংযড়বং, হবাবৎ বিধৎÑ’ বিক্রির জন্য শিশুর জুতা, ব্যবহৃত নয়। এই অণুগল্পটির লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে। যেটি পৃথিবীর সবচেয়ে ছোটগল্প। পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট গল্পটি ছিল মাত্র ৬ শব্দের! বাংলায় যা অণুগল্প, হিন্দীতে তা লঘুকথা। বাংলার চেয়ে হিন্দীতে অণুগল্প বা লঘুকথার চর্চা অনেকটা বেশি। বাংলা সাহিত্যে সর্ব প্রথম অণুগল্প লেখেন বনফুল বা বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (১৯ জুলাই ১৮৯৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯)। তাঁর গল্পগুলো অর্ধ পৃষ্ঠা, এক পৃষ্ঠা কিংবা দুই পৃষ্ঠা পর্যন্ত সীমায়ত। তবে এক পৃষ্ঠা, অর্ধ পৃষ্ঠা কিংবা এক পঙ্ক্তিতে সমাপ্ত গল্পের দৃষ্টান্ত ইংরেজী সাহিত্য দুর্লভ নয়। সাহিত্যের পরিভাষায় একে বলা হয় ‘ঋরাব সরহরঁঃব ড়ভ ংযড়ৎঃ ংঃড়ৎু’ বা ‘ংযড়ৎঃ ংযড়ৎঃ ংঃড়ৎু.’ বাংলা পরিভাষা করলে হয় অণুগল্প ইউরোপে ঈশপের গল্প, ভারতবর্ষে জাতকের গল্প, পঞ্চতন্ত্র, হিতোপদেশ প্রভৃতি বনফুলের অণুগল্পের পূর্বতন মৌখিক ঐতিহ্যের নিদর্শন। এরপর আধুনিক (লিখিত) সাহিত্যে পাই বনফুলের অণুগল্প। তবে তিনি সেই অণুগল্পগুলো ছোটগল্পের সঙ্গে এক কভারের গ্রন্থে এনেছেন। সেগুলোকে স্বাতন্ত্র্যতা দিয়ে ভিন্ন গ্রন্থে গ্রন্থিত করে যাননি। বনফুল ছোটগল্প যেমন সিদ্ধহস্ত তেমনি অণুগল্পেও; যদিও তিনি তাঁর অণুগল্পগুলোকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করেননি। অবশ্য তখন ‘অণুগল্প’ কথাটি সাহিত্যে স্বাতন্ত্র্য মর্যাদার আসন লাভ করেনি। তাঁর অধিকাংশ অণুগল্প রূপক ও প্রতীকধর্মী। এখন আমরা তাঁর কয়েকটি অণুগল্পের আলোচনা ও স্বরূপ বিশ্লেষণের চেষ্টা করব। প্রথমে আসা যাক ‘নিমগাছ’ শিরোনামের গল্পটি। অর্ধ-পৃষ্ঠার এই ছোট্ট অবয়বের অণুগল্পটিতে ফুটে উঠেছে এক অসাধারণ কাব্যিক ব্যঞ্জনা। কবিতার ভাষার মতোই কথাগুলোÑ ‘কেউ ছালটা ছাড়িয়ে নিয়ে সিদ্ধ করছে। পাতাগুলো ছিঁড়ে শিলে পিষছে কেউ। কেউ বা ভাজছে গরম তেলে।...’ সমগ্র গল্পটিতে এমনি কাব্যিক ও রূপক বর্ণনা। একেবারে শেষ লাইনটিতে যখন লেখক বলেন, ‘ও বাড়ির গৃহকর্ম-লক্ষ্মী বউটার ঠিক এক দশা।’ তখন গল্পের সমগ্র প্রতীকী রূপ ছাপিয়ে জীবন সত্যই মূর্ত হয়ে ওঠে। এই শেষ লাইনটির মধ্যেই গল্পের সারসত্য নিহিত। এমন আরেকটি প্রতীকী অণুগল্পের নাম হলোÑ ‘অতি ছোটগল্প’। দুটি জড়বস্তুর মধ্যে লেখক প্রাণ বা চেতনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। দু’জন মানব-মানবীর মতো কথা বলছে দীপশিখা ও হাওয়া। একটি দীপশিখা একাকী জ্বলছিল এক ঘরের কোণে। একটু পরেই সে কাঁপতে লাগল। এই কাঁপুনির কারণ ঘরে হাওয়া ঢুকেছে। দীপশিখা যেন হাওয়ার বাহুডোরে বাধা পড়েছে। দু’জনের কথোপকথন : ‘Ñছেড়ে দাও, ওকি করছ? Ñআমাকে ছেড়ে কি থাকতে পারবে তুমি? বিজ্ঞানীরা কি বলেছে জানো? Ñকি? Ñআমার মধ্যে কি অক্সিজেন নামে এক রকম গ্যাস আছে। সেই গ্যাস নাকি মূর্ত করেছে তোমাকে শিখা রূপে। আমি না থাকলে তুমিও থাকতে না। Ñইস!...’ দীপশিখা ও হাওয়ার প্রতীকে দুজন মানব-মানবীকেই যেন আমরা খুঁজে পাই; যারা একে অপরে ব্যতীত অসহায়। ‘প্রজাপতি’ গল্পটির মধ্যেও বনফুল রূপকের মধ্যে কিছুটা অলৌকিকতা আরোপ করেছেন। গল্পকথকের স্ত্রী আশার মৃত্যুর পর পরই একটা প্রজাপতি কথকের পড়ার টেবিলে শেড দেয়া ইলেকট্রিক বাতিটার ওপর বসে। বন্ধু সোমেশ্বর তার বোনকে বিয়ে দিতে চায় কথকের সঙ্গে। কথক যখন বিয়েতে রাজি হয় তখনই ঘটে অভাবনীয় ঘটনা। হঠাৎ আশার কণ্ঠে কে যেন বলে উঠল, ‘তাহলে আমার দায়িত্বও ফুরালÑ আমিও চললাম।’ এ অণুগল্পটির একটি মনস্তাত্ত্বিক দিক রয়েছে। একজন পুরুষের একাধিক নারীর পাণি-গ্রহণে বিরোধিতা করা হয়েছে প্রজাপতি প্রতীকে। এ গল্পে প্রজাপতিটি মৃত আশারই আত্মার প্রতীক। এবার মানুষের নিয়তিকে নিয়ে দুটি গল্প আলোচনা করা যাক। একটির নাম হলো ‘আত্ম-পর’; আরেকটির নাম ‘হাসির গল্প’। ‘আত্ম-পর’ গল্পটি একেবারে ছোট্ট অবয়বের। গল্পকথক সারা সকাল খেটেখুটে দুপুরে বারান্দায় ঘুমানোর জন্য যেই শুয়েছেন অমনি খপ করে কদাকার একটি পাখির ছানা তার মুখের ওপর পড়ল। রাগে-ঘৃণায় তিনি সেটাকে উঠোনে ছুড়ে ফেলে দিলেন। তৎক্ষণাৎ একটি বিড়াল সেটিকে মুখে নিয়ে চলে গেল। শালিক পাখিদের চেঁচামেচি আর আর্তনাদ শোনা গেল। এর বছর পাঁচেক পর গল্পকথকের ছেলে সর্পাঘাতে মারা গেল। বাড়িতে কান্নার তুমুল হাহাকার। এ গল্পে সমান্তরাল ভাবে দুটো কাহিনীর অবতারণা করা হয়েছে। মানুষ আর অন্য প্রাণীদের দুঃখ-মায়া-মমতা যে এক; যা বুদ্ধিমান মানুষেরা বুঝতে পারে না। এর সঙ্গে আরেকটি মেসেজ আছে এ গল্পে তা হলোÑ অন্যের ক্ষতি করলে অমোঘ নিয়তির পরিণতিতে তার নিজেরও ক্ষতি অবশ্যম্ভাবী। ‘‘হাসির গল্প’’-এর হরিহর একজন হতদরিদ্র মানুষ। নিজে ব্যাধিতে জর্জরিত। বাড়িতে একটি মেয়ে রোগশয্যায় শায়িত। ক্ষুধার তাড়নায় বারান্দায় একটি শিশু ক্রন্দনরত, দ্বারে পাওনাদারের