ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নতুন করে ‘পুরনো’ চেহারায় বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৬:৪৬, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

নতুন করে ‘পুরনো’ চেহারায় বাংলাদেশ

চার বছর আগে এমন দুর্গতি দেখা গিয়েছিল সর্বশেষ। সবাই আঁতকে উঠেছিলেন পুরনো যুগে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল ফিরে যাচ্ছে এমন শঙ্কায়। ২০১৪ সালে পরিস্থিতিটা এমন হয়েছিল যে সফরকারী ভারতের ‘বি’ ক্যাটাগরির দলটির বিপক্ষে ওয়ানডেতে ১০৫ রান তাড়া করতে গিয়ে ৫৮ রানেই গুটিয়ে গিয়েছিল স্বাগতিক বাংলাদেশ। সে কারণে কোচ বদল, নেতৃত্বে বদল আনা হয়েছিল। তারপর এলো সুবর্ণ সময়। সুফল পেতে শুরু করল বাংলাদেশ ক্রিকেট। তারপর টানা সাড়ে তিন বছর স্বপ্নময় যাত্রা ছিল তিন ফরমেটের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। ক্রমেই বিশ্ব ক্রিকেটে নিজেদের আধিপত্যের ডালপালা ছড়াতে শুরু করেছিল টাইগাররা। বিশেষ করে দেশের মাটিতে অন্য টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর মতোই হয়ে উঠেছিল অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু ‘পুরনো’ সেই গা ছমছমে, ভীতিকর অবস্থার যেন শুরু হয়ে গেল নতুন বছরের শুরুতেই। ঘরের মাটিতে সফরকারী শ্রীলঙ্কার কাছে তিন ফরমেটের ক্রিকেটেই যেভাবে ভরাডুবি হলো বাংলাদেশ দলের, তাতে নতুন করে যেন ‘পুরনো’ সেই চেহারায় বেরিয়ে পড়েছে। ২০১৪ সালে টানা হারের বৃত্তে বন্দী হয়ে পড়েছিল বাংলাদেশ দল। বছরের শুরুতেই সফরকারী শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে ৩-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ দিয়ে শুরু। এরপর এশিয়া কাপে সবগুলো ম্যাচে পরাজয় (এর মধ্যে আফগানিস্তানের বিপক্ষেও ছিল হার)। এরপর ‘বি’ ক্যাটাগোরির দল নিয়ে আসা ভারতের কাছে ২-০ এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ৩-০ ব্যবধানে হার। একই সময়ে টেস্ট ক্রিকেটে শ্রীলঙ্কার কাছে ১-০, ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ২-০ ব্যবধানে পরাজয়। টি২০ সিরিজে লঙ্কানদের কাছে ২-০, ঘরের মাটিতে টি২০ বিশ্বকাপে নেপালের কাছে হারসহ শতভাগ ব্যর্থতা ইত্যাদি ফলাফলগুলো ঘোর অমানিশায় নিমজ্জিত করছিল বাংলাদেশ দলকে। শেষ পর্যন্ত কোচ বদলে ফেলে বাংলাদেশ। চান্দিকা হাতুরাসিংহে কোচ হওয়ার পর অবশ্য তার প্রথম মিশনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে অন্ধকারে কোন আলোর নিশানা আনতে পারেননি। তবে ঘরের মাটিতে বছরের শেষভাবে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে সিরিজে হাতুরাসিংহের ভেল্কি শুরু হয়। যখন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কোচ ছিলেন আমূল বদলে ফেলেছিলেন চেহারা। দল নিয়ে যেমন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন তাতেই সফল হয়েছেন। নিজেদের ক্রিকেট ইতিহাসে