ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শ্রাবণী আক্তার সান

সেই আনুশকাই প্রেরণা কোহলির

প্রকাশিত: ০৬:৪৭, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

সেই আনুশকাই প্রেরণা কোহলির

‘পৃথিবীতে যা কিছু সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার কারিয়াছেন নারী, অর্ধেক তার নর’Ñ তুখোড় কোহলির ক্ষেত্রে এই অপ্তবাক্য যেন সত্যি হয়ে ওঠে! এই তো কদিন আগের ঘটনা, বিয়ের পর দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসেই ব্যর্থ হয়েছিলেন কোহলি। ভারতীয় অধিনায়ক মাত্র ৫ রানে সাজঘরে ফিরে গেলে এর জন্য কড়া সমালোচনা শুনতে হয়েছিল তাঁর স্ত্রী বলিউড অভিনেত্রী আনুশকা শর্মাকে! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোহলির রান না পাওয়ার জন্য সমর্থকরা কঠোর ভাষায় আনুশকাকে দায়ী করেছিলেন। সেই কোহলিই কি না, ওয়ানডে সিরিজে দারুণ উজ্জ্বল। ছয় ম্যাচের এই সিরিজের তিনটিতেই হাঁকিয়েছেন সেঞ্চুরি। গড়েছেন দ্বিপক্ষীয় কোন সিরিজে সর্বাধিক ৫৫৮ রানের নতুন রেকর্ড। ‘আমার এই সাফল্যের নেপথ্যে কিছু কাছের মানুষ রয়েছেন। বিশেষ করে, আমার স্ত্রী আনুশকা। পুরো সিরিজে সে প্রেরণা জুগিয়েছে আমাকে। তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। অতীতে এর জন্য অনেক কথা শুনতে হয়েছে আমার স্ত্রীকে। এই প্রেরণা থেকে প্রাপ্তি একটা দুর্দান্ত অনুভূতি।’ প্রতিক্রিয়ায় বলেন কোহলি। এর মধ্য দিয়ে নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে প্রথম কোন সিরিজে জয়ের (ওয়ানডে ৫-১এ) স্বাদ পেয়েছে মোড়ল ভারতীয়রা। আসলেও আনুশকাকে অনেকবাই সমালোচনা সইতে হয়েছে। মাঝখানে কোহলির ব্যর্থতার জন্য সমর্থকরা আনুশকাকে দায়ী করেছিলেন। বিশেষ করে গত অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপের সময় তাঁদের নিয়ে অনেক ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করা হয়েছিল। সে সময় কোহলিও এর জবাব দিয়েছিলেন, ‘একজন মানুষ হিসেবে বলতে চাই, আমি ভীষণ আহত হয়েছি। যারা আমাদের নিয়ে আজেবাজে কথা বলেছে এবং যে ভঙ্গিতে বলেছে, তাদের নিজেদের নিয়েই লজ্জিত হওয়া উচিত। এ ঘটনায় ব্যক্তিগতভাবে আমি খুব হতাশ।’ বিরাট কোহলির নামের পাশে ‘অবিশ্বাস্য’ শব্দটাও এখন বেমানান! ব্যাটসম্যানরা মাঠে নামেন রানের জন্য, কোহলি সেঞ্চুরির জন্য। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে দীর্ঘ ২৫ বছরে সিরিজ জয়ের ইতিহাস গড়েছিলেন এক ম্যাচ আগেই। তিন অঙ্কের ম্যাজিক্যাল-ফিগারে সেঞ্চুরিয়ানের শেষ ওয়ানডেটাও রাঙিয়ে দিয়েছেন ভারত অধিনায়ক। মাত্র ২০৫ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে কোহলি অপারাজিত ১২৯! ২০৮তম পঞ্চাশ ওভারের ম্যাচে এটি তার ৩৫ নম্বর সেঞ্চুরি, সিরিজে তৃতীয়। স্রেফ অবিশ্বাস্য। গড়েছেন দ্বিপক্ষীয় কোন সিরিজে সর্বাধিক ৩ সেঞ্চুরি ও সর্বোচ্চ ৫৫৮ রানের নতুন রেকর্ড। স্যার ভিভ রিচার্ডস না ভারতীয়দের ক্রিকেটঈশ্বর শচীন টেন্ডুলকর, কে ওয়ানডে ইতিহাসের সেরা ব্যাটসম্যান? বিতর্কটা পুরনো। কোহলি-কীর্তি দেখার পর স্বয়ং ভিভ যখন বলছেন, ‘আমি নিজেও ওর মতো এত ভাল ছিলাম না।’ আর সাবেক ইংলিশ অধিনায়ক মাইকেল ভনের টুইট, ‘৩৫তম...! ওয়ানডেতে কোহলিই সর্বকালের সেরা।’ টুইটে সাবেক ভারতীয় মোহাম্মদ কাইফের প্রতিক্রিয়া, ‘এই সিরিজের আগে ২০২ ওয়ানডেতে ৩২ সেঞ্চুরি ছিল ‘কিং কোহলির’। অর্থাৎ প্রতি ৬.৫ ইনিংসে একটি করে সেঞ্চুরি, যা সত্যিই বিস্ময়কর। কিন্তু এরপর সে পরের ৬ ওয়ানডেতে আরও ৩টি সেঞ্চুরি করল। আমরা আশীর্বাদপুষ্ট জাতি, কোহলির মতো আর কেউ নেই।’ ছয় ওয়ানডের এই সিরিজে কোহলির স্কোর : ১১২, ৪৬*, ১৬০*, ৭৫, ৩৬ ও ১২৯*। বুঝিয়ে দিয়েছেন, সত্যিই তাঁর মতো আর কেউ নেই। প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে দ্বিপক্ষীয় ওয়ানডে সিরিজে করছেন পাঁচ শ’র (৫৫৮) ওপরে রান। ভারতীয় অধিনায়ক এ পথে ভেঙেছেন তাঁর সতীর্থ রোহিত শর্মার ৪৯১ রানের রেকর্ড। ওয়ানডেতে দ্বিপক্ষীয় সিরিজে অধিনায়ক হিসেবে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডও এখন কোহলির। এ পথে তিনি পেছনে ফেলেছেন অস্ট্রেলিয়ার জর্জ বেইলিকে। ভারতের বিপক্ষে ২০১৩-১৪ মৌসুমে সিরিজে ৪৭৮ রান করেছিলেন তিনি। দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে দেশটির বিপক্ষে দ্বিপক্ষীয় ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড এখন ‘কিং কোহলি’র। দ্বিপক্ষীয় সিরিজে প্রথম ভারতীয় হিসেবে তুলে নিয়েছেন তিন-তিনটি সেঞ্চুরি। প্রোটিয়াদের সাদামাটা সংগ্রহ তাড়া করতে নেমে কোহলি ফিফটি পূর্ণ করেন ৩৬ বলে। ৩৫তম ওয়ানডে সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছেন ৮২ বলে। ম্যাচে বিরতি চলাকালে ধারাভাষ্যকক্ষে ক্যারিবীয় কিংবদন্তি মাইকেল হোল্ডিংকে ফোন করে স্বয়ং ভিভ রিচার্ডস বলেছেন, ‘আমি কখনোই কোহলির মতো এত ভাল ছিলাম না।’ কোহলির এই ৩৫ সেঞ্চুরিকে ব্যাখ্যা করা যায় এভাবে পক্ষ প্রথম ৭০ ওয়ানডেতে ছিল ৭ সেঞ্চুরি। কিন্তু পরবর্তী ১৩৮ ওয়ানডেতে ২৮ সেঞ্চুরি! ২০১১ সাল থেকে কোহলি প্রতি ৪.৯ ম্যাচে তুলে নিয়েছেন একটি করে সেঞ্চুরি। ভাবা যায়! ২০৮ ওয়ানডেতে ৫৮.১০ গড়ে তার মোট রান এখন ৯,৫৮৮। সাড়ে নয় হাজার রানে পৌঁছাতে দক্ষিণ আফ্রিকার এবিডি ভিলিয়ার্সকে ছাড়িয়ে গেছেন কোহলি। ওই রান করতে এবির লেগেছিল ২১৫ ইনিংস, কোহলির ২০০। এদিন অপরাজিত সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে যখন মাঠ ছাড়ছিলেন তখন প্রতিপক্ষ খেলোয়াড় হিসেবে ডি ভিলিয়ার্সাই প্রথম ভারত অধিনায়ককে অভিনন্দন জানান। এছাড়া টেস্ট, ওয়ানডে ও টি২০, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সব ফরমেট মিলিয়ে সবচেয়ে দ্রুত ১৭ হাজার রানের রেকর্ডও গড়েছেন কোহলি। অথচ দুই টেস্টে হেরে সফর শুরু করেছিল ভারত, ‘প্রথম দুই টেস্টে মানসিকভাবে কিছু সমস্যা হয়েছিল আমাদের। কিন্তু জোহানেসবার্গ থেকেই আমরা ঠিক করি আর পিছানো চলবে না। টেস্ট সিরিজ হারের দিনেও সকলের সামনে এসে এ কথাই বলেছিলাম। এ বার একদিনের সিরিজ জিতে এসে বলব, সিরিজ কিন্তু এখনও শেষ হয়নি। টি২০তেও আমাদের এই পারফরম্যান্সই ধরে রাখতে হবে। একই সঙ্গে এ দিন নিজের ভবিষ্যত পরিকল্পনাও জানিয়ে দিয়েছেন ভারত অধিনায়ক। বলেন, ‘এখনও আট-নয় বছর ক্রিকেট খেলব। আর তার পুরো সময়টাই সেরা পারফর্ম করে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। এটা আশীর্বাদ যে আমি সুস্থ অবস্থায় দেশের অধিনায়কত্ব করতে পারছি। দেশের হয়ে যত দিন খেলব তত দিন এক শ’ বিশ ভাগ দিতে চাই।’ কোহলি আরও যোগ করেন, ‘ক্রিকেট জীবনের এই সময়ে এসে মনে হয় না, কারও সঙ্গে প্রতিযোগিতা রয়েছে। কারণ, আমার ক্রিকেট-দর্শনটা খুব সোজা। সেটা হলো, কী ভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি। আর ম্যাচে গিয়ে কী ভাবে তা কাজে লাগাচ্ছি। এর বাইরে আর কিছুই নয়।’ ভন- ভিভ রিচার্ডসের মতো অনেকেই কোহলিকে ওয়ানডে ইতিহাসে সেরা ব্যাটসম্যান বলছেন। সুপার কোহলি অবশ্য এসব নিয়ে ভাবেন না, ‘আমার এ রকম ‘সেরা ব্যাটসম্যান’ মার্কা ছাপ দরকার নেই। দরকার নেই সংবাদের শিরোনাম হওয়াও। আমার কাজ মাঠে নেমে নিজের সেরাটা দিয়ে জয়টা নিয়ে আসা। এটা ক্রিকেট-কলমচিদের ব্যাপার। তাঁরা যা মনে করবেন তা লিখতে পারেন। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে এ রকম কোনও ‘ট্যাগ’ চাই না।’ এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মূলত টেস্টে সিরিজ (২-১এ) হারের পর তাঁকে নিয়ে যে সমালোচনা হয়েছিল, সেটিরই জবাব দিয়েছেন কোহলি।
×