অশ্রাব্য উক্তি, সাংসারিক অভাব-অনটনে জর্জরিত গৃহিণী রাগে অগ্নিশর্মা। এমন পরিবেশে হাতলভাঙা চেয়ারে বসে গরম জলে পা ডুবিয়ে ‘ফুটবাথ’ নিতে নিতে হরিহর কাগজ-কলম নিয়ে ‘হাসির গল্প’ লিখতে বসেন। কারণ ‘হাসির গল্প লেখাতেই তাহার নাম’। এটাই নিয়তি। মানবজীবনকে নিয়ে নিয়তির এই রসিকতা এই ‘হাসির গল্প’ চলছে পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্ন থেকেই। ‘হাসির গল্প’-এর চেয়েও হতদরিদ্র এক ভিখারির পতœীপ্রেম তথা ভালবাসার কথা মূর্ত হয়ে উঠেছে ‘তাজমহল’ অণুগল্পটিতে। আগ্রার তাজমহলের নিকটেই এক দাতব্য চিকিৎসালয়ে ডাক্তার হয়ে এসেছেন লেখক। আউটডোর সেরে বারান্দা থেকে নামার সময় লেখকের সঙ্গে এক বৃদ্ধের দেখা হয়। তার পিঠে প্রকা- একটি ঝুড়ি বাঁধা। ঝুড়ির ভেতর একজন বোরখা পরা মহিলা বসে আছে। লেখক কাছে যেতেই উৎকট দুর্গন্ধ নাকে গেল। মহিলাটির আধখানা মুখ পচে গেছে। লেখক ওনার চিকিৎসা করছিলেন। কিন্তু দুর্গন্ধে হাসপাতালের কেউ থাকতে না পেরে বারান্দা থেকে তাদের বাইরে একটি গাছতলায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। প্রবল বৃষ্টির মধ্যেও তারা ওখানেই থেকে যায়। কিছুদিন পর লেখক একটি মাঠের ভেতর দিয়ে আসতে দেখেন ওই বৃদ্ধ ভিখারি ইট আর কাদা দিয়ে একটি কবর গাঁথছে; সেটি তার বিবির কবর। লেখক তার নাম জিজ্ঞেস করতেই বলে, শাজাহান। বৃদ্ধের নাম জিজ্ঞেসের মধ্যে দিয়েই বনফুল এভাবেই গল্পের রহস্য উন্মোচন করেন। স¤্রাট শাজাহান আর ফকির শাজাহানের পতœীপ্রেমের মধ্যে যে কোন পার্থক্য নেই লেখক এ গল্পে তা স্পষ্ট করে তুলেছেন। অনেকটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাঁশি’ কবিতার ‘আকবর বাদশার সঙ্গে হরিপদ কেরানীর কোন ভেদ নেই’-এর মতো; কেননা ‘ছেঁড়া ছাতা রাজছত্র হয়ে মিলে চলে গেছে এক বৈকুণ্ঠের দিকে।’ বনফুলের অণুগল্পের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি গল্পের ক্ষুদ্র অবয়ব ও রূপক-প্রতীকের ব্যবহার। গল্পের অবয়বকে কত ছোট ও ভাষাকে সরল করে জীবনকে কত বৃহৎ ও গভীর ভাবে উপস্থাপন করা যায়Ñ তা বনফুলই সর্ব প্রথম পাঠক সমাজকে দেখালেন। তাঁর অণুগল্প সম্পর্কে জনৈক সমালোচকের উক্তি, ‘ছোটগল্পকার হিসেবে বনফুলই বোধহয় ভালো জানতেন যে গল্পকে ছোট আয়তনে ধরে রাখতে গেলে প্রকাশভঙ্গির মধ্যে এক ধরনের শিল্পীত কার্পণ্যই কাম্য; যত ঘনবদ্ধ হবে কথা, যত নির্ভর আর নির্মেদ হবে তার উপস্থাপনা, দ্যোতনার মাত্রা ততই হবে প্রসারিত।’
×