ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সাদিকুর রহমান

চরম বিরক্তিকর

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ১ মার্চ ২০১৮

চরম বিরক্তিকর

যে উচ্চ আওয়াজ আমাদের মানসিক ও শারীরিক বিভিন্ন সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাই সাধারণত শব্দ দূষণ বলে চিহ্নিত। বিনা প্রয়োজনে হর্ন বাজানো, উচ্চৈঃস্বরে গান বাজানো, বসতি এলাকায় বিভিন্ন কলকারখানার তীব্র শব্দসহ উচ্চ মাত্রায় মাইক লাগানো ইত্যাদি শব্দ দূষণের কারণ। বাংলাদেশে আজ যে কয়টি বড় সমস্যা আছে তার মাঝে এটি অন্যতম। যা কেবল আমাদের চেষ্টায় দূর করা সম্ভব। আর সে জন্য প্রয়োজন সচেতনতা তৈরি করা। এটি সাধারণত চরম বিরক্তিকর, মেজাজ খিটখিটেকারী পারস্পরিক সম্পর্ক বিনষ্টকারী, অস্থিরতা বৃদ্ধিকারী, শ্রবণশক্তি বিনষ্টকারী, উচ্চ রক্তচাপ, মাথা ধরা, বদহজম, পেপটিক আলসার এবং অনিদ্রাসহ আরও অনেক রোগের কারণ। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরগুলো আজ এই অবস্থার সম্মুখীন। ঢাকায় বাস করে আর শব্দ দূষণে শিকার হয়নি এমন লোক পাওয়া দুষ্কর। এটি আজ মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ছে। মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকারের হাইড্রোলিক আওয়াজ শব্দ দূষণ কে চরম অসহনীয় মাত্রায় নিয়ে গেছে। ঢাকা শহরের শব্দ দূষণের জন্য সাধারণত প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল, ট্রেন, বিমানের অতি উচ্চমাত্রার আওয়াজ দায়ী। সহজভাবে বলতে গেলে বলতে হয় সমস্যাটি আজ আমাদের জন্য একটি বড় মাপের চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে। শব্দ দূষণ রোধের জন্য পর্যাপ্ত আইন আছে, কিন্ত কার্যকারিতা বা প্রয়োগ ক্ষেত্র শূন্যের কাছাকাছি। ২০০২ সালে বাংলাদেশে পরিবেশ আইনজীবী সংস্থা (বেলা) শব্দ দূষণ বন্ধের জন্য উচ্চ আদালতে একটি রিট পিটিশন দায়ের করে। যার প্রেক্ষিতে একই বছরের ২৭ মার্চ হাইড্রোলিক হর্ন ও বিকট আওয়াজ সৃষ্টিকারী যে কোন ধরনের হর্ন গাড়িতে লাগানো নিষেধ করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে গাড়িতে বাল্ব হর্ন লাগানোর আদেশ জারি করা হয়। এই আইন ভঙ্গকারীর বিরুদ্ধে শাস্তির বিধানও রাখা হয়। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশ ১৯৭৫ এর ২৫,২৭ ও ২৮নং ধারা অনুযায়ী শব্দ দূষণ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে অর্থদণ্ড ও কারাদণ্ড উভয় বিধানই রাখা হয়। মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ এর ১৩৯ ও ১৪০নং ধারায় নিষিদ্ধ হর্ন ব্যবহার ও আদেশ অমান্য করার জন্য কারাদণ্ড ও অর্থদ-ের বিধান রাখা হয়। এছাড়াও ১৯৯৭ সালের পরিবেশ ও বন সংরক্ষণ আইনে দেখতে পাই আরও কিছু আইন। এই আইনে বলা হয় ভোর ছয়টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত ৪৫ ডেসিবল ও রাতে ৩৫ ডেসিবল, আবাসিক এলাকায় দিনে ৫০ ও রাতে ৪০ ডেসিবল, মিশ্র এলাকায় দিনে ৬০ ও রাতে ৫০ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৭০ ও রাতে ৬০ ডেসিবল, শিল্প এলাকায় দিনে ৭৫ ও রাতে ৭০ ডেসিবলের মাঝে শব্দের মাত্রা থাকা আবশ্যক। ওই আইন অনুযায়ী হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকার নির্ধারিত কিছু প্রতিষ্ঠানের ১০০ মিটার এলাকা নীরব এলাকা বলে চিহ্নিত করা হয়। শব্দ দূষণ রোধ করার জন্য সরকার হাইড্রোলিক হর্ন আমদানি ও রফতানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।কিন্তু এসব আইন যেন শুধু নাম মাত্র। যা আমাদের জন্য ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নয়’ প্রবাদ বাক্যটি স্মরণ করিয়ে দেয়। নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম বলেন রাজধানীতে যানজট সমস্যার পাশাপাশি শব্দ দূষণ একটি মারাত্মক সমস্যা। আইন থাকলেও এর যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় দূষণ মাত্রা আরও বেড়ে চলছে। এ জন্য প্রয়োজন সচেতনতা। ঢাকা মেডিক্যালের একজন সহযোগী অধ্যাপক নাক, কান গলা বিশেষজ্ঞ বলেন ‘ক্রমাগত শব্দ দূষণের ফলে কানের টিস্যুগুলো পর্যায়ক্রমে বিকল হয়ে পড়ে। তখন সে স্বাভাবিক শব্দ বা আওয়াজ শুনতে পায় না। শিশুর মাঝে ভীতি দেখা দেয়। আবার অতিরিক্ত শব্দ দূষণের জন্য মানুষের কারোনারি রোগ হতে পারে। পরিবেশ গবেষকের মতে ‘শব্দ দূষণের ফলে মানুষের মানসিক ও শারীরিক বিপত্তি ঘটে। রক্তচাপ ও স্বাভাবিক হৃদকম্পন ব্যাহত হয়। শ্রবণশক্তি কমে যায়। হাসপাতালের রিপোর্ট অনুসারে দেখা যায় যে, আগত রোগীদের মাঝে ১০ ভাগ অতিমাত্রায় শব্দের ভুক্তভোগী এবং স্থায়ী বধিরতায় আক্রান্ত। আর তা পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধিই পাচ্ছে। যা ২০১৩ সালে ছিল ৫-৭ ভাগ। সরকারের পক্ষ থেকে পুরোপুরি চেষ্টা চলছে এ কথাও বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে বলা যায় না। যার দরুন ভুগতে হচ্ছে আমাদের মতো সাধারণ মানুষদেরই। কাজেই সরকারের পক্ষ থেকে যেমন এর প্রতিকারে নিতে হবে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা, তেমনি আমাদেরকেও হতে হবে সচেতন। তবেই হয়ত সম্ভব হবে আস্তে আস্তে শব্দ দূষণকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা থেকে
×