ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

পপি দেবী থাপা

স্থাপত্যে বাংলার মুখ

প্রকাশিত: ০৭:১৪, ২ মার্চ ২০১৮

স্থাপত্যে বাংলার মুখ

মেরিনা তাবাসসুম। পেশায় স্থপতি। সম্প্রতি মনোনীত হয়েছেন শিল্পকলা ও নকশার জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃত পুরস্কার ‘আর্ট জামিল’ বা জামিল প্রাইজের জন্য। আর্ট জামিল প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৩ এ কমিউনিটি জামিলের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে। যার শুরুটা ১৯৪০ এ ব্যবসায়ী আবদুল লতিফ জামিলের হাত ধরে। সমাজসেবার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ কার্যক্রমকে সামনে রেখে ২০০৩ এ লন্ডনের ভিক্টোরিয়া এ্যান্ড এ্যালবার্ট মিউজিয়ামের সঙ্গে পুনঃসংস্কার করে দ্য ইসলামিক গ্যালারি যা এখন পরিচিত জামিল গ্যালারি অব ইসলামিক আর্ট নামে। ২০০৯ ভিক্টোরিয়া এ্যান্ড এ্যালবার্ট মিউজিয়ামের সঙ্গে আর্ট জামিল প্রচলন করে দ্বিবার্ষিক জামিল প্রাইজ, ইসলামিক ঐতিহ্যে অনুপ্রাণিত সমকালীন শিল্পকলার জন্য। ২০১০ থেকে দিয়ে আসছে আর্ট জামিল ফটোগ্রাফি এ্যাওয়ার্ড। এতদিন জামিল আর্টে পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হতো শিল্পকলা ও ফ্যাশন ডিজাইন। এবার প্রথম যোগ হলো স্থাপত্যকলা। ২৫ হাজার পাউন্ড অর্থ মূল্যের এ প্রতিযোগিতায় পুরস্কারের জন্য মনোনীত আটজনের তালিকায় ঠাঁই করে নিয়েছেন বাংলাদেশী স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম। তার প্রনীত নকশায় ঢাকার দক্ষিণখানে নির্মিত বায়ত উর রউফ নামে মসজিদটির জন্য তিনি পেলেন এ মনোনয়ন। উল্লেখ্য এই একই নকশার জন্য ২০১৬তে তিনি লাভ করেণ মর্যাদাপূর্ণ আগা খান পুরস্কার। তাবাসসুমের জন্ম ঢাকায়। পিতা ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ। হলিক্রস গার্লস স্কুল এ্যান্ড কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শেষে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক ১৯৯৪-এ। পরের বছর (১৯৯৫) কাশেফ মাহবুব চৌধুরীর সঙ্গে মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আরবানা’; পরবর্তী ১০ বছর কাজ করেছেন বিভিন্ন প্রকল্পে। ২০০৫ এ প্রতিষ্ঠা করেণ ‘মেরিনা তাবাসসুম আর্কিটেক্টস’। উদ্দেশ্য স্থাপত্যশিল্পে নিজস্ব ভাষা প্রতিষ্ঠা যা শেকড়ের উপর দাঁড়িয়ে ধারণ করবে সমকালকে। বায়ত উর রউফ নিয়ে মেরিনার পথচলা ছিল দীর্ঘ এবং চালেঞ্জিং এ কথা বলা যায় দ্বিধাহীন। শুরুটা মোটেই সহজ ছিল না, বাংলাদেশে নারী স্থপতির নকশায় মসজিদ নির্মাণের ধারণাটি প্রচলিত নয় তেমন। এখনও এদেশে অনেক মসজিদে নারীদের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত বা নেই বললেই চলে। সেখানে একটি মসজিদের প্রধান স্থপতি নারী ভাবতেই অবাক লাগে। তবে মেরিনার সুবিধা ছিল অন্যত্র। মসজিদের জন্য প্রাথমিক অর্থ ও ভূমিদাতা তার মাতামহী সুফিয়া খাতুন। দুটো মৃত্যুর স্মৃতিও জড়িত এই মসজিদ নির্মানের সঙ্গে। মেরিনার গর্ভধারিণী তথা সুফিয়া খাতুনের বড় কন্যা পরলোকগমন করেন ২০০২ এ, পরের বছর মারা যান মেরিনার খালা। এ দুটো মৃত্যু শোকাতুর করে তোলে সুফিয়া খাতুনকে। ২০০৫ এ সুফিয়া খাতুন নিজেও গুরুতর অসুস্থ হয়ে পরেণ। তার দানকৃত জমিতে সামান্য অর্থ সম্বল করে বায়ত উর রউফের নির্মাণ কাজ শুরু ২০০৬ সালে। সে বছরের (২০০৬) শেষে সুফিয়া খাতুনের মৃত্যুতে সমস্ত দায়িত্ব এককভাবে এসে বর্তায় মেরিনার ওপর। যে দায়িত্ব তিনি বয়ে বেড়িয়েছেন পরবর্তী ছয় বছর। এই মসজিদ নির্মানের বেলায় মেরিনার ভূমিকা কেবল নকশাকারের নয় অর্থ সংগ্রহের পাশাপাশি প্রতিটি বিষয়ে তাকে ভূমিকা রাখতে হয়েছে। সমস্যা ছিল অর্থ সংগ্রহে। সম্পূর্ণ অনুদানের ওপর নির্ভর করে নির্মিত এ মসজিটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার ইউএস ডলার। নকশার কারণেই এটি কেবল প্রার্থনা স্থল নয় এটি শিক্ষালয়, সামাজিক