ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ইসলামে মাতৃভাষার গুরুত্ব

প্রকাশিত: ০৪:১২, ২ মার্চ ২০১৮

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ ইসলামে মাতৃভাষার গুরুত্ব

(গত সপ্তাহের পর) আমাদের বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম প্রচার শুরু হয় ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ‘উমর ইবনুল থাত্তাব রাদিআল্লাহু তা’আলা আন্্হুর খিলাফতকালের মধ্যভাগ-৬৪০ খ্রিস্টাব্দ থেকে। বাংলাদেশে যাঁরা ইসলাম প্রচার করতে সুদূর ‘আরব, ইয়েমেন, পারস্য, তুরস্ক, মিসর, খোরাসান প্রভৃতি বিভিন্ন ভাষাভাষী অঞ্চল থেকে আসেন; তাঁরা এখানকার ভাষাকে আত্মস্থ করে এখানকার ভাষাতেই ইসলামের দিকে এখানকার মানুষকে আহ্বান করেন। ইসলামে মাতৃভাষার প্রতি কদর দেয়ার নির্দেশ থাকায় এবং প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম অন্য দেশের ভাষা শিক্ষা করবার হুকুম দেয়ায় মুসলিমদের মধ্যে নিজ মাতৃভাষার প্রতি যেমন দরদ রয়েছে, তেমনি অন্যের মাতৃভাষার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মানসিকতা রয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ইসলামের আগমনের পূর্বে বাংলাদেশের মানুষের মাতৃভাষা দারুণ অবহেলিত ও লাঞ্ছিত অবস্থায় ছিল। এ ভাষায় জ্ঞানচর্চা করলে রৌরব নামক নরকে যেতে হবে এমনতর কঠোর ও ভীতিপ্রদ বিধানও জারি করা হয় ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসক শ্রেণী দ্বারা। মূলত বাংলাদেশে ইসলামের আগমনের ফলে এ দেশের মানুষের সার্বিক অনুভবে যেমন স্বস্তির হাওয়া প্রবাহিত হয়, তেমনি এ দেশের মানুষ স্বাধীনতার পথে হাঁটতে শুরু করে, আপন সত্তাকে প্রকৃত শান্তির দ্বারা আপ্লুত করার পথপরিক্রম লাভ করতে থাকে, তাদের মাতৃভাষা দিয়ে আপন ভুবন নির্মাণের সুযোগ লাভ করে। আর তা এখানে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে সম্ভব হয়েছিল। ইসলাম মাতৃভাষার প্রতি যতœবান হওয়ার জোর তাকিদ দিয়েছে। জ্ঞানচর্চার সর্বোত্তম মাধ্যমই হচ্ছে নিজের ভাষা বা মাতৃভাষা। মাতৃভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা করলে অতি সহজেই তা আয়ত্তে আনা সম্ভব হয় এবং দেশের মানুষের সামনে তা তুলে ধরা সম্ভব হয়। সভ্যতার চরম বিকাশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রাচীন যুগের সভ্যতা গোঁজ আকৃতির বিশেষ ধরনের লিখন পদ্ধতি উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে মানবসভ্যতাকে লেখার জগতে নিয়ে আসে। ইরাকের তথা মেসোপটেমিয়ার সুমেরদের দ্বারা উদ্ভাবিত সেই গোঁজ আকৃতির লেখার ভাষা ছিল সুমেরদের মাতৃভাষা। এমনিভাবে মিসরের ছবি অক্ষর দ্বারা লিখন পদ্ধতি এবং ফিনিশীয়দের আলফা বায়ত বা আলফাবেট ব্যবহারের ভাষাও ছিল তাদের মাতৃভাষা। বাংলাদেশের মানুষের মাতৃভাষায় সাহিত্যচর্চার সুদূরপ্রসারী অগ্রসরতার সূচনা হয় বাংলার সুলতানগণের একান্ত পৃষ্ঠপোষকতায় সেই ইংরেজী ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে। এই প্রসঙ্গে ডক্টর শ্রী দীনেশ চন্দ্র সেনের একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন : ‘মুসলমান আগমনের পূর্বে বঙ্গভাষা কোন কৃষক রমণীর ন্যায় দীনহীন বেশে পল্লী কুটিরে বাস করিতেছিল। বাংলা ভাষা মুসলমান প্রভাবের পূর্বে অতীব অনাদর ও উপেক্ষায় বঙ্গীয় চাষার গানে কথঞ্চিত আত্মপ্রকাশ করিতেছিল। প-িতেরা নস্যাধ্যার হইতে নস্য গ্রহণ করিয়া শিখা দোলাইয়া সংস্কৃত শ্লোক আবৃত্তি করিতেছিলেন এবং ‘তৈলাধার পাত্র’ কিংবা ‘পাত্রাধার তৈল’ এই লইয়া ঘোর বিচারে প্রবৃত্তি ছিলেন। তাঁহারা হর্ষচরিত হইতে ‘হারং দেহি মে হরিণি’ প্রভৃতি অনুপ্রাসের দৃষ্টান্ত আবিষ্কার করিয়া আত্মপ্রসাদ লাভ করিতেছিলেন...। সেখানে বঙ্গভাষার স্থান কোথায়? ইতরের ভাষা বলিয়া বঙ্গভাষাকে প-িতম-লী ‘দূর দূর’ করিয়া তাড়াইয়া দিতেন, হাঁড়ি-ডোমের স্পর্শ হইতে ব্রাহ্মণেরা যেরূপ দূরে থাকেন বঙ্গভাষাও তেমনই সুধী মহলে অপাঙ্ক্তেয় ছিলÑ তেমনই ঘৃণা, অনাদার ও উপেক্ষার পাত্র ছিল। কিন্তু হীরা-কয়লার খনির মধ্যে যেমন জহুরীর আগমনের প্রতীক্ষা করে, শুক্তির ভেতর মুক্তা লুকাইয়া থাকিয়া যেরূপ ডুবুরির অপেক্ষা করিয়া থাকে, বঙ্গভাষা তেমনই শুভদিন, শুভক্ষণের প্রতীক্ষা করিতেছিল। মুসলমান বিজয় বাংলা ভাষার সেই শুভদিন, শুভক্ষণের সুযোগ আনয়ন করিল।’ আরবীতে কুরআন মজিদ নাজিল হওয়ায় আরবী ভাষাভাষী অঞ্চলের নিকট এটা সহজে অনুধাবনীয় হয়ে যায়। তাঁরা কুরআন মজিদের বাণী ও শিক্ষা বাইরের দুনিয়ায় ছড়িয়ে দেন, যা বিভিন্ন অঞ্চলের নিজ নিজ মাতৃভাষায় অনূদিত হয়ে জগতজুড়ে ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটায়। আরবী ভাষায় কুরআন মজিদ নাজিল হওয়ার কারণ সম্পর্কে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : এ আমি নাজিল করেছি আরবী ভাষায় কুরআন যাতে তোমরা বুঝতে পার (সূরা ইউসুফ : আয়াত ২)। আরবী ভাষায় কুরআন মজিদ নাজিল হওয়ার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে : এভাবেই আমি কুরআন নাজিল করেছি আরবী ভাষায় এবং তাতে বিশদভাবে বিবৃত করেছি সতর্কবাণী, যাতে ওরা ভয় করে অথবা তা হয় তাদের জন্য উপদেশ (সূরা তহা : আয়াত ১১৩)। কুরআন মজিদে আরও ইরশাদ হয়েছে : আমি এই কুরআন মানুষের জন্য সর্বপ্রকার দৃষ্টান্ত উপস্থিত করেছি যাতে ওরা উপদেশ গ্রহণ করে। আরবী ভাষায় এই কুরআন বক্রতামুক্ত, যাতে মানুষ সাবধানতা অবলম্বন করে (সূরা যুমার : আয়াত ২৭-২৮)। আরবী ভাষায় কুরআন, জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য (সূরা হামীম আস্ সাজ্দা : আয়াত ২)। এভাবে আমি আপনার প্রতি কুরআন নাজিল করেছি ‘আরবী ভাষায় যাতে (হে রসূল) আপনি সতর্ক করতে পারেন মক্কা ও এর চতুর্দিকের জনগণকে (সূরা শূরা : আয়াত ৭)। কুরআন মজিদে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের মাতৃভাষায় নাজিল করে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু মাতৃভাষার গুরুত্ব যে কত তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন : আমি আপনার ভাষায় কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি যাতে ওরা উপদেশ গ্রহণ করে। (সূরা দুখান : আয়াত ৫৮)। ইসলাম মাতৃভাষার প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করায় ইসলাম যেখানেই গিয়েছে সেখানে জনগণের মাতৃভাষাকে আপন করে নিয়েছে এবং তাকে যথাযথ পরিচর্চা করার প্রেরণায় উদ্দীপ্ত করেছে। তাই তো আমরা লক্ষ্য করি বাংলাদেশে ইসলাম আসার পর থেকে এর মর্যাদা সমুন্নত হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে বাংলাভাষী জনসংখ্যা দুই-তৃতীয়াংশের বেশি মানুষ ইসলাম অবলম্বী। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে এর বিকাশ ও উন্নয়নে পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন বাংলার মুসলিম সুলতানগণ। আবার এই ভাষার ওপর যখন আঘাত এলো তখন এই ভাষার মর্যাদা রক্ষা করবার জন্য, এই ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য যাঁরা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তাঁরাও মুসলিম। এই ভাষার জন্য যাঁরা জান কোরবান করলেন তাঁরা হচ্ছেন আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, রফিক, শফিক, সালাম প্রমুখ। তাঁরা মাতৃভাষার জন্য শহীদ হয়ে এক কালজয়ী ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন ১৯৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারিতে। যা পরবর্তী সময় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে পরিণত হয়েছে। মাতৃভাষা আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর এক অনন্য নিয়ামত। এর মর্যাদা সমুন্নত রাখার মধ্যেই আমাদের জ্ঞানরাজ্যে বিচরণের সার্থকতা নিহিত রয়েছে। সমাপ্ত... লেখক : পীর সাহেব দ্বারিয়াপুর শরীফ সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন
×