ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

দিনে ১০ কোটির ব্যবসা

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২ মার্চ ২০১৮

দিনে ১০ কোটির ব্যবসা

রহিম শেখ ॥ গত ছয় বছরে এক তোলা সোনাও আমদানি করা হয়নি। অথচ দৈনিক ১০ কোটি টাকার সোনার বাজার রয়েছে দেশে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, চোরাইপথে আনা সোনায় নির্ভর করে চলছে দেশের সোনা ব্যবসা। চোরাইপথে দেশে ঢুকতে আটকও হয়েছে মণকে মণ সোনা। যার পরিমাণ ৪ হাজার ৬৩০ কেজি বা প্রায় ১১৬ মণ। যদিও স্থানীয় বাজারের চাহিদার কিছু অংশ পূরণ করছে ব্যাগেজ রুলের আওতায় আনা সোনা। তবে এ মাধ্যমে কি পরিমাণ সোনা দেশে এসেছে এর কোন পরিসংখ্যান নেই কারও কাছে। অবশেষে ২৫ বছর পর আবারও স্বর্ণ আমদানি নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর মাধ্যমে স্বর্ণ, রৌপ্য, ডায়মন্ড, পাথরসহ মূল্যবান ধাতু আমদানি সহজ করা হবে। আমদানির আড়ালে কেউ যেন অর্থ পাচার বা জালিয়াতি করতে না পারে, সে লক্ষ্যে সরকার কয়েকটি ব্যাংক ঠিক করে দেবে। সরকার নির্ধারিত ওইসব ব্যাংকের মাধ্যমেই জুয়েলারি শিল্পে ব্যবহৃত স্বর্ণ ও কাঁচামাল আমদানি করতে হবে। এ বিষয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) সদস্যদের নিয়ে বৈঠক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে জুয়েলারি শিল্প নীতিমালা করার লক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও একাধিক বৈঠক করেছে। সম্প্রতি লিখিত মতামত চেয়ে বিভিন্ন সরকারী দফতরে চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। জানা গেছে, শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, দেশে মোট সোনার সামগ্রী তৈরিতে প্রায় ৪০ শতাংশ পুরনো সোনা ব্যবহার করা হয়। বাকি ৬০ শতাংশ তৈরি হয় নতুন সোনায়। এনবিআরের হিসাবে, ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খুলে হিসাব মতো রাজস্ব পরিশোধ করে বৈধভাবে সোনা আমদানি করে ব্যবসা করলে সরকারী কোষাগারে বছরে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা জমা হওয়ার কথা। কিন্তু গত ছয় বছরে ব্যাংকের মাধ্যমে অনুমতি নিয়ে এক তোলা সোনাও আমদানি হয়নি। এ পর্যন্ত ‘যা কিছু রাজস্ব আদায় হয়েছে ব্যাগেজে আনা সোনায়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ব্যাগেজে আনা সোনায় ভরিপ্রতি ১৫০ টাকা দিয়ে ৩১৫ কেজি সোনা দেশে আসে। এতে সরকারের রাজস্ব আদায় হয় পাঁচ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। এর পরের ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ব্যাগেজে আনা সোনায় শুল্ক বাড়িয়ে প্রতি ভরি তিন হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়। ওই বছর ৪১১ কেজি সোনা ব্যাগেজে দেশে আনায় সরকারের রাজস্ব খাতে আয় হয় সাড়ে ১২ কোটি টাকা। এ বিষয়ে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ জনকণ্ঠকে বলেন, বেশির ভাগ ব্যবসায়ীর লক্ষ্য থাকে কম বিনিয়োগে অধিক মুনাফা করা। ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খুলে সোনা আমদানি অনেক বিনিয়োগের বিষয়। তার চেয়ে কম বিনিয়োগে ব্যাগেজে সোনা আনা সম্ভব। আবার ব্যাগেজে আনা সোনার চেয়ে কম বিনিয়োগ করতে হয় চোরাই সোনা সংগ্রহে। তাই যা সহজ এবং মুনাফার সেদিকেই ঝোঁক বেশির ভাগ ব্যবসায়ীর। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি বাড়ানোর সুপারিশ করে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, একটি নির্দিষ্ট সময় অর্থাৎ পাঁচ বছর বা সাত বছর বিদেশে বসবাস করলেই কেবল ব্যাগেজ রুলের আওতায় সোনা আনার অনুমোদন দেয়া উচিত। একই পাসপোর্টে বছরে তিনবারের বেশি সোনা ব্যাগেজ রুলের আওতায় আনার অনুমোদন দেয়া বন্ধ করতে হবে। এছাড়া সোনা ব্যবসায়ীদের ব্যাংকে এলসি খুলে সোনা আনতে বিশেষ রাজস্ব ছাড়ের সুবিধা ঘোষণা করতে হবে। তাহলে বৈধপথে সোনা আমদানি বাড়বে। বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির (বাজুস) সভাপতি এবং ভেনাস জুয়েলার্সের মালিক গঙ্গা চরণ মালাকার বলেন, রাজস্ব ছাড়ের সুবিধা দিলে অবৈধভাবে সোনা আমদানি বন্ধ হবে। এছাড়া চোরাই সোনা নিয়মমতো নিলামে তুলে আমাদের মাঝে সরবরাহ করা হোক। আমি আশা করি, এতে অবৈধ সোনার ব্যবসা বন্ধ হবে। এনবিআর সূত্রে জানা যায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বিদেশ থেকে ফেরার সময় একজন বিমানযাত্রী লাগেজে করে বৈধভাবে সর্বোচ্চ ২০০ গ্রাম পর্যন্ত স্বর্ণালঙ্কার বিনা শুল্কে দেশে আনার সুবিধা পেতেন। এছাড়া সর্বোচ্চ ২০০ গ্রাম পর্যন্ত সোনার বার আনতে একজন যাত্রীকে ভরিপ্রতি (এক ভরিতে ১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) ১৫০ টাকা হারে শুল্ক দিতে হতো। সে সময় ভারতগামী এক যাত্রী ২০০ গ্রাম পর্যন্ত সোনা সঙ্গে করে নিতে পারতেন। সেজন্য বিমানবন্দরে তাকে শুল্ক পরিশোধ করতে হতো ভরিপ্রতি ৯ হাজার টাকা। ওই সময় বাংলাদেশে ব্যাগেজ রুলের আওতায় শুল্ক কম থাকায় বিদেশ থেকে সোনা এনে বাংলাদেশ থেকে চোরাইপথে ভারতে পাচারের হার উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ওই নিয়ম পরিবর্তন করে বিনা শুল্কে ১০০ গ্রাম পর্যন্ত স্বর্ণালঙ্কার আনার সুযোগ রাখা হয়। এছাড়া ২০০ গ্রামের বারের ক্ষেত্রে শুল্ক আনতে ভরিপ্রতি তিন হাজার টাকা পরিশোধ করার বিধান রাখা হয়। জানা গেছে, স্বর্ণ বার আমদানি করে অলঙ্কার রফতানির লক্ষ্যে ১৯৯৩ সালে একটি নীতিমালা করার উদ্যোগ নেয়া হয়। প্রস্তাবিত ওই নীতিমালায় বৈধ ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যিকভাবে স্বর্ণ আমদানির অনুমতি দিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণে ওয়্যার হাউসে স্বর্ণ রাখার প্রস্তাব করা হয়। তবে এনবিআর ও অর্থ মন্ত্রণালয় তাদের এ প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ওই নীতিমালা আর আলোর মুখ দেখেনি। চোরাইপথে আনা স্বর্ণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানো হচ্ছে। নীতিমালার উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলীপ কুমার আগরওয়াল জনকণ্ঠকে বলেন, নীতিমালা না থাকায় জুয়েলারি খাতের আশানুরূপ অগ্রগতি হচ্ছে না। নীতিমালা করার বিষয়ে এবারের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী সুস্পষ্ট ঘোষণা দিলেও শেষ পর্যন্ত তা হবে কি-না সে বিষয়ে এখনও তাদের সংশয় কাটেনি। নীতিমালা ছাড়াও এ খাতের জন্য একটি আলাদা অর্থনৈতিক অঞ্চলের দাবি করে তিনি বলেন, বিদ্যমান শুল্ক কমানোসহ সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেলে জুয়েলারি শিল্প অনেক বড় রফতানি খাতে পরিণত হবে। বৈধপথে স্বর্ণ আমদানির প্রক্রিয়াকে আরও সহজ করার লক্ষ্যে সম্প্রতি বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) সঙ্গে বৈঠকে বসে বাংলাদেশ ব্যাংক। শীঘ্রই বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে চিঠি দিয়ে পরামর্শ চাওয়া হবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা। এর আগে জুয়েলারি শিল্প বিকাশের লক্ষ্যে নীতিমালা করার লক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে উপস্থিত অনেকেই নির্দিষ্ট কয়েকটি ব্যাংকের মাধ্যমে স্বর্ণ আমদানির পক্ষে মত দেন। তাদের মতে নির্দিষ্ট