ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সোলার মিনি গ্রিডের ইউনিট মূল্য স্বাভাবিকের অনেক বেশি

গরিবকে সবচেয়ে বেশি দামে বিদ্যুত কিনতে হচ্ছে!

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১ মার্চ ২০১৮

গরিবকে সবচেয়ে বেশি দামে বিদ্যুত কিনতে হচ্ছে!

রশিদ মামুন ॥ দেশের সব থেকে গরিব মানুষ সব থেকে বেশি দামে বিদ্যুত কিনছে। এদের সকলেই জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে ক্ষতবিক্ষত বিধ্বস্ত জীবন বয়ে চলেছে। দেশের সোলার মিনিগ্রিড থেকে এসব মানুষ প্রতিইউনিট বিদ্যুত কিনছে ৩০ টাকা দরে। সরকারী সহায়তা পাওয়া তো দূরের কথা জীবনের চাকা ঘোরাতে দুর্গম এলাকার দুর্গতজনেরা প্রতিইউনিট বিদ্যুতে গ্রিডের বিদ্যুতের তুলনায় ২৬ টাকা ৫০ পয়সা অতিরিক্ত গুনছে। তবে অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে প্রকল্পের প্রচার কাজেই দাতারা প্রকল্প ব্যয়ের কয়েকগুণ খরচ করছেন। সত্যিকার অর্থে সহায়তা করে পাশে দাঁড়ানোর পরিবর্তে বিশ^ দরবারে গরিবের রক্তচোষা প্রকল্পগুলোকেই মডেল হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। জানতে চাইলে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শক্তি ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সাইফুল হক বলেন, সরকারের উচিত ছিল মিনিগ্রিডের দাম নির্ধারণ করে দেয়া। যেভাবে গ্রিড এলাকার বিদ্যুতে ভর্তুকি দেয় সেভাবে অফগ্রিডে ভর্তুকির ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। দুঃখজনক হলেও সত্যি তা করা হয়নি। তিনি বলেন, সাধারণত এসব এলাকার মানুষ ২৫ থেকে ৩৫ টাকা ইউনিটে বিদ্যুত কিনছে। যা অত্যন্ত বেশি। দেশের অন্তত ১৬ শতাংশ এলাকা অফগ্রিড আওতাভুক্ত। এসব এলাকায় দুই কোটি মানুষ বসবাস করেন। সরকার দেশের সকল মানুষের ঘরে বিদ্যুত পৌঁছে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আগামী চারবছর অর্থাৎ ২০২১ সালের মধ্যে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দেখা গেছে দুর্গম চরাঞ্চলে এখনই গ্রিড নির্মাণ সম্ভব নয়। এসব এলাকায় বিকল্প হিসেবে মিনি অফগ্রিড সৌরবিদ্যুত উৎপাদন করা হচ্ছে। সূর্যের আলোতে উৎপাদিত বিদ্যুত ব্যাটারিতে ধরে রাখা হয়। এই বিদ্যুত রাতে সরবরাহ করা হয়। এসব স্থানে উদ্যোক্তা নিজেই সরবরাহ লাইন এবং মিটার স্থাপন করে বিদ্যুত সরবরাহ করে। উদ্যোক্তাই বিদ্যুতের বিলও আদায় করেন। উল্লেখ্য, এর আগে ভোলাও গ্রিডের বাইরে ছিল। দেশে এ ধরনের ১২ মিনি সোলার গ্রিড থেকে বিদ্যুত বিতরণ করা হচ্ছে। আরও ১৩টি মিনিগ্রিড নির্মাণ করা হচ্ছে। এর কোন গ্রিডের বিদ্যুতের দর ইউনিটপ্রতি ২৫ টাকার কম নয়। গড়ে এসব মিনিগ্রিড থেকে অন্তত ৩০ টাকায় প্রতিইউনিট বিদ্যুত কিনছে গ্রাহক। অথচ বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) গ্রিডভুক্ত এলাকায় সমাজের প্রান্তিক মানুষের বিদ্যুতের দর নির্ধারণ করেছে শূন্য থেকে ৫০ ইউনিট ৩ টাকা ৫০ পয়সা প্রতিইউনিট। একইভাবে মধ্যবিত্ত শূন্য