ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ছেঁউড়িয়ায় দোল পূর্ণিমা ॥ তিন দিনের অনুষ্ঠান শুরু

বাউল ভক্তের ভিড়, লোকশিল্প মেলা-যেন উৎসবের পল্লী

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২ মার্চ ২০১৮

বাউল ভক্তের ভিড়, লোকশিল্প মেলা-যেন উৎসবের পল্লী

এমএ রকিব, কুষ্টিয়া থেকে ॥ বাড়ীর পাশে আরশীনগর সেথা একঘর পড়শী বসত করে, আমি একদিনও না দেখিলাম তাঁরে... এমন অসংখ্য মরমী গানের স্রষ্টা বাউল স¤্রাট লালনশাহ। বাংলার বাউল সঙ্গীতের ক্ষেত্রে মরমী সাধক লালনশাহের নাম স্মরণীয়। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ফকির লালনের নাম আজ বহির্বিশ্বেও প্রচারিত। লালনের গানে কেবল অধ্যাত্ম দর্শনই নয়, বাংলার সমাজ, প্রকৃতি ও মানুষের কথাও প্রতিফলিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে লালনশাহ আজ লৌকিক বাংলার কিংবদন্তীর সঙ্গীত নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত। আধ্যাত্মিক সাধক লালনের ‘দোল পূর্ণিমা’ উৎসব উপলক্ষে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় এবার কুষ্টিয়া লালন একাডেমি আয়োজন করেছে তিনদিন ব্যাপী বাউল সমাবেশ। এবারের দোল পূর্ণিমা উৎসবের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘সময় গেলে সাধন হবে না’। লালনের অমর এ বাণীকে ধারণ করে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনায় বৃহস্পতিবার দোল পূর্ণিমার রাত থেকে ছেউড়িয়ায় শুরু হয়েছে এই উৎসব। লালন একাডেমির সভাপতি কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক জহির রায়হানের সভাপতিত্বে এদিন রাতে তিনদিন ব্যাপী এই উৎসবের উদ্বোধন করেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ এমপি। অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন কুষ্টিয়া পুলিশ সুপার এসএম মেহেদী হাসান, কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হাজী রবিউল ইসলাম, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ সদর উদ্দিন খান ও সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী, পিপি অনুপ কুমার নন্দী, জিপি আখতারুজ্জামান মাসুম প্রমুখ। অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহীনুজ্জামান। সাধুসংঘের নিয়মানুযায়ী দোল পূর্ণিমার সন্ধ্যায় ‘রাখাল সেবা’র মধ্য দিয়ে শুরু হয় সাধুদের দেড় দিনের মূল উৎসব। তা চলবে আজ শুক্রবার দুপুরে ‘পূর্ণ সেবা’ পর্যন্ত। স্মরণোৎসব উপলক্ষে ছেঁউড়িয়ায় লালনের আখড়াবাড়ি চত্বর পরিণত হয়েছে উৎসবের পল্লীতে। দেশ-বিদেশ থেকে আগমন ঘটেছে লালনভক্ত, বাউল অনুসারী ও সুধীজনসহ অসংখ্য মানুষের। সন্ধ্যা ৭টা থেকে উৎসবে থাকছে স্মৃতিচারণমূলক আলোচনা ও গান। বসেছে জমজমাট লোকশিল্প মেলা। সাধুসঙ্গের নিয়ম সম্পর্কে বাউল ফকির বলাই শাহ বলেন, সাধু-গুরু তাদের সেবাদাসী এবং ভক্ত ও অনুসারীদের সঙ্গে নিয়ে দোল পূর্ণিমায় স্মরণোৎসবের প্রথমদিন বিকেলের মধ্যেই লালনের আখড়াবাড়িতে নিজ নিজ পাটে (আসনে) বসবেন। ‘আসনে’ বসা সাধু-গুরুদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ভক্তি-শ্রদ্ধার বিষয়। এই আসনে বসার ব্যবস্থা নিয়ে কোন সুনির্দিষ্ট নিয়ম নেই। যার যেমন সামর্থ্য অনুযায়ী কেউ সাদা বা রঙিন কাপড়ের টুকরোর ওপর, কিংবা শীতল পাতার মাদুর, এমনকি গামছা বিছিয়েও আসনে বসতে পারেন। নিয়ম অনুযায়ী ২৪ ঘণ্টায় সেবা মোট ৪টি। রাখাল সেবা, অধিবাসর সেবা, বাল্যসেবা ও পুণ্যসেবা। বলাই শাহ বলেন, সাধুসঙ্গের লগ্ন আসে সন্ধ্যায়। পাটে বসে সন্ধ্যা লগ্নে রাখাল সেবা গ্রহণের পর থেকে ২৪ ঘণ্টার অষ্টপ্রহর সাধুসঙ্গের আগ পর্যন্ত সাধু-গুরু তাদের ভক্ত-শিষ্যদের নিয়ে ধ্যানে বসে তবজব করেন। এসময় তারা একই স্থানে বসে উপাসনা, সাধনা-আরাধনা করেন। দ্বিতীয় দিন চলে বাউলদের অষ্টপ্রহরের সাধুসংঘ। এদিন ভোরে গোষ্ঠ গানের মধ্যদিয়ে বাউলদের