ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আমাদের শিক্ষামন্ত্রীর ‘সন্দেহ’ হয় না -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৬:২৯, ১ মার্চ ২০১৮

আমাদের শিক্ষামন্ত্রীর ‘সন্দেহ’ হয় না -স্বদেশ রায়

আমাদের শিক্ষামন্ত্রী যে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছেন- এ নিয়ে এখন আর কারও কোন সন্দেহ নেই। ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়ে গেছে, তাঁর পক্ষে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার হাল ধরা সম্ভব নয়। অন্য কোন দেশে হলে এতদিনে তিনি সত্য স্বীকার করে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিতেন। এখানে কেউ কেউ বলতে পারেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, শিক্ষামন্ত্রী বা সচিব তো প্রশ্ন ফাঁস করছেন না। তাহলে শিক্ষামন্ত্রীর দোষ কোথায়? প্রধানমন্ত্রী যে কথা বলেছেন, তা শত ভাগ সত্য- মন্ত্রী বা সচিব প্রশ্ন ফাঁস করছেন না। তা বলে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেননি দেশে পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে না। তিনিও বলেছেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। অন্যদিকে শুধু যে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে তা নয়, ছাত্রদের যেসব বই পড়ানো হচ্ছে এসব বইয়ের বিষয়বস্তুর মান নিয়েও শিক্ষাবিদরা অনেক লেখালেখি করেছেন। এ নিয়ে আমার মতো অর্ধ শিক্ষিত সাংবাদিকও এ কলামে বহুবার লিখেছি। যেমন, এবারের প্রাথমিক শিক্ষার বইয়ে ছাগলকে গাছে ওঠানো হয়নি ঠিকই, প্রশ্ন হলো ‘অজ’ মানে ছাগল এটা কেন লিখতে হবে। অ তে কি আর কোন সহজ শব্দ নেই। খুঁজে পেতে একটি অপ্রচলিত শব্দ ‘অজ’কেই বের করে আনতে হবে, এর অর্থ কী? এসব পণ্ডিত দিয়ে বই না লেখালে কি চলে না? এদের দিয়ে কেন বই লেখানো হয়। এর পেছনে কোন্ স্বার্থ কাজ করে? শিক্ষামন্ত্রী শুরু থেকে এ অবধি শিক্ষার এই খুঁটিনাটি বিষয় খুব যে বুঝেছেন বা বোঝার চেষ্টা করেছেন, তা মনে হয় না। তা যদি তিনি বুঝতেন, তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় যখন ইংরেজীতে দুঃখজনক রেজাল্ট করল সমস্ত ছাত্র, সে সময়ে তিনি ওইভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে না বলে নিজের ব্যর্থতা চিন্তা করতে পারতেন। করেননি তিনি। কেন করেননি আমরা জানি না। তবে সাংবাদিক বজলুর রহমান ভাই যেমন মিতভাষী ছিলেন, তেমনি খুব স্বল্প কথার ভেতর দিয়ে চমৎকার রসিকতা করতেন। তাঁর কাছ থেকে শোনা একটি ছোট্ট গল্প মনে পড়ছে- তাঁর এক সাব-এডিটর নাকি প্রায়ই বানান ভুল করতেন। তিনি তাকে ডেকে বলেন, তোমার কোন বানান নিয়ে সন্দেহ হলে তুমি অভিধানের সাহায্য নিতে পার। ওই সাব-এডিটর স্বগর্বে বলেন, ভাই আমার কোন সন্দেহ হয় না। আমাদের শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়ের অবস্থাও মনে হয় তেমনি, ওনার কোন ‘সন্দেহ’ হয় না। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে একের পর এক ব্যর্থতা নামলেও তাঁর অভিধান দেখার কোন প্রয়োজন পড়ে না। আমাদের শিক্ষামন্ত্রীর তুলনায় সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া অনেক বেশি পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন আমাদের শেয়ারবাজারে ধস নামে। শাহ এএমএস কিবরিয়া এক মুহূর্ত দ্বিধা করেননি, বরং অকপটে স্বীকার করেন, ‘আমি শেয়ারবাজার বুঝি না।’ বাস্তবে শেয়ারবাজারের সেকেন্ডারি মার্কেটে এক ধরনের জুয়া সব সময় চলে। এই জুয়ার সঙ্গে জনাব কিবরিয়া যে বেসিক অর্থনীতির ছাত্র ছিলেন, তার কোন সম্পর্ক নেই। সেকেন্ডারি শেয়ার মার্কেটের এই জুয়ার বড় বড় প্লেয়ার পৃথিবীতে আছেন, যারা কোনদিন বেসিক অর্থনীতির কোন বই পড়েননি। এ কারণে জনাব কিবরিয়া এই সত্য স্বীকার করে কোনরূপ ছোট হননি, বরং তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর অভিধান দেখার দরকার। অন্যদিকে, সংবাদের ওই সাব-এডিটরের মতো আমাদের শিক্ষামন্ত্রীর কোন সন্দেহ হয় না। শুধু এখানেই শেষ নয়, তিনি বলেছেন, ১৯৬১ সাল থেকে এ দেশে প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। ১৯৬১ সালের পরে আমরা অনেকেই এ দেশে স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় অবধি ছোটখাটো গোটা পাঁচ-ছয়েক পরীক্ষা দিয়েছি। নিজেও যেমন জানি না সে সময়ে প্রশ্ন ফাঁস হতো কিনা! তেমনি সিনিয়র, জুনিয়র অনেকের কাছে শুনেছি, তারাও জানেন না যে, প্রশ্ন ফাঁস হতো। শিক্ষামন্ত্রীও ১৯৬১’র পরে নিশ্চয়ই একটা-দুটো পরীক্ষা দিয়েছেন। সকলেরই প্রশ্ন- আমরা কেউ জানলাম না, তিনি জানলেন কিভাবে প্রশ্ন ফাঁস হতো? আমরা এখনও আশা করব, নিশ্চয়ই তিনি তাঁর নিজের কোন পরীক্ষার আগে জানতে পারেননি, প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে বা সে প্রশ্নটি তিনি দেখেছিলেন! আর যদি তিনি সেটা দেখে থাকেন তাহলে প্রধানমন্ত্রী তাঁকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিলেও তাঁর বিষয়টি খোলাখুলি প্রধানমন্ত্রীকে বলা উচিত ছিল- নৈতিকভাবে আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিতে পারি না। কারণ আমার জীবনেও এ ঘটনা আছে। শুধু বঙ্গবন্ধুকন্যা হিসেবে নয়, বাংলাদেশের সব থেকে সফল উন্নয়নের নেতা শেখ হাসিনাকে দেশের অনেক মানুষ প্রাণ দিয়ে ভালবাসেন। এই ধরনের মানুষের সঙ্গে নানান অনুষ্ঠানে বা নানানভাবে কথাবার্তা হয়। তাদের ভেতর একটাই দুঃখ সব সময়ই দেখি, তাঁরা বলেন- এই ভদ্র মহিলাকে (শেখ হাসিনা) একাই সব কিছু বহন করতে হবে? তাঁর ওপর কাজ চাপানো, তাঁকে দুঃখ দেয়ার তো একটা সীমা থাকা উচিত! যেমন প্রধানমন্ত্রী সেদিন প্রেস কনফারেন্সে শিক্ষামন্ত্রীকে ডিফেন্ড করতে বাধ্য হলেন। এর আগেই তো প্রধানমন্ত্রীকে এ দায় থেকে মুক্ত করা উচিত ছিল শিক্ষামন্ত্রীর। তিনি যদি তার আগে এই দায়ভার নিয়ে পদত্যাগ করতেন, তাহলে সরকারেরও দুর্নাম কুড়াতে হতো না, শেখ হাসিনাকে শুধু তাকে ডিফেন্ড করা থেকে রক্ষা পেতে হতো না, তাঁর অর্জনও ক্ষতিগ্রস্ত হতো না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সম্প্রতি একটা অঙ্ক ভাইরাল হয়েছে, শেখ হাসিনার আকাশচুম্বী অর্জনকে নাহিদ দিয়ে গুণ করলে উত্তর কত হয়। সবাই উত্তর লিখেছে শূন্য। যে কোন কিছুকে শূন্য দিয়ে গুণ করলে শূন্যই হয়। যারা ফেসবুকে লিখছেন, তারা অধিকাংশই তরুণ। তারা জানে তাদের একটা সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন শেখ হাসিনাÑ তাই তারা এত ক্ষুব্ধ। তবে তাদের সঙ্গে সমান ক্ষুব্ধ না হতে পারলেও বলব, মি. নাহিদের এখন চিন্তা করা উচিত যে, তিনি আর শেখ হাসিনার বোঝা হয়ে থাকবেন কি-না? কারণ, যিনি নয় বছরে