ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

যতীন সরকার

‘তিস্তা’ ॥ বর্ণনা কৌশলে নতুনত্ব

প্রকাশিত: ০৭:১৭, ২ মার্চ ২০১৮

‘তিস্তা’ ॥ বর্ণনা কৌশলে নতুনত্ব

হারুন পাশার ‘তিস্তা’ একটি অন্য রকম উপন্যাস। প্রসঙ্গ ও প্রকরণ- দু’দিক থেকেই এটি অন্য রকম। নদীকে বিষয়বস্তু করে তো বাংলা ভাষায় মানিক বন্দোপাধ্যায় থেকে শুরু করে অদ্বৈত মল্লবর্মণ পর্যন্ত অনেকেই উপন্যাস লিখেছেন। তিস্তা নদী নিয়েই দেবেশ রায়ের ‘তিস্তাপাড়ের বৃত্তান্ত’ তো বিপুলভাবে পাঠক-নন্দিত একটি উপন্যাস। তবু বলতেই হবে যে, ‘তিস্তা’র প্রসঙ্গ সূত্রেই হারুন পাশা অন্যদের থেকে অন্য রকম একটি উপন্যাস রচনা করেছেন। কী করে এটি অন্য রকম একটি উপন্যাস হয়ে উঠেছে, সেটি হলো, বাংলা উপন্যাসের প্রচলিত বর্ণনারীতি থেকে আলাদা ‘তিস্তা’ উপন্যাস। আমাদের প্রচলিত রীতিতে ঔপন্যাসিক বর্ণনা করেন কাহিনী এবং মাঝে মধ্যে চরিত্রের সংলাপ দেন। এমনকি এক লাইনেই লেখক এবং চরিত্রের কথা থাকে। ‘তিস্তা’ উপন্যাসে এ রীতি নেই, নেই লেখকের প্রবেশ। চরিত্ররাই নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতার কথা বলেছে। এগিয়ে যায় উপন্যাসের কাহিনী। এই বইয়ের ‘তিস্তা প্রসঙ্গে কিছু কথা’ মুখবন্ধটি যে কোন পাঠকের জন্যই অবশ্য পাঠ্য। একাডেমিক বিচারে ‘তিস্তা’ অবশ্যই একটি ‘আঞ্চলিক উপন্যাস’। বিশ শতকেই বাংলায় আঞ্চলিক উপন্যাস রচনার সূচনা ও প্রসার ঘটলেও সে সময়কার কোন উপন্যাসই আঞ্চলিক ভাষায় রচিত হয়নি, পাত্রপাত্রীদের সংলাপেই কেবল সে ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে। উপন্যাসের সংলাপে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারে পথিকৃতের মর্যাদা প্রদান করতে হয় শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়কে। শৈলজানন্দও কিন্তু এই ‘স্মরণীয়’ কাজটি সহজে সম্পাদন করতে পারেননি। তিনি যে আসানসোল-রানীনাক্ত অঞ্চলের কয়লাকুঠির শ্রমিকদের কথ্যভাষাকে তাঁর উপন্যাসে স্থান দিয়েছিলেন, সে বিষয়টি তখনকার অনেক প্রথিতযশা সাহিত্যিকও অনুমোদন করেননি। রবীন্দ্রনাথ নিজে যদিও তাঁর কোন উপন্যাসেই আঞ্চলিক ভাষা প্রয়োগ করেননি, তবু সঙ্গতভাবেই তিনি যে কোন অঞ্চলের ভাষারই সাহিত্যে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। শৈলজানন্দের পর অনেকেই উপন্যাসের সংলাপে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেছেন। বিশ শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকেই তেমনটি করেছেন আমাদের বাংলাদেশের অনেক ঔপন্যাসিকও। এদের মধ্যে আবুল মনসুর আহমদ, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সরকার জয়েন উদ্দীন, শামসুদ্দিন আবুল কালামÑ এই কয়েকজনের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা চলে। উল্লেখ করতে হয় কবি জসীম উদ্দীনের কথাও। এভাবে বিশ শতকের বিভিন্ন কথাকারের হাতে বাংলা উপন্যাসের আঞ্চলিক ভাষার বিভিন্নমুখী ব্যবহার ঘটতে থাকে। তবে সংলাপ ও বর্ণনাসহ সব কিছুতেই আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করে কোনো উপন্যাস, সম্ভবত একুশ শতকের আগে