থেকে ৭৫ ইউনিটপ্রতি ইউনিটের দর নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ টাকা আর উচ্চমধ্যবিত্তের বিদ্যুতের দর ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিটের দর ৫ টাকা ৪৫ পয়সা। এমনকি উচ্চবিত্তের বিদ্যুতের দামও ৯ টাকা ৩০ পয়সা থেকে ১০ টাকা ৭০ পয়সার মধ্যে প্রতিইউনিট বিক্রি হচ্ছে। সঙ্গত কারণে অফগ্রিড এলাকার প্রান্তিক মানুষের বিদ্যুতের এত বেশি দাম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দেশের সোলার মিনিগ্রিডের মধ্যে ভোলার মনপুরা’ ধরে অনুসন্ধানে নেমে দেখা গেছে, কেন্দ্রটি ১৭৭ কিলোওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতার। কেন্দ্রটি নির্মাণ করছে সোলার ইলেক্ট্রো বাংলাদেশ লিমিটেড। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে এখান থেকে ৩০ হাজার মানুষ বিদ্যুতের এই সুবিধা ভোগ করছে। মিনিগ্রিডের বিদ্যুত ব্যবহার করে ১০০ অটোরিক্সা চার্জ দেয়া হয়। এখানে সৌরবিদ্যুতের কারণে মানুষের জীবনে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। লেগেছে ডিশ লাইন, ঘরে উঠেছে ফ্রিজ, পাড়ার মোড়েই গড়ে উঠেছে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, চলছে স’মিল, ম্যাকানিক্যাল ওয়ার্কশপ, ফার্নিচার কারখানা। এসব এলাকার কোন কোনটিতে ক্ষেত্র বিশেষ কাঁচা-পাকা রাস্তাও নেই। বিদ্যুত কেন্দ্রটি নির্মাণে ৫০ ভাগই অনুদান দেয়া হয়েছে। উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করেছে ২০ ভাগ আর স্বল্পসুদে প্রকল্প ব্যয়ের বাকি ৩০ ভাগ ঋণ দিয়েছে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (ইডকল)। ইডকলের মডেল অনুসরণ করেই প্রকল্পগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। এই প্রকল্প ব্যয়ের ২০ ভাগ অর্থাৎ উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের ব্যয় করতে হয়েছে। টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। মোট প্রকল্প ব্যয় হয় ৩৪ কোটি ২০ লাখ টাকা। এই প্রকল্পের উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান মুখ্য সচিব বরাবর একটি আবেদনে বলছে, বিশ^ব্যাংকের বাংলাদেশ প্রতিনিধি, ডিএফআইডি’র প্রতিনিধি, যুক্তরাজ্য দূতাবাসের প্রতিনিধি, বিশ^ব্যাংক দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিনিধি, ওয়াশিংটন ডিসি থেকে আসা বিশ^ব্যাংকের আট জন নির্বাহী পরিচালকসহ মোট ৪৭ জনের একটি দল মনপুরাতে গিয়ে চারদিন ধরে উপকার ভোগীদের সাক্ষাতকার নেয়। সি প্লেন ব্যবহার করে ডকুমেন্টারি নির্মাণ করে। এ সফর আর ডকুমেন্টারি নির্মাণেই প্রকল্প ব্যয়ের কয়েকগুণ বেশি ব্যয় হয়েছে। এরপর বিশ^ব্যাংক সারাবিশে^ এ প্রকল্পটিকে মডেল হিসেবে প্রচার করেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন উদ্যোক্তা বলছেন, ব্যবসায়িক উদ্দেশে বিশ^ব্যাংকের এই প্রচার। বিশ^ব্যাংক যে অনুদান দেয় তাও অন্যদের কাছ থেকেই তারা সংগ্রহ করে। এ প্রচারও অনুদান সংগ্রহের জন্যই। এখানে গরিব এই