দ্বিতীয় দিনের (শুক্রবার) আচার অনুষ্ঠান শুরু হবে। লালন একাডেমি সূত্র জানায়, ভোরে গোষ্ঠ গানের মধ্যদিয়ে স্মরণোৎসবের দ্বিতীয় দিন শুরু হয়। এদিনকে স্বাগত জানানোই গোষ্ঠ গানের মূল উদ্দেশ্য। এরপর একে একে অনুষ্ঠিত হয় তাদের কার্যক্রম। গুরু-শিষ্যের ভাব আদান-প্রদান, লালন তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা, আর সে সঙ্গে চলে নিজস্ব ঘরানায় বসে লালনের গান পরিবেশন। ‘তুমি গোষ্ঠে চলো হরি মুরারি, আর আমারে মারিসনে মা’ এসব গান পরিবেশন করা হয়। পুণ্যসেবায় সাধুদের খেতে দেয়া হয় মাছ, ভাত, সবজি বা ঘন্ট, ডাল আর দই। এই আহারকে বলে পুণ্যসেবা। এই সেবার মধ্যদিয়ে দ্বিতীয় দিন শেষ হয় বাউলদের অষ্টপ্রহরের সাধুসংঘ। ভেঙ্গে যায় বাউলদের আসর। লালন আখড়ার খাদেম মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘বার্ষিক স্মরণোৎসব উপলক্ষে লালনের সাধন-ভজনের তীর্থস্থান ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতে বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ। প্রতিবছরই দেশ-বিদেশ থেকে লালনভক্ত, বাউল অনুসারী ও সুধীজনসহ অসংখ্য মানুষের আগমন ঘটে এখানে। এবারও তার ব্যতিক্রম নেই। ইতোমধ্যে দেশ-বিদেশের সাধুরা এখানে এসেছেন। লালন গবেষকদের কারও কারও মতে, দোল পূর্ণিমার সঙ্গে প্রেমময় আত্মার সম্পর্ক স্মরণীয় করে রাখতে প্রতিবছর এই রাতে লালনশাহ নিজেই ভক্ত শিষ্যদের নিয়ে ঘটা করে উৎসবটি পালন করতেন। সেই থেকে লালনের অগণিত ভক্ত ও অনুসারীরা আজও দিনটিকে ধারাবাহিকভাবে পালন করে আসছে। লালনের সেই স্মৃতিকে অম্লান করে রাখতে লালন একাডেমিও প্রতিবছর এই উৎসবটিকে ‘লালন স্মরণোৎসব’ হিসেবে পালন করে আসছে। কুষ্টিয়া পুলিশ সুপার এসএম মেহেদী হাসান জানান, উৎসবকে কেন্দ্র করে এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। মোতায়েন করা হয়েছে বিপুলসংখ্যাক পুলিশ সদস্য। লালনের জীবন-কাহিনী অনেকাংশেই রহস্যাবৃত। তাঁর জীবনের ধারাবাহিক ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে গবেষক ও ইতিহাসবিদদেরকে বিভিন্ন তথ্য, জনশ্রুতি বা অনুমানের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। লালনের জন্ম, জাত ও ধর্ম নিয়েও যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। লালন নিজেও তাঁর জাত ধর্ম সম্পর্কে নিস্পৃহ ও উদাসীন ছিলেন। তাঁর জাত-ধর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়ে তাই তিনি জবাব দিয়েছেন, ‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে। লালন বলে জাতের কি রূপ দেখলাম না এ নজরে’। লালন ছিলেন পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান। আর্থিক সংকটের কারণে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ করতে পারেননি। শৈশবে পিতৃবিয়োগ হওয়ায় অল্প বয়সেই তাঁর ওপর সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে। সাংসারিক চিন্তা ও আত্মীয়বর্গের বৈরিতা তাকে বিশেষ পীড়িত করে তোলে। এক পর্যায়ে লালন সমাজ ও স্বজন কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে ব্যথিত ও অভিমানে চিরতরে গৃহত্যাগ করেন। পরে তিনি সিরাজ সাঁই নামের এক তত্ত্বজ্ঞসিদ্ধ বাউল গুরুর সান্নিধ্যে এসে বাউল মতবাদে দীক্ষা গ্রহণ করেন। দীক্ষা গ্রহণের পর গুরুর নির্দেশে লালন কুষ্টিয়া শহরের নিকটবর্তী কালীগঙ্গা নদীর তীরে ছেঁউড়িয়া গ্রামে এসে বাংলা ১৮২৩ সাল মতান্তরে ১৮৩০ সাল নাগাদ আখড়া স্থাপন করেন। এখানে তিনি স্থানীয় কারিকর সম্প্রদায়ের সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। তাদের দানে ও অনুদানেই আখড়াটি গঠে ওঠে। অল্প দিনের মধ্যেই লালনের প্রভাব ও পরিচিতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। লালন আজ নেই। কিন্তুু রয়ে গেছে তাঁর অমর সৃষ্টি। যার মধ্য দিয়ে তিনি বেঁচে আছেন এবং বেঁচে থাকবেন বাঙালীর মরমী মানসপটে।
×