ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মাসুমা রুমা

এখানে নায়িকা থাকে

প্রকাশিত: ০৭:১৮, ২ মার্চ ২০১৮

এখানে নায়িকা থাকে

আমরা সবাই গল্প বলতে চাই। কেউ বলতে পারি, কারও ভেতরে থেকে যায় গল্পের অব্যক্ত পৃষ্ঠাগুলো। বর্তমান সময়ে ভালো গল্প লিখছেন এমন গল্পকারদের মধ্যে সোহেল নওরোজের নাম নিতে আমি মোটেও কার্পণ্য করব না। সোহেল নওরোজের গল্পগুলো যখন পড়ি তখন জীবনের শেষ রসদটুকু পান করার একটি তীব্র আকাক্সক্ষা খুঁজে পাই। একুশে বইমেলা ২০১৮-তে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘এখানে নায়িকা থাকে’। এমন একটা বই গভীর মনোযোগে পড়লে ভেতরে কিছু উপলব্ধি তৈরি হয়, কিছু শব্দ এসে ভীড় করে অনুভবের দরজায়। তখন সেটি নিয়ে লেখার তাড়না স্বস্তি দেয় না। সেই অস্বস্তির জায়গা থেকেই ‘এখানে নায়িকা থাকে’ গল্পপ্রন্থের পনেরটি গল্প নিয়ে উপলব্ধি প্রকাশের প্রয়াস পাব। ‘পা-ুলিপির কয়েকটি পৃষ্ঠা’ গল্পে একজন লেখকের বেদনার কথা বিধৃত হয়েছে। বই প্রকাশ করা প্রতিটি লেখকেরই স্বপ্নের জায়গা। বাস্তবিক অর্থে আমাদের দেশে খুব কম প্রকাশকই আছেন যারা একজন লেখকের মেধা, মনন আর শ্রমকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করে থাকেন। এই অবমূল্যায়নের গ্লানি মুছে ফেলতে কেউবা লেখালেখি ছেড়ে দেন, কেউবা নিজেই হয়ে ওঠেন প্রকাশক। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। প্রতিটি পা-ুলিপিই এক বা একাধিক মানুষের জীবনের সারাংশ। অনেক সময় কিছু একটা পড়তে গিয়ে নিজেকে কোনো চরিত্রের ভেতর আবিষ্কার করাও অসম্ভব নয়। হয়তো সেই পা-ুলিপিতে আমার বা আমাদের জীবনের গল্পের শুরুটা থাকে, কখনো থাকে মধ্যভাগ, কখনো একাকার হয়ে যাই শেষাংশে। পরের গল্প ‘আগুনছবি’। গল্পের শুরুর দিকের একটি কথা পাঠককে ভাবিয়ে তুলবেÑ‘এমদাদ সাহেব সমীকরণ মেলাতে হিমশিম খান’। আমাদের প্রত্যেকের জীবনই এক একটি জটিল সমীকরণ। আমরা প্রায়ই সমীকরণ মেলাতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ে যাই। অনেক সময় সমীকরণ মিলে গেলেও সন্তুষ্টির জায়গাতে ঘাটতি থেকে যায়। গল্পটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক। যেখানে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল সময়ের চিত্র। এক জোড়া তরুণ-তরুণীর ভালোলাগা, ভালোবাসার অব্যক্ত সুর। কাউকে ভালোবেসে তার জন্য অপেক্ষার প্রহর গোনা বেদনার বিষয় হলেও অনেকটাই সুখের হয় যখন অন্তরাত্মা জানে প্রিয় মানুষটি দেশের জন্য যুদ্ধে গেছে। কিন্তু সেই অপেক্ষা, অপেক্ষার পেছনে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা ভাবনাগুলো যখন এক মুহূর্তে মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়, তখন বেঁচে থাকাটা অর্থহীন হয়ে ওঠে। প্রেমÑভালোবাসাময় আবেগ আমাদের জীবনের স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু দেশের