ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সংবাদ সম্মেলনে তিন নোবেল জয়ী নারী ;###;বাংলাদেশ সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা ;###;মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর নীরবতায় ক্ষোভ প্রকাশ

আন্তর্জাতিক আদালতে রাখাইনের গণহত্যায় দোষীদের বিচার চাই

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ১ মার্চ ২০১৮

আন্তর্জাতিক আদালতে রাখাইনের গণহত্যায় দোষীদের বিচার চাই

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের নির্মূলে পরিকল্পিতভাবে গণহত্যা চালান হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী তিন নারী। ইয়েমেনের তাওয়াক্কল কারমান, উত্তর আয়ারল্যান্ডের মেরেইড ম্যাগুয়ার এবং ইরানের শিরিন এবাদি ৮ দিনের সফরে ২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে আসেন। তারা কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে গিয়ে তাদের ওপর ঘটে যাওয়া নির্যাতনের গল্প শুনে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। বুধবার রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে নারীপক্ষ আয়োজিত ‘রোহিঙ্গা নারীদের পাশে নোবেল বিজয়ী নারী প্রতিনিধি দল ২০১৮’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে তারা নিজেদের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন। তারা বলেন, রোহিঙ্গা নির্যাতনের দায় এড়াতে পারেন না আউং সান সুচি ও তার সরকার। দোষীদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের দাবি তুলেছেন তিন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী। রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপেরও দাবি করেছেন তারা। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী তিন নারী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে শুনে এসেছেন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংঘটিত গণহত্যা, গণধর্ষণ ও শিশুহত্যার করুণ বর্ণনা। রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর আচরণের কথা শুনে তারা চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। তারা বলছেন, ‘আউং সান সুচিকে আমরা রোহিঙ্গা নির্যাতন বন্ধে ও তাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিতে অনুরোধ জানিয়ে অনেক বার্তা পাঠিয়েছি। কিন্তু তিনি কোন উত্তর দেননি। তাই আমরা মিয়ানমারে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করব।’ এ সফর, অভিজ্ঞতা ও বক্তব্য আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে ভূমিকা রাখবে বলে আমরা আশাবাদী। তবে এ বিষয়ে মূল ভূমিকা রাখার কথা যাদের, সেই বিশ্বনেতারা কী পদক্ষেপ নেন, সেটাই দেখার বিষয়। ইরানের নোবেল বিজয়ী শিরিন এবাদি বলেন, রাখাইনে নিপীড়িত রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ আজ বাংলাদেশে এসে পরবাসীর জীবনযাপন করছে। এসব সর্বস্বান্ত রোহিঙ্গার জন্য অমুসলিম রাষ্ট্রগুলো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। অথচ সৌদি-আরব, কুয়েতসহ মুসলিম দেশগুলো চুপ করে আছে। তিনি সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।’ তিনি বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বলেন, ‘আমরা ২৮ ফেব্রুয়ারি সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাত করেছি। তিনি অত্যন্ত হৃদয়বান। এ জন্যই তিনি মানবিকতার খাতিরে এসব অসহায় মানুষগুলো আশ্রয় দিয়েছেন। তাদেরকে দেখভাল করছেন। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষকেও অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বিপদের সময় এ দেশের মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াতে জানেন। এ জন্যই ভিনদেশী রোহিঙ্গা জনগণ এ দেশে টিকে থাকতে পারছেন।’ ইয়েমেনের নোবেল বিজয়ী তাওয়াক্কল কারমান আবেগে আপ্লুত হয়ে বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের কথা শুরু থেকেই শুনেছি। কিন্তু বস্তব চিত্র দেখে ও শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেছি। মিয়ামারের মিলিটারিরা যেভাবে সে দেশের লাখ লাখ মুসলিম নারীদেরকে ধর্ষণ করেছে ও তাদের চোখের সামনে স্বামী-সন্তানদেরকে আগুনে পুড়িয়ে, গাছে ঝুলিয়ে এমনকী ছুরিকাঘাত করে নির্মমভাবে হত্যা করেছে তা সত্যিই ভাষায় প্রকাশ করার নয়। আমরা তাদেরকে দেখার জন্য ও সাহায্য করার জন্য বাংলাদেশে এসেছি। অথচ বিশ্ববাসী এ গণহত্যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে না। মুসলিম রাষ্ট্রগুলো চুপ। আউং সান সুচি চুপ করে আছেন। তিনিই দায়ী এ বর্বরতম ঘটনার জন্য।’ বোন আউং সান সুচিকে জেগে ওঠার আহ্বান জানিয়ে কারমান বলেন, ‘তার পদত্যাগ করা উচিত। তিনি শান্তিতে নোবেল বিজয়ী। পাশপাশি তিনি মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর। এর দায়ভার সুচি এড়াতে পারেন না। এই অপরাধে তার বিচার হতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের সরকার এবং জনসাধারণকে ধন্যবাদ জানান। আমরা এই সঙ্কটকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একটি গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছি এবং সঙ্কটের আশু সমাধান দাবি করছি। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রায় কিছুই করছে না। তাদের নীরবতা লজ্জার। তিনি বলেন, যারা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অপরাধকর্মে জড়িত, তাদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার করা উচিত।’ উত্তর আয়ারল্যান্ডের নোবেল বিজয়ী ম্যারেইড ম্যাগুয়ার বলেন, ‘যে নারীদের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি, তারা তাদের পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছেন। বেশিরভাগ নারীই ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। মায়ের চোখের সামনে শিশুসন্তানকে জীবিত পুড়িয়ে হত্যাসহ জবাই করেছে মিয়ানমারের সেনারা। এটা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সরকার এবং সেনাবাহিনীর সুস্পষ্ট গণহত্যা। মিয়ানমার থেকে, সে দেশের ইতিহাস থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা করছে তারা।’ তিনি বলেন, ‘আমরা ঘৃণাভরে মিয়ানমার সরকারের এই গণহত্যা নীতিকে প্রত্যাখ্যান করছি। দোষীদের অবিলম্বে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার করতে হবে।’ মানবতার এই চরম অবমাননা সত্ত্বেও বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো এ সঙ্কট নিরসনে কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি বলেও মন্তব্য করেন এই আইরিশ নোবল জয়ী। তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত তাদের ভূমিকা শুধু কথামালা আর রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ সহায়তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞার হুমকি দেয়া হয়েছিল। এর কোন বাস্তবায়ন এখনও পরিলক্ষিত হয়নি। চীন, ভারত ও রাশিয়ার মতো বৃহৎ শক্তিগুলোও কার্যত এ ইস্যুতে নীরব ভূমিকা পালন করছে। সর্বশেষ মিয়ানমারের জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপে সম্মত হয়েছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রিরা। কিন্তু রাখাইনে যে ধরনের অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তা সুস্পষ্টভাবেই মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং এ জন্য যারা দায়ী তাদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার হওয়া উচিত। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিষয়টির প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে এ সঙ্কট নিরসনে অবিলম্বে কার্যকর ব্যবস্থা নেবে, এটাই কাম্য। তিনি আরও বলেন, পালিয়ে আসা ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় ও মানবিক সেবা দিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যে হৃদ্যতা দেখিয়েছেন তা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার দিয়ে স্বসম্মানে ফিরিয়ে নিতে হবে। এ জন্য মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করতে হবে। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ, নিপীড়ন ও নির্যাতনের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে সুচি ও তার সরকারের বিচার হওয়া উচিত। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন কানাডার নোবেল উইমেনস ইনিশিয়েটিভের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক এলিজাবেথ বার্নেস্টাইন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নারীপক্ষ’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরীন পারভিন হক। বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবস্থা প্রত্যক্ষ করে রোহিঙ্গা নারীদের ওপর তীব্র সহিংসতা, বিশেষত যৌন সহিংসতা বিষয়গুলোকে দৃষ্টিগোচর করার লক্ষ্যে নোবেল উইমেনস ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশের নারী সংগঠন, নারীপক্ষ’র সঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে একটি প্রতিনিধি দল গঠন করেছে। এ লক্ষ্যেই তিন নারী নোবেলজয়ীর বাংলাদেশ সফর। ইতোমধ্যেই তারা ২৫-২৭ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো পরিদর্শন করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত ॥ মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর নৃশংসতাকে গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করে নোবেল বিজয়ী তিন নারী বুধবার বলেছেন, এ নৃশংসতার জন্য দায়ীদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। সকালে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এক সৌজন্য সাক্ষাতকালে তারা একথা বলেন। খবর বাসস’র। নোবেল বিজয়ী এই তিন নারী হলেন, শিরিন এবাদি, মাইরিয়াদ ম্যাগুইয়ার ও তাওয়াক্কুল কারমান। তারা বলেন, রাখাইন রাজ্যে গণহত্যা চালানোর জন্য মিয়ানমারকে অবশ্যই বিচারের সম্মুখীন করতে হবে এবং সারা বিশ্বকে এ গণহত্যার বিপক্ষে দাঁড়াতে হবে। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। তিনি বলেন, নোবেল বিজয়ীরা বলেন, জাতিগত নিধনযজ্ঞ মিয়ানমার সরকারের একটি পদ্ধতিগত নীতি। আর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এক্ষেত্রে পদক্ষেপ নেয়া দরকার।
×