পারেননি, তিন নয় মাসে পারবেন- এ আশা করি কিভাবে? বাস্তবে নুরুল ইসলাম নাহিদরা ভুল করেছেন। তাঁদের নিজ কাজ নিয়ে আরও অনেক বেশি মনোযোগী হতে হতো শুরু থেকেই। কারণ, তাঁদের মনে রাখা উচিত ছিল শেখ হাসিনা তাঁদের যে দায়িত্ব ও সম্মান দিয়েছেন, এটা শেখ হাসিনা না দিলে তাঁরা যেমন কোনদিন পেতেন না, তেমনি দাবিও করতে পারেন না। কারণ, যে দলের নেতা শেখ হাসিনা, যে দলকে নিয়ে শেখ হাসিনা গর্ব করে বলেন, এই দলই আমাকে আজ এখানে এনেছে। যদিও আজ দল আর শেখ হাসিনা সমার্থক শব্দ হয়ে গেছে, যেমন বাংলাদেশে সমার্থক শব্দ শেখ হাসিনা আর উন্নয়ন। যা হোক, এই দলে নুরুল ইসলাম নাহিদদের কোন অবদান নেই। তাঁরা তাঁদের রাজনীতি করে ব্যর্থ হয়ে যখন পথে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, সে সময় শেখ হাসিনা তাঁদের আঁচলে আশ্রয় দিয়েছেন। তাঁদের দলের ঘটি-বাটি চুকে যাওয়ার পরেই তাঁরা আওয়ামী লীগে এসেছেন। ১৯৭৫-এর পরে দুর্দিনে তাঁরা আসেননি, বরং তখন তাঁরা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে খাল কেটেছেন। তাই তাঁদের উচিত ছিল, শেখ হাসিনা যখন তাঁদের দায়িত্ব দিয়েছেন, তখন সেটাকে পবিত্র জ্ঞান করে সবকিছু ভুলে সঠিকভাবে কাজ করা। এমনকি বছরখানেক পরে তাঁর নিজের কাজ নিজেরই মূল্যায়ন করে উচিত ছিল শেখ হাসিনাকে বলাÑ এই কাজের আমি যোগ্য নই, আমাকে অন্য কোথাও দেন। শেখ হাসিনার মতো উপকারীর কাছে এই সততাটুকু নিয়ে তাঁদের থাকা উচিত ছিল। নিজের অযোগ্যতা অসংকোচে প্রকাশের ভেতর অগৌরবের কিছু নেই। যা হোক, সামনে (২ এপ্রিল) আবার এইচএসসি পরীক্ষা। দেশবাসী আবারও শঙ্কিত। অভিভাবকরাও শঙ্কিত। এই শঙ্কা থেকে দেশবাসীকে বের করে আনতে হলে দরকার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে গোটা সমাজকে একটা নাড়া দেয়া। এখানে প্রশাসনিকভাবে যেমন সকল ব্যবস্থা নিতে হবে, তেমনি সামাজিকভাবে একটি আন্দোলনের সূচনা করতে হবে যে, আমার সন্তানকে আমি নীতিহীন করব না, সে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন দেখবে না। তাছাড়া যারা প্রশ্ন ফাঁস করছে প্রয়োজনে তাদের বিচার জনগণ নিজহাতে তুলে নেবে। যারা একটি জেনারেশন নষ্ট করছে তাদের সম্পর্কে চারপাশের মানুষকে সজাগ থেকে তাদেরকে ধরতে হবে। তাদেরকে প্রয়োজনে জনতার আদালতে বিচার করতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে তারা আর অমন কাজ না করে। এছাড়া পুলিশ প্রশাসন ও দেশের প্রচলিত আইন তো আছেই। অন্যদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় পরিবর্তন আনতে হবে। সেখানে এইচএসসি ও এসএসসির মার্কের মূল্যায়ন হবে না। শুধু ভর্তি পরীক্ষার ফলের ওপরই ছাত্র ভর্তি হবে। এভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি একের পর এক সবাই তাদের ভর্তি পদ্ধতি বদলে ফেলে, তখন আর এই জিপিএ’র দৌড়ও থাকবে না। প্রশ্ন ফাঁসও থাকবে না। তখন প্রকৃত লেখাপড়া শিখতে হবে ছাত্রদের। তবে এ কাজ আর এই আন্দোলন নুরুল ইসলাম নাহিদের নেতৃত্বে হবে না। তিনি এখন জাতির কাছে একজন শতভাগ অগ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। তাই এখানে শিক্ষিত, সৎ ও ত্যাগী কাউকে দিয়ে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে হবে। কারণ, আর যাই হোক- শেখ হাসিনার দেশে শিক্ষার এ হাল মানায় না। [email protected]
×