স্বার্থে সেই আবেগকে তুচ্ছ জ্ঞান করার মতো মানসিক শক্তিও আমরা অন্তরে জিইয়ে রাখি। যার উৎকৃষ্ট প্রমাণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। কাজেই মুক্তিযুদ্ধ কেবল একটি জাতির বেড়ে ওঠার গল্প নয়; অনেক মানুষের আবেগ, স্বপ্ন, চাওয়া-পাওয়া, বিশ্বাসের অপমৃত্যুর গল্পও বটে। ‘এখানে নায়িকা থাকে’ গ্রন্থের নামগল্প। গল্পের মূল চরিত্র জাফর সাহেব। তিনি গল্প বলতে ভালোবাসেন। সুযোগ পেলেই গল্প বলেন। সে গল্প অদেখা এক নায়িকাকে আবিষ্কারের গল্প। এ গল্পে উঠে এসেছে বাল্যকালের দুরন্তপনা, কল্পনা, নতুন কিছু জানা বা দেখার ঝোঁক। মানুষ মাঝে মাঝে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় যার জন্য সে প্রস্তুত থাকে না। তবু জীবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে, ব্যক্তিগত কিছু ভালোলাগাকে জিইয়ে রাখতে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার জন্ম দেয়। এই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাই পরবর্তীতে প্রশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিষয়টা যেন এমন ‘ভুল ট্রেনে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়া’! পাঠক এমনই কিছু অনুভবের স্বাদ পাবে এই গল্পটিতে। ‘ভাবতে ভুলে যাওয়ার পর’ গল্পে জীবনের চরম বাস্তবতা ফুটে উঠেছে। জীবনকে যদি একটি দাবার কোর্ট ভাবা হয়, আমরা তাহলে দাবার এক একটা ঘুঁটি। মূলত এই সভ্যজগতে মানুষের চেয়ে দ্বিতীয় কোনো অসহায় প্রাণি নেই। গল্পকার এখানে উপমা ব্যবহারেও সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন। যেমন গল্পের এক পর্যায়ে তিনি বলেছেন, ‘সংসারটা ক্রিকেট খেলার পার্টনারশিপের মতো। একজন বেধড়ক পেটালে অন্যজনকে ধৈর্য ধরে দেখেশুনে খেলতে হয়’। সমসাময়িক আর মানবেতর ইস্যুগুলোও যে গল্পকারের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না এ গল্প যেন তারই দৃষ্টান্ত বহন করে। ‘চার আঙুল হারানো মানুষের গল্প’ একটি রূপকধর্মী গল্প। এখানে চারটি আঙুল দিয়ে একজন মানুষের চার দিনে স্মরণ হওয়া অপরাধগুলোর দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। প্রতিটি মানুষের অন্তরে একই সঙ্গে ভালো-মন্দের বসবাস। তারপরও মানবহৃদয় মন্দের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়। কেউ কেউ অপরাধমূলক কাজ করে পৈশাচিক আনন্দবোধ করে। সেই আনন্দটুকু ক্ষণস্থায়ী জেনেও অপরাধের ধারাকে অব্যাহত রাখে। ‘ছায়ার কাছে হেরে যাওয়া প্রেমিক’ একই সঙ্গে প্রেমের গল্প, আবার দূরে সরে যাওয়ার গল্প। হঠাৎ ভালোলাগা থেকে তৈরি হওয়া ভালোবাসা হারিয়ে ফেলার ভয়ে বিচ্ছেদ মেনে নেওয়ার এক ব্যতিক্রম-সুন্দর ভাবনা ফুটে উঠেছে গল্পটিতে। ‘যখন আমি লেখক হতে চেয়েছিলাম’ এবং ‘এটা কোনো নাটক ছিল না’ আবেগাশ্রয়ী গল্প। গল্পের মূল চরিত্র এখানে নিজেই কথক হয়ে উঠেছেন। নির্দ্বিধায় বর্ণনা