ব্যাংকের মাধ্যমে আমদানি করা স্বর্ণ দিয়ে তৈরি অলঙ্কার রফতানি করার পর আবার আমদানির অনুমতি পাবে। নির্দিষ্ট ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী কী পরিমাণ স্বর্ণ আমদানি ও রফতানি করছে তার হিসাব রাখবে। কোন অসঙ্গতি পেলে ওই ব্যাংক সে বিষয়ে রিপোর্ট করবে। এছাড়া আমদানির আড়ালে কেউ যেন অর্থ পাচার বা জালিয়াতি করতে না পারে, সে লক্ষ্যে সরকার কয়েকটি ব্যাংক ঠিক করে দেবে। সরকার নির্ধারিত ওইসব ব্যাংকের মাধ্যমেই জুয়েলারি শিল্পে ব্যবহৃত স্বর্ণ ও কাঁচামাল আমদানি করতে হবে। বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার সোনার দোকান রয়েছে। এসবের মধ্যে প্রায় ৭০০ সমিতির সদস্য। সমিতির সাবেক সভাপতি দিলীপ রায় জনকণ্ঠকে বলেন, এ দেশে দৈনিক ১০ কোটি টাকার সোনার বাজার আছে। এলসি খুলে সোনা আমদানিতে মোট মূল্যের ৪ শতাংশ পরিশোধ করতে হয়। এলসি খুলে সোনা দেশে পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় ১৫ দিন থেকে এক মাস। অথচ সোনার বাজারদর বিনা নোটিসে অতি দ্রুত ওঠানামা করে। এতে লোকসানের আশঙ্কা থাকে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে সোনার চাহিদার বড় অংশ পূরণ হয় যাত্রীদের ব্যাগেজে আনা সোনায়। প্রবাসীরা বা সাধারণ যাত্রীরা দেশে আসার সময় যে পরিমাণ সোনা নিয়ে আসেন এর প্রায় অর্ধেকই বিক্রি করে দেন। আবার পুরনো সোনা ভেঙ্গেও নতুন গয়না তৈরি হয়। এনবিআর সূত্র মতে, আটক সোনা নিলামে তুলে বিক্রির বিধান থাকলেও দীর্ঘদিন নিলাম করা হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত মোট চার হাজার ৬৩০ কেজি বা প্রায় ১১৬ মণ সোনা আটক করেন শুল্ক গোয়েন্দারা। এর মধ্যে সর্বোচ্চ মানের ৫৭ মণ সোনা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে আছে। অস্থায়ী খাত তথা অনিষ্পন্ন অবস্থায় জমা আছে এক হাজার ২৫৬ কেজি বা ৩১ মণের সামান্য বেশি সোনা। এর বাইরে স্বর্ণালঙ্কার জমা আছে ৩১৫ কেজি বা প্রায় আট মণ। কিছু আদালতের নির্দেশে শুল্ক পরিশোধ সাপেক্ষে দাবিদারদের কাছে ফেরত দেয়া হয়। বাকি সোনা কেন্দ্রীয় ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও এনবিআরের একজন করে প্রতিনিধির উপস্থিতিতে নিলাম ডাকার কথা থাকলেও ২০০৮ সালের ২৩ জুলাইয়ের পর আর নিলামে তোলা হয়নি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান জনকণ্ঠকে বলেন, নিলাম একটি চলমান বিষয়। বাংলাদেশ ব্যাংক মাঝেমধ্যেই বাজেয়াফত স্বর্ণ নিলাম করে এর অর্থ সরকারী কোষাগারে জমা করে থাকে। তিনি বলেন, নিলামের সময় যে স্বর্ণগুলো আন্তর্জাতিকমানের (পাকা সোনা বা গোল্ডবার) সেগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে নেয়া হয়। আর যেটি আন্তর্জাতিক মানের নয় সেগুলো নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়। সম্প্রতি স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়, দেশীয় বাজারের চাহিদা পূরণে মজুদকৃত স্বর্ণ বৈধ জুয়েলারি ব্যবসায়ীদের কাছে ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করলে সরকার বিশাল অঙ্কের নগদ অর্থ পাবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর বলেন, তারা যে চিঠি দিয়েছে, সেটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। এ বিষয়ে বাজুসের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগরওয়াল জনকণ্ঠকে বলেন, দীর্ঘ সময় স্বর্ণের নিলাম হচ্ছে না। এ বিষয়ে আমরা বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়ে আসছি। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ইতিবাচক সাড়া মেলেনি।
×