ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সুচির উদ্দেশে বললেন দুই নোবেলজয়ী নারী

মানবাধিকার ও গণতন্ত্র শুধু তোমার একার জন্য নয়

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২ মার্চ ২০১৮

মানবাধিকার ও গণতন্ত্র শুধু তোমার একার জন্য নয়

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ বিশ্বের সব দেশেই জেন্ডার অসমতা রয়েছে। কোন দেশেই নারী ও পুরুষ সমান অধিকার ভোগ করে না। আমার দেশ ইরানেও যেমন নারীরা বৈষম্যের শিকার ঠিক তেমনি বাংলাদেশের নারীরাও বৈষম্যের শিকার বলে মন্তব্য করেন ইরানের নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী শিরিন এবাদি। আরেক নোবেল বিজয়ী উত্তর আয়ারল্যান্ডের ম্যারেইড ম্যাগুয়ার বলেন, ‘রাষ্ট্রের দায়িত্ব নারীর অধিকার নিশ্চিত করা, খর্ব করা নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই নারীর প্রতি সহিংসতা চলমান। বিশ্বের সব দেশের নারীরা তাদের অধিকার পাওয়ার জন্য আন্দোলন করছে। লক্ষ্য একটাই নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করা।’ বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকা ক্লাবে নারীপক্ষ আয়োজিত ‘নারীর ওপর সহিংসতা রোধ ও নারীর অধিকার উন্নয়ন’ বিষয়ক এক সংবাদ সম্মেলনে এই দুই নোবেল বিজয়ী নারী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন নোবেল উইমেনস ইনিশিয়েটিভের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক এলিজাবেথ বার্নেস্টাইন, নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরীন পারভিন হক প্রমুখ। সংবাদ সম্মেলনে এই দুই নোবেল বিজয়ী বাংলাদেশ তথা বিশ্বে নারীর অবস্থান ও সমসাময়িক রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোকপাত করেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে দায়ী করে শিরিন এবাদি বলেন, ‘পুরুষতান্ত্রিকতার জন্য বিশ্বে নারীর প্রতি বৈষম্য ও নির্যাতন ঘটছে। যৌনতা-আকাক্সক্ষা নয়, ধর্ষণের মূলে রয়েছে ক্ষমতা, এটি ক্রাইম অব পাওয়ার। নারীর চুল থেকে পা পর্যন্ত পুরুষের নিয়ন্ত্রণে। পুরুষরা নারীদের স্বাধীনতা দিতে চায় না, কারণ আমরা স্বাধীন হলে তারা শোষণ করতে পারবে না। তাই চার দেয়ালে আটকে রাখতে চায়, ঘর থেকে বের হতে দিতে চায় না। আমরা যত বাইরে বের হব তত আমাদের ওপর সহিংসতা কমবে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্রই যদি মানবিকতা, লৈঙ্গিক সংবেদনশীলতা নিশ্চিত হয় তবেই কমবে নারীর প্রতি বৈষম্য। তাতে গতি আসবে উন্নয়নেও। নারীর প্রতি সহিংসতা ও বৈষম্য দূর করা শুধু বাংলাদেশের জন্যই এখন বড় চ্যালেঞ্জ নয় বরং সমগ্র বিশ্বের।’ রোহিঙ্গা নারীদের ওপর যে নির্যাতন হয়েছে সে প্রসঙ্গে ম্যারেইড বলেন, ‘তাদের ওপর যে নির্যাতন হয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। তারা মিয়ানমার মিলিটারি দ্বারা গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। তাদের মুখ থেকে সেসব নারকীয় নৃশংসতা শুনে আমরা নিজেদের চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। ৯০ শতাংশ রোহিঙ্গা নারীরা ধর্ষণের শিকার। আউং সান সুচি ও একজন নারী তিনি কীভাবে এসব শুনেও চুপ রয়েছেন। তিনি তো শান্তিতে নোবেল পেয়েছিলেন। তিনি যদি শান্তিপ্রিয় হন দেশের মানুষের শান্তি নিয়ে চিন্তা করেন তবে এসব লাখ লাখ মানুষের দায়িত্ব তিনি নিলেন না কেন? এসব প্রশ্নের উত্তর তাকে দিতেই হবে। তার দেশে থাকা অবস্থায় রোহিঙ্গা নারী ও শিশুরা যেভাবে নির্যাতিত হয়েছে সেসব বিষয়ে ওয়াকিবহল থাকা সত্ত্বেও তিনি কেন চুপ রয়েছেন এসব উত্তর তাকে বিশ্বের সামনে আজ নয় কাল দিতেই হবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন আইরিশ এই নারী। ম্যারেইড ম্যাগুয়ার ও শিরিন এবাদি বলেন, সুচি যখন নিজের দেশে গৃহবন্দী ছিলেন, তখন তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রে মিয়ানমার দূতাবাসের সামনে দাঁড়িয়ে তিনবার প্রতিবাদ কর্মসূচী পালন করেছেন। তাঁরা মিয়ানমারে গিয়েও সুচির মুক্তির দাবি জানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেনাশাসিত সরকার তাদের ভিসা দেয়নি। ম্যারেইড ম্যাগুয়ার সুচির উদ্দেশে বলেন, ‘বোন, তোমার মানবাধিকার রক্ষা ও তোমার দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য একসময় আমরা সোচ্চার হয়েছিলাম। আমি বলতে চাই, মানবাধিকার আর গণতন্ত্র শুধু তোমার একার জন্য নয়। নিপীড়নের শিকার রোহিঙ্গাদের জন্যও মানবাধিকার ও গণতন্ত্র একইভাবে প্রযোজ্য। প্রযোজ্য বিশ্বের সমগ্র মানব পরিবারের জন্য।’ নারীদেরকে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে শিরিন এবাদি বলেন, ‘নারীকে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে অবশ্যই তাদেরকে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। কারণ শিক্ষা ছাড়া কেউ সম্পূর্ণ হতে পারে না। নারীকে নিজের জন্যই নিজেকে লড়তে হবে। আর তা শিক্ষার মাধ্যমেই সম্ভব। তাই শিক্ষার বিকল্প নেই। প্রথমত শিক্ষা, দ্বিতীয়ত শিক্ষা তৃতীয়ত শিক্ষা।’ শিরিন এবাদি আরও বলেন, ‘আমি জেনেছি বাংলাদেশে নারীর প্রতি বৈষম্যতা এখনও বিদ্যমান। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা নারীদেরকে দমিয়ে রেখেছে। তবে সুখকর বিষয় এটাই যে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নারী পুরুষ মিলিত হয়ে কাজ করছে। বাংলাদেশের নারী-পুরুষ একত্রিত হয়ে কাজ করছে। নারীরা তাদের যোগ্যতা প্রমাণ করেই কিন্তু স্ব স্ব কাজে অবদান রাখছে।’ জনমত তৈরিতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম উল্লেখ করে শিরিন এবাদি বলেন, ‘গণমাধ্যম সব সময় গণমানুষের কথা বলে। সত্য কথা বলে। দেশের মানুষের কণ্ঠ হয়ে কথা বলে। আমি সাংবাদিকদেরকে গণমানুষের বন্ধু বলে মনে করি। সাংবাদিকদের মাধ্যমেই দেশের মানুষসহ বিশ্বের মানুষ যে কোন সংবাদ পেয়ে থাকে। যেমন রোহিঙ্গা ইস্যুটি শুধু বাংলাদেশের গণমাধ্যমেই কিন্তু সীমাবদ্ধ নয়। এটি এখন বিশ্বের সবাই জানে। তবে এখনও অনেক দেশই জেনে শুনে চুপ করে আছে। কিন্তু আমরা চুপ করে থাকতে পারিনি। তাই বাংলাদেশে এসেছি রোহিঙ্গাদের সঙ্গে দেখা করতে, তাদের সমস্যাগুলোকে জানতে বুঝতে চেষ্টা করেছি। তারা সকলেই চায় নিজ দেশে ফিরে গিয়ে নাগরিক অধিকার পেতে। তারা আর কোন হত্যাকা- চায় না। গণমাধ্যমের কল্যাণেই আমরা রোহিঙ্গা বিষয়টি সম্পর্কে জেনেছি। তবে নিজ দেশ ইরানের কোন গণমাধ্যম রোহিঙ্গা বিষয়টিকে কাভারেজ দেয়নি বলে আক্ষেপ প্রকাশ করে শিরিন এবাদি বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রেই গণমাধ্যম যেসব বিষয়গুলো দর্শক কিংবা পাঠক প্রয়োজন মনে করে না সেসব বিষয় তুলে ধরে। কারণ সেসব খবরের মাধ্যমে তারা ব্যবসায়িকভাবে হয়ত বা সফল হবে। কিন্তু বিশ্বে চলমান অনেক গুরুত্বপূর্ণ খবরও মাঝে মাঝে পত্রিকা কিংবা টিভিতে জায়গা করতে পারে না। ঠিক তেমনভাবেই ইরানের গণমাধ্যমও রোহিঙ্গা বিষয়টিকে তুলে ধরেনি। কারণ, চীনের সঙ্গে ইরানের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। চীন যেমন নীরব ভূমিকা পালন করছে ঠিক তেমনভাবেই ইরান। ইসলাম ধর্মের অনুসারী হওয়ার কারণে রোহিঙ্গাদের ওপর এমন নির্মম অত্যাচারকে ধিক্কার জানিয়ে শিরিন এবাদি বলেন, ‘একজন মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা উচিত। সে কোন ধর্মানুসারী সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। মুসলামনের ওপরই কেন বিশ্বজুড়ে এত নির্মমতা এত হত্যাকা-! আমি একজন মুসলিম। এসব বিষয়গুলো আমাকে ভাবায়! অবাক হই। ইরান, সাইবেরিয়া, কাতার, এমিরেটস এসব দেশগুলো কেন প্রচুর অর্থ খরচ করে অস্ত্র, গোলাবারুদ কেনে? এটা ভেবেই আমি অবাক হই। রোহিঙ্গারা শুধুমাত্র মুসলমান হওয়ার কারণে নিজ দেশে টিকতে পারেনি। কারণ বৌদ্ধদের দেশে তারা সংখ্যালঘু। শুধুমাত্র ধর্মের প্রতি বৈষম্যতার কারণেই লাখ লাখ মানুষকে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে মিয়ানমার মিলিটারি। গণহত্যা চালিয়েছে। রোহিঙ্গারা কী আদৌ নিজ দেশে ফিরতে পারবে কী না সে প্রশ্নের জবাবে ম্যারেইড ম্যাগুয়ার বলেন, ‘গত কয়েকদিন ধরে রোহিঙ্গাদের আমরা সত্যিই একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য যা করেছে তা সত্যিই বিরল। যেখানে নিজ দেশের সরকার তাদেরকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে সেখানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাদেরকে আশ্রয় দিয়ে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। আমরা ইতোমধ্যেই মিয়ানমারে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা আউং সান সুচিকে যথাসাধ্য বোঝানোর চেষ্টা করব যাতে সে রোহিঙ্গাদেরকে ফেরত নেন। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতে আউং সান সুচিকে দাঁড় করাব। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিষয়টির প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে এ সঙ্কট নিরসনে অবিলম্বে কার্যকর ব্যবস্থা নেবে, এটাই কাম্য।
×