ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সর্বশেষ মারা গেল ৩ জন ॥ বছরে প্রাণহানি ৭০

সিলেটে পাথর কোয়ারিতে দীর্ঘ হচ্ছে লাশের সারি

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২ মার্চ ২০১৮

সিলেটে পাথর কোয়ারিতে দীর্ঘ হচ্ছে লাশের সারি

স্টাফ রিপোর্টার, সিলেট অফিস ॥ সিলেটের বিভিন্ন পাথর কোয়ারি এলাকায় অবৈধ ও অপরিকল্পিত পাথর উত্তোলন করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত মাটি চাপা পড়ে পাথর শ্রমিকের লাশের সারি দীর্ঘ হচ্ছে। গত বুধবার কোম্পানীগঞ্জের শাহ আরেফিন টিলা এলাকায় বশর মিয়ার কোয়ারিতে পাথর উত্তোলনের সময় পাথর চাপায় ৩ শ্রমিক নিহত হয়েছেন। নিহতরা হলেন, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার ডিকদারা গ্রামের নজির আলির পুত্র কাচা মিয়া (৩০), জাহির মিয়া ও আফাজ মিয়া। এ ঘটনায় আহত হন ডিকদারা গ্রামের সুক্কুর আলির ছেলে আব্দুল গনি (৫৫)। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গত ১ বছরে বিভিন্ন কোয়ারি এলাকায় পাথর উত্তোলন করতে গিয়ে মাটি চাপা পড়ে প্রায় ৭০ জনের মতো প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। উল্লিখিত সময়ে শুধু কোম্পানীগঞ্জের শাহ আরেফিন টিলা এলাকায় পাথর উত্তোলনকালে মাটি চাপা পড়ে ১০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটলেই প্রাথমিকভাবে তড়িঘড়ি করে সংশ্লিষ্টরা নিহত শ্রমিকদের লাশ সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করেন। বুধবারও একই কায়দায় ঘটনার পর বিষয়টি পুলিশ, উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অবগত না করেই লাশ গুমের চেষ্টা করে পাথরখেকোরা। এ ব্যাপারে গর্তের মালিক বশর মিয়া জানান, শাহ আরেফিন টিলায় শ্রমিক নিহতের খবর তার জানা নেই। শাহ আরফিন টিলা পাথর কোয়ারিতে টাস্কফোর্সের অভিযান চলাকালেই বুধবার দুপুর বারোটার দিকে এই গর্তে মাটি ধসের ঘটনা ঘটে। এ সময় হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যান কাছা মিয়া। মাটির নিচে চাপা পড়েছিল জাহির ও আফাজের লাশ। কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানান, রাত সাড়ে বারোটার দিকে ফায়ার সার্ভিসের সহযোগিতায় দুর্ঘটনাকবলিত গর্তের মাটি সরিয়ে জাহির ও আফাজের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ব্যাপারে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানান, শাহ আরেফিন টিলা বাজার এলাকায় শ্রমিক নিহত হয়েছে। গর্ত মালিকের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য পুলিশকে বলা হয়েছে। মটিয়া টিলায় আমরা অভিযান পরিচালনা করেছি এবং সকল টিলায় মাইকিং করে শ্রমিকদের কাজ না করার জন্য বলা হয়েছে। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি কোম্পানীগঞ্জের কালাইরাগে মাটি চাপা পড়ে ৫ শ্রমিকের মৃত্যু ঘটে। নিহতদের লাশ গুমের চেষ্টা করা হয়। লাশ সরিয়ে নেয়ার সময় পুলিশ রাস্তা থেকে উদ্ধার করে। প্রতি ঘটনায় মামলা হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যান মূল হোতারা। স্থানীয়রা জানান, মামলা দায়েরের পর শ্রমিক সরদারকে গ্রেফতার করেই থেমে যায় গ্রেফতারের মিশন। বিভিন্ন সময়ে গর্ত মালিকদের নাম উল্লেখ করে মামলা দায়ের করা হলেও কোন গর্ত মালিকদের গ্রেফতার করা হয়নি। গত বছরের ২৩ জানুয়ারি শাহ আরিফিন টিলায় অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনকালে টিলা ধসে ৫ শ্রমিক নিহত হন। তড়িঘড়ি লাশ সরিয়ে ফেলার কারণে পুলিশ পরবর্তীতে নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা ও সদর এলাকা থেকে ৫ শ্রমিকের মৃতদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্ত করেছে। ঘটনার দিনই সিলেটের তৎকালীন জেলা প্রশাসক জয়নাল আবেদীন এ ঘটনার রহস্যোদ্ঘাটনে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবু সাফায়াতকে দিয়ে এক সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেন। আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকায় ও এভাবে বার বার গর্ত মালিকরা ছাড় পেয়ে যাওয়ায় প্রাণহানির ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। এর আগে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ কোয়ারিতে গর্ত ধসে ৫ শ্রমিক ও পরদিন সোমবার সকালে জৈন্তাপুর উপজেলার শ্রীপুর কোয়ারি ধসে ১ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। ভোলাগঞ্জে ৫ শ্রমিক নিহতের ঘটনায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলী আমজাদসহ ৭ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করে পুলিশ। এই মামলায় কোয়ারির শ্রমিক সর্দার আব্দুর রউফ ছাড়া কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। গত ২৩ জুন সকালে আরফিন টিলায় ৫ জন শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনার পরপরই গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। একটি ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। এছাড়া তাৎক্ষণিক ওই এলাকায় টাস্কফোর্স পরিচালনা করে ধ্বংস করে দেয়া হয় বেশ কয়েকটি বোমা মেশিন ও পাথর উত্তোলনের কাজে ব্যবহৃত শ্যালো। ঘটনার ১১ দিনের মাথায় তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদনে টিলা কেটে পাথর উত্তোলনসহ কোটি কোটি টাকার পাথর চুরির সঙ্গে ৪৭ সদস্যের একটি চক্রকে চিহ্নিত করা হয়। এছাড়া স্থানীয় প্রশাসনের ‘যোগসাজশ’ ও ‘রহস্যজনক নিষ্ক্রিয়তার’ কারণে পাথরখেকো এই চক্র এতদিন ধরে তাদের অপতৎপরতা নির্বিঘেœ চালিয়ে আসছিল বলে উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি টিলা ধ্বংসের সঙ্গে জড়িত গডফাদার এবং ওই পরিবেশ রক্ষার বিষয়েও সুপারিশ করা হয়। ঐ দুর্ঘটনার পর কিছুদিন পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকে। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর আবারও পুরোদমে চলতে থাকে টিলা কেটে পাথর সংগ্রহের কাজ। স্থানীয় প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করেই আবার তারা টিলা কাটা শুরু করে। যার ফলে পুনরায় ঘটে প্রাণহানির ঘটনা। প্রাণহানির ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার আসামিরা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। তাছাড়া তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে যাদের নাম এসেছে তারাও বহাল তবিয়তে রয়েছেন। প্রশাসনের লোকদের ম্যানেজ করেই পুরোদমে পাথর উত্তোলন করছেন তারা। সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ-ভোলাগঞ্জ, বিছনাকান্দি, জাফলং, শ্রীপুর লোভাছড়া, লালাখাল পাথর কোয়ারি এলাকার অধিকাংশ স্থানেই মূল কোয়ারির এলাকায় এখন পাথরের মজুদ নেই। কোয়ারি এলাকায় বোমা মেশিন দ্বারা ১শ’/দেড় শ’ ফুট গর্ত খনন এখন পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। নদীর পার্শ¦বর্তী বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে রয়েছে মাটির নিচে পাথর। কোয়ারিতে পাথরের মজুদ ফুরিয়ে যাওয়ায় স্থানীয় লোকজন নিজেদের জমি থেকে পাথর উত্তোলন শুরু করেছে। নদী-খাল-টিলা কিংবা সমতল ভূমি। সবখানেই মিলছে পাথর। মাটি খুঁড়লেই পাথর পাওয়া যায়। বছরের পর বছর উত্তোলনের পরেও যেন পাথরের শেষ নেই। ছোট-মাঝারি-বড় বিভিন্ন আকৃতির পাথরের অবস্থান নিয়ে পাথররাজ্য খ্যাত সিলেটের জাফলং, ভোলাগঞ্জ এলাকা। স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে নিজেদের এক খ- জমি তেমন মূল্যবান নয়। কিন্তু পাথরের অবস্থান বিবেচনায় এই জমির মূল্য অনেক। নিজেরা পাথর উত্তোলন করতে না পারলে অন্যের সাহায্য নিয়ে অথবা বিক্রি করে দিয়ে অনেক টাকা পাচ্ছেন। শুধু ঘরবাড়ির জন্য জমি রাখার চেয়ে পাথর উত্তোলন করে বিক্রি করে টাকা রোজগারের চিন্তা করেই স্থানীয়রা মাটিতে গর্ত করে পাথর উত্তোলনের পথে পা বাড়িয়েছেন। আগে পাথর উত্তোলন করা হতো সনাতন পদ্ধতিতে। কিন্তু কয়েক বছর ধরে যুক্ত হয়েছে পরিবেশবিধ্বংসী ‘বোমা মেশিন’। পাথরখেকো চক্ররা এর মাধ্যমে নদী-পাহাড় থেকে উত্তোলন করতে থাকে পাথর। এই পদ্ধতিতে পাথরখেকো চক্রের আগ্রাসী থাবায় কোম্পানীগঞ্জের পশ্চিম ইসলামপুর ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী শাহ আরপিন টিলাও উজাড় হয়ে গেছে। টিলা কেটে পাথর উত্তোলনের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও একশ্রেণীর প্রভাবশালী ও পাথরখেকো নির্বিচারে ওই টিলা কেটে পাথর উত্তোলন করছে। এ কারণে সেখানে হতাহতের ঘটনা বাড়ছে।
×