ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বইমেলার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি

প্রকাশিত: ০৪:১০, ২ মার্চ ২০১৮

বইমেলার প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি

দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেল মাসব্যাপী মহান একুশের বইমেলা। বসন্তের মাতাল সমীরণ এবং অল্প-স্বল্প ঝড়ো হাওয়া ও বৃষ্টিতে সমাপ্তিটা হয়ত একেবারে মধুর হয়নি। যথাযথ প্রস্তুতি না থাকায় অনেকের স্টল উড়ে গেছে দমকা হাওয়ায়, বইপত্র কিছু ভিজে গেছে বৃষ্টিতে। তবু সার্বিকভাবে বিপুল সংখ্যক দর্শক-শ্রোতার সমাগম ও বেচা-বিক্রিতে খুশি প্রকাশকগোষ্ঠী। এবার বইমেলার পরিসর বেড়েছে। ফলে দর্শক-শ্রোতারা সানন্দে ঘুরে বেড়িয়েছেন যত্রতত্র। সার্বিক পরিবেশ ছিল পরিচ্ছন্ন, সুন্দর, ¯িœগ্ধ ও আলোকোজ্জ্বল। আবার কিছু অসঙ্গতি এবং অসন্তোষও যে ছিল না তা নয়। যেমন, চিত্রশিল্পীরা বইমেলাসহ সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের অপরিহার্য অঙ্গ। মেলায় সমাগত বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের পোর্ট্রেট এঁকে তারা দু’চার টাকা সম্মানী নিয়ে থাকেন। বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ তাদের এ কাজে অযথা বাগড়া দিয়েছে। অথচ এর কোন প্রয়োজন ছিল বলে মনে হয় না। বইমেলা যেমন বইয়ের মেলা, তেমনি বিভিন্ন শ্রেণীর ও পেশার মানুষের মিলনমেলাও বটে। বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে বইমেলা চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে থাকে একুশে ফেব্রুয়ারিতে। বলা যায়, মূলত পহেলা ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করলেও প্রকৃতপক্ষে ২১তম দিনটি বইমেলার শ্রেষ্ঠতম দিন। কেননা, এদিন মধ্যরাতের প্রায় প্রথম প্রহর থেকেই জনসমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে, সুবিশাল ও মহিমাম-িত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সবুজ চত্বরে, সুউচ্চ ও দৃষ্টিনন্দন স্বাধীনতার আলোকস্তম্ভের আশপাশে। এ সময়ে বই কেনার হিড়িকও পড়ে যায় সব বয়সীদের মাঝে। নিঃসন্দেহে এটি একটি ভাল ও উদ্দীপক উদ্যোগ। দেশের প্রকাশকম-লী, লেখক সম্প্রদায় সর্বোপরি বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ প্রায় উন্মুখ হয়ে থাকেন গৌরবোজ্জ্বল এই দিনটির জন্য। স্বভাবতই বইয়ের বেচাকেনাও বেড়ে যায় বহুগুণ। তবে কিছু কথা, কিছু প্রশ্ন এখানে উঠতে পারে অনিবার্যভাবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মেলায় এবার নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার। বই বিক্রির পরিমাণ প্রায় ৭১ কোটি টাকা। এতগুলো বইয়ের মধ্যে মানসম্মত ও পাঠোপযোগী কয়টি? এমনকি যে একুশে ও ভাষা আন্দোলন নিয়ে আমরা গর্ব করি এবং যেটি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত, সে সম্পর্কেও বইমেলায় গ্রন্থের অভাব প্রকট। একই কথা প্রযোজ্য মুক্তিযুদ্ধের বইয়ের ক্ষেত্রেও। এত দৈন্য, এত অপ্রতুলতা কেন? প্রকাশকরা বলছেন, এ বিষয়ে ভাল গবেষণা ও পা-ুলিপির অভাব প্রকট। আজকাল লেখকরাও কেন যেন পাঠকপ্রিয় ও চটুল বই লিখতে সমধিক আগ্রহী। সিরিয়াস বই লেখালেখিতে তরুণদের তেমন আগ্রহ নেই বললেই চলে। তা কেন হবে? তরুণ প্রজন্ম যদি ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলন, দেশ-কাল-কৃষ্টি-ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-সমাজ-নৃতত্ত্ব সম্পর্কে সম্যক না জানে, তাহলে সমৃদ্ধ ও স্বশিক্ষিত হবে কিভাবে? শুধু মোবাইল, স্মার্টফোন, ইন্টারনেট, ফেসবুকে আসক্ত হলে তো একটি দেশের তরুণ প্রজন্ম ক্রমশ বিজ্ঞান ও মননে যথার্থ অর্থে আধুনিক ও শিক্ষিত হয়ে গড়ে উঠতে পারে না। অপ্রিয় হলেও সত্য যে বহু প্রত্যাশিত বইমেলা তরুণ প্রজন্মের সেই আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ করতে পারছে না অনেকটা এ কারণেই বইমেলার সাফল্য ও সার্থকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তদুপরি অধিকাংশ বই অসম্পাদিত, ভুলবাক্য ও বানানে ভর্তি, যেটি পীড়াদায়ক। বইমেলার উদ্দেশ্য-বিধেয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা কারও অভিপ্রায় হতে পারে না। অমর একুশে ও ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে যে স্বতঃস্ফূর্ত বইমেলার সূচনা ও বিবর্তন, তা এককথায় প্রশংসনীয় নিঃসন্দেহে। কেননা, একে ঘিরে গল্প-কবিতা-উপন্যাস-প্রবন্ধ-শিশুসাহিত্যসহ সৃজনশীল লেখনী শিল্প ও প্রকাশনা শিল্পের সুবিশাল এক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে দেশে, যার অর্থনৈতিক ব্যাপ্তি ও পরিধি কম নয়। এখন সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের অবশ্য কর্তব্য হবে একে প্রকৃত অর্থে আন্তর্জাতিক পরিম-লে মানসম্মত ও প্রতিযোগিতামূলক করে তোলা।
×