রচিত হয়নি। এ শতকে, ২০০৬ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত ‘আগুনপাখি’ই বোধহয় আঞ্চলিক ভাষায় লিখিত প্রথম বাংলা উপন্যাস। ১৫৮ পৃষ্ঠার পরিসরে বিধৃত একজন কৃষক-কন্যার আত্মকথাকেন্দ্রিক এই উপন্যাসটি লেখা হয়েছে পশ্চিবঙ্গের রাঢ় অঞ্চলের উপভাষায়। এর দশ/এগারো বছর পরে হারুন পাশার ‘তিস্তা’র পা-ুলিপিটি হাতে এলো। এটি পাঠ করে আঞ্চলিক ভাষার বহুমাত্রিক প্রকাশ শক্তি সম্পর্কে অনেক নতুন ভাবনায় ভাবিত হলাম। ‘আগুনপাখিতে’ তো একজনের কথা আছে, আর ‘তিস্তা’য় রয়েছে অনেকজনের স্বর। ভাবের প্রকাশ তো ভাষার মাধ্যমেই ঘটে। বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষদের জীবনযাত্রার বিশেষ ধরন বা প্রকৃতিই সেই মানুষদের ভেতর বিশেষ বিশেষ ভাবের সঞ্চার ঘটায়, সেই সব ভাবকে ধারণ করেই বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষাতেও দেখা দেয় ভিন্নতা। তবে কোন এলাকার ভাষাই একটি অবিমিশ্র আঞ্চলিক ভাষার ধারক হয়ে থাকে না। এক অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে আরেক অঞ্চলের মানুষের সংযোগে কিংবা এক অঞ্চলের মানুষের অন্য অঞ্চলের অধিবাসী হওয়ার সূত্রে, আঞ্চলিক ভাষাতেও দেখা দেয় বৈচিত্র্য ও অভিনবত্ব। এমনটিই ঘটেছে রংপুর এলাকাতেও। যাদের পূবপুরুষরা ময়মনসিংহ থেকে রংপুরে গিয়ে সেখানেই বসতি স্থাপন করেছে, তারা বাড়িতে কথা বলে ময়মনসিংহের ভাষায়, আর বাড়ির বাইরে ব্যবহার করে রংপুরের ভাষা। এই দু’রকম ভাষাই ব্যবহৃত হয়েছে ‘তিস্তা’ উপন্যাসে। অভিনব রীতিতে রচিত উপন্যাসটির মূল বিষয় তিস্তা-ব্যারাজ-সৃষ্ট সমস্যা ও সঙ্কট। পানি নিয়েও আন্দোলন হতে পারে, এর আগে সাহিত্যে বিশেষত উপন্যাসে এমন প্রেক্ষাপট খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে শুধু পানি নিয়ে আন্দোলন নয়। এ উপন্যাসে জনজীবন তথা জনমানসের বহু বিচিত্র দিকেরই প্রতিফলন ঘটেছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তিস্তাপাড়ের সকল মানুষই সঙ্কটগ্রস্ত। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস তথা ধর্মবিশ্বাসের পাশাপাশি লোক সমাজে স্মরণাতীত কাল থেকে চলে আসা ‘ম্যাজিক বিলিফ’ বা জাদু বিশ্বাসও তাদের ভাবনাবৃত্তে সদা-প্রবহমান। তবে ধর্মীয় অলৌকিকতায় কিংবা প্রাক-ধর্মীয় জাদু প্রকরণে যতই বিশ্বাস রাখুক, তাদের দুর্ভাগ্যের বাস্তব কারণসমূহ চিনে নিতেও তাদের একটুও ভুল হয় না- ‘সংসার বড় অইতাছে আর নদীর মাছ কমতাছে। এইডার বড় কারণ অইলো নদী শাসন। আঙ্গোর তিস্তা শাসন হরতাছে ইন্ডিয়া। হ্যারা পানি ছাড়লে যে কয়ডা মাছ আয়ে নদীর মদ্দে আইতে আইতে শ্যাষ অয়া যায়।’ ভারত ‘যখন কপাট বন্দ করে তখন উজানত এ্যাকনা পানি আইসে। কপাট খুলি দিলে মুতি যে পানি নিবে ওইকনায় পাওয়া কষ্টের হয়।’ ভোটাভুটির রাজনীতি যে তাদের প্রতারণা করে, পুলিশের হাতে যে নির্দোষ মানুষও মার খায়, বড় লোকেরা বড় বড় দোষ করে পার পেয়ে যায়, নির্দোষ গরিবদেরই- যে বড় লোকদের দোষের দায় বহন করে ভোগান্তিতে পড়তে হয়- প্রবহমান বাস্তবতার এ রকম বহু দিকেরই প্রকাশ ঘটেছে হারুন পাশার ‘তিস্তা’য়।
×