সেরা অবস্থানে চলে গিয়েছিল বাংলাদেশ দল। এসেছিল অনেক কিছুতেই পরিবর্তন। সেই পরিবর্তনগুলোও দেশের ক্রিকেটে ইতিবাচক হয়েই এসেছিল। বিশেষ করে ঘরের মাঠে বিশ্বের যে কোন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু কোচ হাতুরাসিংহে দায়িত্ব ছাড়ার পর ঘরের মাটিতে প্রথম যে মিশন ছিল দলের সেখানেই চরম ভরাডুবি। সেই ভরাডুবিটা শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে যাদের কোচ এখন হাতুরাসিংহে। সাড়ে তিন বছর বাংলাদেশ দলকে কোচ হিসেবে যত সাফল্য এনে দিয়েছিলেন এক সফরেই তিনি লঙ্কানদের হয়ে সব ছিনিয়ে নিয়ে গেছেন। ত্রিদেশীয় ওয়ানডে সিরিজে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে শ্রীলঙ্কা, টেস্ট সিরিজে ১-০ ব্যবধানে জিতেছে এবং টি২০ সিরিজে ২-০ ব্যবধানে স্বাগতিক বাংলাদেশকে হোয়াইটওয়াশ করেছে। অথচ এই শ্রীলঙ্কা দলটির অবস্থা ছিল নাজুক। প্রায় দুই বছর ধরেই তারা টেস্ট, ওয়ানডে ও টি২০ এই তিন ফরমেটের ক্রিকেটেই টানা ব্যর্থতায় নিমজ্জিত ছিল। কোনভাবেই প্রতিপক্ষদের সঙ্গে পেরে ওঠেনি। এমনকি গত বছর ঘরের মাঠে সফরকারী জিম্বাবুইয়ের মতো একটি দুর্বলতর দলের কাছে ওয়ানডে সিরিজে ৩-২ ব্যবধানে হেরে যায় তারা। অথচ, বরাবরই ঘরের মাটিতে যেকোন দলের বিরুদ্ধে দুরন্ত লঙ্কানরা। ওই সিরিজের পর লজ্জায় নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ান এ্যাঞ্জেলো ম্যাথুস। আগাগোড়া পরিবর্তনের হাওয়া লাগে শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটে। তারা বাংলাদেশের সফলতম কোচ হাতুরাসিংহেকে ছিনিয়ে নেয়। শ্রীলঙ্কান এ কোচ ২০১৪ সালের মে মাসে বাংলাদেশের দায়িত্ব নেয়ার পর দলকে নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গিয়েছিলেন। সেই সফরে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানকে ছাড়াই গিয়েছিল বাংলাদেশ। কারণ, তার বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও অসদাচরণের জন্য বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) কাছে লিখিত অভিযোগ করে প্রয়োজনী ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছিলেন হাতুরাসিংহে। দেশসেরা, অপরিহার্য ক্রিকেটার হলেও শৃঙ্খলা আসল ব্যাপার সেটাই প্রমাণিত হয়। সাকিব নিষিদ্ধ হন ৬ মাসের জন্য। তবে ক্যারিবীয় সফরে চান্দিকা তার প্রথম মিশনে বিফল মনোরথ হয়ে ফিলেছেন দল নিয়ে। ওয়ানডেতে ৩-০ এবং টেস্টে ২-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ হয়। ফিরেই নেতৃত্বে পরিবর্তন আনেন হাতুরাসিংহে। ওয়ানডে ও টি২০ ক্রিকেটে তিনি অধিনায়ক হিসেবে ফিরিয়ে আনেন মাশরাফি বিন মর্তুজাকে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি বাংলাদেশকে। টানা সাফল্য আসতে থাকে। দেশের মাটিতে টানা ৬টি ওয়ানডে সিরিজ জয় করেন মাশরাফিরা- এই পরাজিতদের মধ্যে ক্রিকেট পরাশক্তি পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার নামও ছিল। ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপে নিজেদের সেরা সাফল্য হিসেবে প্রথমবার কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে দল। গত বছর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে সেরা সাফল্য হিসেবে সেমিফাইনালে ওঠে। এই ধারাবাহিক সাফল্যের কারণে ওয়ানডে র‌্যাঙ্কিংয়ের ৭ নম্বরে ওঠে বাংলাদেশ। টেস্ট ক্রিকেটে প্রথমবার জয় তুলে নেয় ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দুই পরাশক্তির বিরুদ্ধে। শ্রীলঙ্কার মাটিতে গিয়ে ঐতিহাসিক শততম টেস্ট জয় আসে। ২০১৬ সালের এশিয়া কাপ টি২০ আসরে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাকে টপকে ফাইনাল খেলে। এই সব সাফল্যই এনে দিয়েছিলেন চান্দিকা বাংলাদেশ দলকে। তবে তার বেশকিছু সিদ্ধান্তে বিতর্ক তৈরি হয়। একক কর্তৃত্বে তিনি দল পরিচালনা করতে শুরু করেছিলেন। অপরিহার্য দুই ক্রিকেটার মুমিনুল হক ও মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকে টেস্ট খেলার অনুপযুক্ত ঘোষণা করে বাদ দিয়েছিলেন। নিজের পছন্দসই কয়েকজন ক্রিকেটারকে জাতীয় দলে নিয়মিত করেছিলেন ক্রমাগত ব্যর্থতার পরও। এছাড়া টেস্ট অধিনায়ক মুশফিকুর রহীমের সঙ্গে গত বছর দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গিয়ে মতানৈক্যটা জটিল আকার ধারণ করেছিল। ওই সময় শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের কাছে প্রস্তাব পেয়েই লুফে নেন হাতুরাসিংহে। হুট করেই পদত্যাগ করেন বাংলাদেশের দায়িত্ব থেকে। এবার সেই হতাশাগ্রস্ত লঙ্কানদের নিয়েই বাংলাদেশ সফর ছিল তার প্রথম মিশন। ত্রিদেশীয় সিরিজে প্রথম দুই ম্যাচে জিম্বাবুইয়ে ও বাংলাদেশের কাছে হার দেখে শুরু হয়েছিল তার। এরপর থেকেই যেন কোন জাদুমন্ত্রে বদলে যায় শ্রীলঙ্কা। পরে টানা তিন ম্যাচ জিতে হয় চ্যাম্পিয়ন। দুইবারই স্বাগতিক বাংলাদেশকে লজ্জাজনক পরাজয় উপহার দেয়। টেস্ট সিরিজের প্রথম ম্যাচে ভাল অবস্থানে থেকেও শেষ পর্যন্ত ড্র করে। কিন্তু দ্বিতীয় টেস্টে আর বাংলাদেশকে কোমড় সোজা করে দাঁড়াতেই দেয়নি শ্রীলঙ্কা। টি২০ সিরিজের দুই ম্যাচেই নাস্তানাবুদ করে বাংলাদেশকে তারা। এর পেছনে হাতুরাসিংহের কিছু কৌশলগত পদক্ষেপ, মনস্তাত্ত্বিক খেলাও ছিল বড় ব্যাপার। শ্রীলঙ্কার দায়িত্ব নিয়েই তিনি বেশ কিছু কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন এবং অধিনায়ক হিসেবে ম্যাথুসকে আবার ফেরান। যদিও ম্যাথুস ইনজুরিতে পড়ে আর খেলতে পারেননি। ক্রিকেটারদের জন্য অস্ট্রেলিয়া থেকে বিশেষজ্ঞ মনোবিদ এনেছিলেন, যা তিনি বাংলাদেশের দায়িত্ব নেয়ার পরেও করেছিলেন। বাংলাদেশ দলের প্রতিটি ক্রিকেটার সম্পর্কে, কোচেদের কৌশল এবং উইকেট পরিস্থিতি সম্পর্কে সূক্ষ্ম ধারণা ছিল হাতুরাসিংহের। সেসবকেই অস্ত্র হিসেবে প্রয়োগ করে বাংলাদেশ দলকে করেছেন ঘায়েল। যা দিয়েছিলেন, এক মিশনেই সব নিয়ে গেছেন চান্দিকা।
×