সম্মেলন কেন্দ্রসহ নানাভাবে ব্যবহৃত হতে পারে। শহরের কেন্দ্রে নয় বিধায় এটি নজরে আসতে সময় নিয়েছে। কিন্তু নজরে আসামাত্র এর অনন্য সৌন্দর্য, শৈল্পিক নক্সা, ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার সম্মিলন নজর কেড়েছে বিশ্বব্যাপী শিল্পপ্রেমীদের। এই মসজিদে নেই প্রথাগত কোন মিনার বা গম্বুজ। ইমামের জন্য নেই আলাদা নির্ধারিত স্থান। বরং শুরু থেকেই মেরিনার লক্ষ্য ছিল ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের জন্য আত্মনিবেদনের এমন এক জায়গা তৈরি করা যেখানে মানুষ একাত্ম হয়ে যাবে তার প্রার্থনায়। সেই সঙ্গে ইসলামী ঐতিহ্য আর মূল্যবোধের প্রকাশ। সে কারণে শুরুতেই তিনি মনযোগ দেন ইসলামের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলোর স্থাপত্যশৈলী পর্যবেক্ষণে। মেরিনার ভাষায় ৫ ট্রাক ইট আর অল্প কয়েক ব্যাগ সিমেন্ট নিয়ে মসজিদের নির্মাণ যাত্রা শুরু। অর্থাভাবে নির্মাণ সামগ্রী ক্রয় না করতে পারায় অনেক বার থেমে গেছে নির্মাণ কাজ। থমকে গেছে মেরিনার স্বপ্ন। তবে দমে যাননি মেরিনা। কিছুই তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি স্বপ্ন পূরণের পথে। হাতে তৈরি ইটে নির্মিত এই মসজিদ নির্মাণে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল সাধ আর সাধ্যের সমন্বয়। আমাদের বাঙালীর নিজস্ব স্থাপত্যশৈলীর পাশাপাশি তিনি সমন্বয় করেছেন সুলতানী আমলের তথা ১৪-১৬ শতকের নির্মাণশৈলী। মসজিদের অভ্যন্তরে আলো-ছায়ার খেলা মন কেড়ে নেয়। অর্থাভাবে বিসর্জন দিতে হয়েছে অনেক ইচ্ছে। তার পরও তাবাসসুম এই ঘিঞ্জি নগরে এক প্রান্তে গড়ে তুলেছেন এক প্রার্থনা আর উপাসনা স্বর্গ। বায়ত উর রউফের নির্মাণ কাজ শেষ হয় ২০১২তে। বায়ত উর রউফ এর নকশা অঙ্কনে কাগজে কলম ছোঁয়ানোর আগেই তাবাসসুম পরিদর্শন করেছেন অন্তত ১০০ প্রকল্প। তাবাসসুম বলেন, উপমহাদেশে মেয়েদের মসজিদে যাওয়া সেভাবে প্রচলিত না হলেও আমার অভিজ্ঞতা আছে কিছু অসাধারণ সৌন্দর্যময় আধ্যাত্মিক স্থান পরিদর্শনের। যা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। তিনি আরও বলেন, আধ্যাত্মিকতা ছিল আমার নকশার অন্যতম বিবেচ্য বিষয় এবং এটি নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করি আমি। মেরিনা আলোচনায় উঠে আসেন- স্বাধীনতা মনুমেন্ট ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নক্সার মাধ্যমে। দেশীয় স্বীকৃতি পেরিয়ে তার জন্য খুলে যায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দুয়ার। বায়ত উর রউফ এর জন্য আগা খান পুরস্কার জেতেন ২০১৬ তে। তার আগে একই প্রতিযোগিতায় এ-৫ এর চূড়ান্ত পর্বে মনোনীত হয়েছিলেন ২০০৪ সালে। সেরা দশ নারীর অনন্যা পুরস্কার পান ওই একই বছর। একাদশ ভারতীয় উপরাষ্ট্রপতি ভায়রন সিং শেখওয়াতের হাত থেকে ২০০১ এ পেয়েছেন আর্কিটেক্ট অব দ্য ইয়ার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে গ্রহণ করেছেন স্বাধীনতা স্তম্ভ ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নকশার জন্য প্রথম পুরস্কার ১৯৯৭-এ। ২০০৫ থেকে ভিজিটিং প্রফেসরের দায়িত্ব পালন করছেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে। এ ছাড়াও দেশে-বিদেশে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার পাশাপাশি বেঙ্গল ইনস্টিটিউটে স্থাপত্যবিদ্যার প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বে আছেন ২০১৫ থেকে। ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কাজ করেছেন ইউনিভার্সিটি অব টেকসাস এর এডভান্স ডিজাইন স্টুডিও তে। নারী-পুরুষ আলাদা করে দেখায় বিশ্বাসী নন মেরিনা। তার মতে পেশাদারী জগতে তিনি আর দশজনের মতোই একজন পেশাদার কর্মী। এখানে লিঙ্গ বৈষ্যমের কোন সুযোগ নেই। নারী বা পুরুষ নয় তিনি একজন মানুষ। দেশীয় এতিহ্যের সঙ্গে সমকালের সংযোগে মেরিনা হয়ে উঠবেন স্থাপত্যে বাংলার আগামী মুখ এটাই প্রত্যাশা।
×