বিদ্যুত কিনতে গিয়ে আরও গরিব হবে কি না তা দেখার দায় বিশ^ব্যাংকের নয়। এজন্যই প্রকল্প ব্যয়ের চেয়ে বেশি ব্যয় হয় ঘোরাফেরা আর খাওয়া দাওয়া করে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য। জার্মান বিশেষজ্ঞ আলেকজান্ডার কাইজার ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে ফেনির মনপুরার সোলার মিনিগ্রিড নিরীক্ষা করেছে। ওই নিরীক্ষণে বলা হচ্ছে, ১০ বছরব্যাপী যে অফগ্রিড সোলার মিনিগ্রিড রয়েছে তার বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি উৎপাদন খরচ হচ্ছে ৯০ টাকা। এখানে দাতাসংস্থা ৩০ টাকা আর গ্রাহক ৩০ টাকা পরিশোধ করার পরও ৩০ টাকা লোকসান হচ্ছে। জানতে চাইলে সোলার মিনিগ্রিড এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি প্রকৌশলী ডি এম মুজিবুর রহমান বলেন, আমরা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছি। তবে এখনও এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। তিনি বলেন, নীতির পরিবর্তন করে বিদ্যুতের দাম না কমালে ঘরে ঘরে মানুষকে বিদ্যুত পৌঁছে দেয়ার সু উদ্যোগটি বড় বাধার মুখে পড়বে। যেখানে সমাজের সব থেকে পিছিয়ে পড়া মানুষের বেশি সুবিধা পাওয়ার কথা ছিল সেখানে তারা সব থেকে বেশি দামে বিদ্যুত কিনছে। অন্যদিকে গরিব গ্রাহক ৩০ ওয়াটের একটি বিদ্যুত সাশ্রয়ী সোলার ফ্যান কিনছে ৯ হাজার ৫০০ টাকায়, এলইডি বাতির দরও সাধারণ বাতির চারগুণ, আর বিদ্যুত সাশ্রয়ী ফ্রিজের দরও সাধারণ ফ্রিজের দ্বিগুণ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব ক্ষেত্রেও ভর্তুকি না দিলে একেবারে প্রান্তিক মানুষের জীবন মান উন্নয়ন সম্ভব নয়। দেশে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। যদিও অফগ্রিড এলাকার মানুষের বিদ্যুতের দামের বিষয়ে কমিশন এখনও কিছু করেনি। প্রান্তিক মানুষের বিদ্যুতের উচ্চমূল্যের বিষয়ে জানতে চাইলে কমিশনের সদস্য মিজানুর রহমান বলেন, প্রান্তিক মানুষের বিদ্যুতের দাম কমাতে প্রতিযোগিতার দরকার। তিনি বলেন যেহেতু অফগ্রিড এলাকায় সৌর বিদ্যুত ছাড়া বিকল্প কোন উপায় নেই। কিন্তু এরপরও প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করে একাধিক কোম্পানির মাধ্যমে দরপ্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হলে দাম কমে আসতে পারে। ভারতেও প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে সৌরবিদ্যুতের দাম কমানো হয়েছে। সৌর বাংলা মিনিগ্রিডের উদ্যোক্তা এখলাসুর রহমান পলাশ বলছেন, যে পরিমাণ চাহিদা তার পুরোটা সৌরবিদ্যুত দিয়ে মেটানো সম্ভব হয় না। চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা জেনারেটর চালাতে হয়। এতে বিদ্যুতের দাম বেশি পড়ে যায়। গ্রিডের বিদ্যুতের দামের তুলনায় বেশি হওয়ায় স্থানীয়রা বিদ্যুতের দাম কমানোর জন্য ইতোমধ্যে আন্দোলন করছে। দেশের প্রথম সোলার মিনিগ্রিডের উদ্যোক্তা পলাশ জানান, আমরাও চাই এ দিকে সরকার নজর দেবে। যাতে প্রান্তিক মানুষ কম দামে বিদ্যুত পায়।
×