ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মাধ্যমিকে ঝরে পড়া-

প্রকাশিত: ০৪:১১, ২ মার্চ ২০১৮

মাধ্যমিকে ঝরে পড়া-

শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। শুধু তাই নয়, সুশিক্ষিত জাতি গড়ারও অন্যতম নিয়ামক শক্তি। শিক্ষার দ্বার সবার জন্য অবাধ আর মুক্ত না হলে উন্নয়নের গতিধারা ব্যাহত হবে এ ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে সিংহভাগ মানুষ বাস করে গ্রামে। হতদরিদ্র কিংবা নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠী যেখানে ভাত, কাপড় আর বাসস্থানের সংস্থান করতেই হিমশিম খায় সেখানে শিক্ষা নামক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকারও পড়ে চরম বিপাকে। যদিও বর্তমান সরকার প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক এবং অবৈতনিক করার ফলে এই পর্যন্ত শিশু-কিশোরদের শিক্ষার্থী জীবন মোটামুটি পার হয়ে যায়। কিন্তু মাধ্যমিকে প্রবেশ করার প্রয়োজনীয় সময়টিতে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা জীবনে হরেক রকম বাধাবিপত্তি সামনে এসে দাঁড়ায়। অসহায় এবং দুর্বল গোষ্ঠী হিসেবে জনসংখ্যার অর্ধাংশ এই নারী জাতি পড়ে সবচেয়ে বেশি বিপাকে। কারণ মাধ্যমিকের পর থেকে পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের সংখ্যা যখন কমতে থাকে সেখানে ছাত্রীর আধিক্য বেশি। রক্ষণশীল সমাজের অপসংস্কার আর প্রথাসিদ্ধ নিয়মের আওতায় ছেলেরা সব সময়ই সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকে। মানুষের পাঁচটি নিত্য এবং মৌলিক চাহিদার ক্ষেত্রেও এই বিধির কোন অন্যথা হতে দেখা যায় না। ফলে সব ধরনের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে মেয়েরা অনেক পেছনে পড়ে যায়। সুতরাং শিক্ষা নামক অতি প্রয়োজনীয় অধিকারও নারী-পুরুষের সমতার ভিত্তিতে হয় না। ফলে শিক্ষার মাঝপথে ঝরে পড়া ছাত্রদের তুলনায় ছাত্রীরা থাকে এগিয়ে। বাংলাদেশ শিক্ষা, তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর বার্ষিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জরিপ ২০১৭-এ প্রকাশিত তথ্যে স্পষ্ট হয় ষষ্ঠ শ্রেণীতে যে পরিমাণ ছাত্রী ভর্তি হয় মাধ্যমিক শেষ হওয়ার আগেই সেখান থেকে প্রায়ই ৪১.৫২ শতাংশ মাঝপথেই শিক্ষা জীবন থেকে বের হয়ে আসে। ছাত্রদেরও বিচ্যুতি ঘটে কিন্তু তাদের সংখ্যা কম। তবে লক্ষণীয় মাধ্যমিকে অধ্যয়নরত মেয়েদের সংখ্যা ৫৪.০২ শতাংশ। এর বিপরীতে ছাত্রদের সংখ্যা ৪৫.০৮ শতাংশ। ফলে ঝরে পড়ার ক্ষেত্রেও ছাত্রীদের সংখ্যা বেশি হওয়াই সঙ্গত। জরিপে নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয় ছাত্রীদের ৪১.৫২% ঝরে পড়ে আর সেখানে ছাত্রদের সংখ্যা ৩৩.৪৩ শতাংশ। এমন তারতম্যের পেছনে আর্থ-সামাজিক কারণও সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। আর্থিক দীনতার কারণে ছেলেমেয়ে যে কোন একজনের লেখাপড়া বন্ধ করতে হলে বাবা-মা নির্দ্বিধায় মেয়েটির শিক্ষা জীবনের ইতি টানেন। কারণ প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী ছেলেরা বংশ রক্ষা আর বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মার দায়িত্বও পালন করবে। আর মেয়ের ব্যাপারে প্রথম এবং প্রধানতম সমাধান বিয়ে দিয়ে পরের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া। এই সামাজিক অপসংস্কার আজও ঠেকানো গেল না। ছেলেকে শিক্ষিত করার জন্য দরিদ্র পিতা-মাতার নিঃস্ব হওয়ার নজির গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে। আর মেয়েকে পাত্রস্থ করার জন্য ঋণগ্রস্ত পিতা আজীবন এই বোঝা বয়ে বেড়ান। ছেলেমেয়ের এই অসম ব্যবধান একেবারে পরিবারের মূল শেকড়ে গাঁথা। যেখান থেকে বের হতে আরও যে কত সময় লাগবে তা বলা মুশকিল। ফলে সমাজ কর্তৃক চাপানো বাল্যবিয়ে এমন একটি অভিশাপ, যা কোন মেয়ের শিক্ষা জীবনকেই বিধ্বস্তই করে না পাশাপাশি যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার সব পথ বন্ধ করেও দেয়। বাল্যবিয়ে মানেই অকাল মাতৃত্ব। সুতরাং সমাজের অর্ধাংশ এই গোষ্ঠী যদি এমন সামাজিক দুর্বিপাকে পড়ে জীবন গড়ার সুবর্ণ সময়কে অকালে শেষ করে দেয়, তাহলে দেশের সার্বিক অগ্রগতিও হুমকির মুখে পড়তে পারে। শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার এবং তা সকলের জন্য। এই শিক্ষা যে কোন ব্যক্তিকে সচেতন হতে শেখায়, অধিকার বোধ জাগ্রত করে সর্বোপরি দেশের যথার্থ নাগরিক হওয়ার ক্ষেত্রেও মূল চালিকাশক্তি। সুতরাং এমন অসহনীয় দুর্বিপাক থেকে মেয়েদের বের হয়ে আসতেই হবে। নিজেদের সচেতনতা বোধই জেগে উঠতে হবে। দৃঢ় বিশ্বাসে নিশ্চিত জীবন গড়ার পথ বেছে নেয়া ছাড়া বিকল্প কোন পথ সামনে নেই। নিজের সমস্ত নাগরিক অধিকারকে যথাসম্ভব অর্জন করতে হবে। প্রয়োজনে লড়াই করে হলেও জীবনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে।
×