করে গেছেন নিজস্ব আবেগ-অনুভূতির কথা। কখনো চরম সত্যকে সামনে তুলে আনতে নাটকের আশ্রয় নিতে হয়। কেউ সেই নাটককে সহজেই ধরে ফেলে, কেউবা নাটককে বাস্তবতা ভেবে গোপনে চোখের জল ফেলে। সে সময়টুকুতে অপ্রত্যাশিত অনেক যন্ত্রণার মুখোমুখি হতে হলেও পরবর্তীতে সেই যন্ত্রণারাই সুখের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ‘পাতাদের সংসার’ গল্পে লেখক গাছপালার সঙ্গে মানুষের জীবনযাপনের একটি তুলনামূলক চিত্র এঁকেছেন। সেখানে ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকই লক্ষ্যণীয়। আমাদের জীবন একটি বৃত্ত। বৃত্তের বলয়েই আমরা ঘুরে চলেছি প্রতিনিয়ত। যেখানে শুরু সেখানইে শেষ, আবার যেখানে শেষ সেখানেই হয়তো জীবনের শুরু। এভাবেই তৈরি হয় একটি ভারসাম্য। ‘মাইন্ড গেম’ গল্পের কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র রাফিয়া তেমন একটা বৃত্তের ভেতর মাইন্ড গেম খেলে। একসময় তার জীবনই হয়ে ওঠে মাইন্ড গেমের অংশ। ‘গন্তব্য’-তে গিয়ে স্মৃতিকাতর হতে হয়। মাঝেমধ্যে হঠাৎ করেই কোনো ঘটনা আমাদের অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। আমরা ক্ষণিকের জন্য থমকে যাই। পাথরমানবের খোলসটা ছেড়ে হয়ে উঠি কুসুম-কোমল। সব ভুলে এক সময় আবারো তাল মেলাই গতিময় জীবনের সঙ্গে। ‘পুতুলবাজি’ গল্পটি সমাজের পিছিয়ে পড়া অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে লেখা। লেখক এখানে সমাজ সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন। ‘একটি দিনপঞ্জি ও কয়েকটি লাল পিঁপড়া’ গল্পের নামকরণ তাৎপর্যপূর্ণ। দিনপঞ্জি আমাদের জীবনকে প্রতীকায়িত করে আর লাল পিঁপড়া প্রতীকায়িত করে সমাজে প্রতিনিয়ত ঘটে চলা বিশৃঙ্খলার। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র আমানুল্লাহ্ মুন্সী। তিনি প্রত্যাশা করেন বিগত বছরগুলোর মতো আর কোনো অপরাধ ঘটবে না তার জীবনে। নতুন দিনপঞ্জিতে থাকবে না কোনো লাল কালির দাগ। কিন্তু তার প্রত্যাশা বাস্তবায়িত হয় না। ‘চরিত্রের কাছে ফেরা’ গল্পটি নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ও তার সৃষ্ট চরিত্রগুলো নিয়ে লেখা। কখনো তাঁর সঙ্গে হিমু, শুভ্র বা মিসির আলীর দেখা হয়ে গেলে কী ঘটবে এমন একটা ভাবনা থেকে গল্পটি লেখা হয়েছে। সর্বশেষ গল্প ‘শামছুদ্দিনের শেষ ইচ্ছা’ আমাদের খুব চেনা এক দুর্ঘটনার সফল গল্পায়ন। দীর্ঘ গল্পটিতে কোনো সংলাপ নেই। সংলাপ ছাড়াও গল্প কতটা সুখপাট্য হতে পারে এ গল্প তারই প্রমাণ। ঘটনার এবং দুর্ঘটনার বর্ণনায় লেখক মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। পরিশেষে এটুকুই বলবÑ প্রতিটি গল্পই পাঠকের অন্তরে ভাবনার উদ্রেক ঘটাবে। তাই সূক্ষ্ম অনুভবের জায়গাগুলো উপভোগ করতে হলে পূর্ণ মনোযোগ দিতে হবে প্রতিটি ঘটনায়, অণুঘটনায়। অন্যথায় ‘এখানে নায়িকা থাকে’র রূপ-রস পুরোপুরি আস্বাদন করা সম্ভব হবে না।
×