ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আজ ভাঙছে প্রাণের মেলা, বৃষ্টির গভীর ক্রন্দনে বিদায়ের সুর...

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

আজ ভাঙছে প্রাণের মেলা, বৃষ্টির গভীর ক্রন্দনে বিদায়ের সুর...

মোরসালিন মিজান ॥ সব চেয়ে পুরাতন কথা, সব চেয়ে/গভীর ক্রন্দন- ‘যেতে নাহি দিব’। অমর একুশে গ্রন্থমেলার শেষভাগে এসে রবীন্দ্রনাথের সেই গভীর ক্রন্দন যেন অনুভূত হচ্ছে ভেতরে। প্রাণের মেলা সাঙ্গ হচ্ছে, মানতে মন চায় না। অথচ আজ বুধবার অমর একুশে গ্রন্থমেলার সমাপনী দিন। আহা কী মন খারাপ! এক মাসের আয়োজন। তবুও যেন পিপাসা মেটে না। তবুও বলতে মন চায়, থেকে যাও। ‘যেতে নাহি দিব’। এতগুলো দিন বইয়ের সঙ্গে ছিলেন পাঠক। সব বয়সী মানুষ প্রতিদিন মেলায় এসেছেন। আজও আসবেন। বইয়ের টানে শুধু। বই ঘিরে আহা কী সুন্দর উৎসব! এই উৎসব শেষ হতে আছে? মন কেমন যেন ব্যথায় ডুবে যায়। ভেতরে কী নেই কী নেই একটা অনুভব। হারানোর ব্যথা। তবুও সত্য যে, মেলার আজ শেষ দিন। লেখক পাঠক প্রকাশকের প্রাণের মেলা সাঙ্গ হচ্ছে আজ রাতে। গোটা শহরের সব পথ এসে মিশে যেত বাংলা একাডেমিতে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। কাল থেকে দৃশ্যটি আর দেখা যাবে না। বিষণœতা ঘিরে ধরেছে। অবশ্য তারও আগে মঙ্গলবার রাতে হঠাৎ খুব কেঁদেছে আকাশ। শেষ বেলার বৃষ্টিকে কান্না ছাড়া আর কী বলা যায়? অবশ্য ঝড় হাওয়া সঙ্গে ছিল। হাওয়া আর জলে ভিজে একাকার মেলা প্রাঙ্গণ। প্রতি বছরই এই মাসে একবার অন্তত বৃষ্টি হয়। যারা বহু বছর ধরে মেলায় অংশগ্রহণ করেন তারা জানেন। প্রস্তুতিও থাকে। কিন্তু বিকেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশ করে দেখা গেল, বহু বই ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। বিভিন্ন স্টল ও প্যাভিলিয়নের সামনের খোলা জায়গায় কুঁকড়ে যাওয়া বই। টাটকা নতুন বইয়ের এমন দুরাবস্থা দেখে কী যে খারাপ লাগে। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর স্টলের ভেতরেও পানি ঢুকে গিয়েছিল। চারদিক খোলা প্যাভিলিয়নগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানি নিষ্কাশনের সুবিধা রেখে যারা প্যাভিলিয়ন ও স্টল করেছেন তাদের ক্ষতি হয়েছে কম। দিনের প্রথমভাগে ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে কথাও হয়েছে অনেক। প্রকাশক ওসমান গনি বলেন, দেশে কত বড় বড় ইভেন্ট হচ্ছে এখন। অথচ আমাদের বইগুলো আমরা বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচাতে পারি না। প্রতি বছর ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়। এ জন্য আয়োজক বাংলা একাডেমির সমালোচনা করে তিনি বলেন, মেলা থেকে একাডেমির আয় অনেক। সে তুলনায় তারা খরচ করে সামান্যই। দুর্যোগ ব্যববস্থাপনা সম্পর্কে আয়োজকদের কোন ধারণা নেই। এ নিয়ে আগ্রহ আছে বলেও মনে হয় না। ফলে প্রতি বছর অসংখ্য বই ভিজে নষ্ট হয়। একদিনের হঠাৎ বৃষ্টি থেকে বই রক্ষা করা যাবে না এটা কেমন ব্যবস্থাপনা? একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের কাছে জানতে চান তিনি। এ দিকে, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেলায় আসতে শুরু করেন বইপ্রেমীরা। শেষবেলায় প্রতি বছরই বিপুল বিক্রি হয়। এ দিনও ব্যতিক্রম ছিল না। গল্প আড্ডাগুলো ছোট ছিল। সবাই ভিড় করেছিলেন স্টলের সামনে। খুঁজে খুঁজে বই কিনেছেন। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান প্রথমার সামনে কথা হচ্ছিল তারিক ও হুমায়রার সঙ্গে। দুই ভাই বোন। খিলগাঁ থেকে এসেছিলেন। সাহিত্য তো বটেই, রাজনীতি ইতিহাস দর্শনের বেশ কিছু বই তাদের হাতে। তারিক বললেন, সিরিয়াস বই পড়তেই ভাললাগে। তবে মেলায় অপ্রয়োজনীয় বই অনেক। ভাল বই খুঁজতে টায়ার্ড হয়ে যেতে হচ্ছে। আজ সমাপনী দিনেও মেলায় আসবেন বলে জানান তিনি। সঙ্গে থাকা হুমায়রা বলেন, আমরা এর আগে মেলায় এসেছি। বইও কিনেছি। কিন্তু অনেক বই কিছুদিন আগে এসেছে, সেগুলো আজ কিনলাম। অনেক আগে প্রকাশিত বই যেগুলো পড়া হয়নি সেগুলো কিনেছেন বলে জানান হুমায়রা। তবে মেলা শেষ হয়ে যাচ্ছে প্রসঙ্গটি ওঠতেই মন খারাপ হয়ে গেল দুজনের। হুমায়রা মজার কথা বললেন। বললেন, এই মেলাটা শেষ না হলেই ভাল হতো! হুমায়ুন আজাদ স্মরণ ॥ এই মেলায় এই বইয়ের উৎসবে আক্রান্ত হয়েছিলেন হুমায়ুন আজাদ। ২০০৪ সালে দেশের বিশিষ্ট ভাষা বিজ্ঞানী ও প্রথাবিরোধী লেখককে কুপিয়ে জখম করে উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদীগোষ্ঠী। সেই কালো দিন ২৭ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার স্মরণ করা হলো প্রয়াত লেখককে। খুব উল্লেখযোগ্য কর্মসূচী নয়। লেখক পাঠক প্রকাশকরা নিজেদের দায় থেকে দাঁড়িয়েছিলেন বাংলা একাডেমি চত্বরে। ব্যানার হাতে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেন তারা। মুক্ত চিন্তার পক্ষে লেখকের স্বাধীনতার পক্ষে নিজেদের অবস্থানের কথা জানান। একুশ মানে মাথা নত না করা। বাংলা একাডেমির কর্তারা এর ঠিক উল্টো। এবারও তারা ভুলে ছিলেন মৌলবাদীদের হাতে খুন হওয়া লেখক অভিজিৎ রায়কে। প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনের নাম উচ্চারণ করার সক্ষমতাও অর্জন করতে পারেননি তারা। মাথা নত করে ছিলেন। মাথা নত করে আছেন। তবে আশার কথা এই যে, তাদের পেছনে ফেলেই এগিয়ে যাবে ইতিহাস। এগিয়ে যাচ্ছে। নতুন বই ॥ মেলায় নতুন বই আসা অব্যাহত রয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ে লেখা বইয়ে সাজানো স্টল ও প্যাভিলিয়ন। চারুলিপি প্রকাশ করেছে জাহানারা ইমামের লেখা ‘জীবন বহে নিরবধি’। মৃত্যুর আগে আত্মজীনী লেখার কাজ শুরু করেছিলেন শহীদ জননী। শেষ করে যেতে পারেননি। অসমাপ্ত সেই রচনা প্রকাশিত হলো এবার। কবি মুহাম্মদ সামাদের কাব্যগ্রন্থ ‘আমি নই ইন্দ্রজিৎ মেঘের আড়ালে’। প্রকাশ করেছে অনন্যা। নীরবে নিজস্ব ভাব ও ভাষায় সময়ের কথা বলে চলেছেন সামাদ। বইয়ের ভাষায় বললে- এই ন্যুব্জ সমাজের উৎকট নষ্টামিকে ছিঁড়ে খুঁড়ে সুতীক্ষè সত্যের মতো তার কবিতার ধারালো আন্তরিকতা আমূল বিদ্ধ করে মানুষের তৃষ্ণার্ত হৃৎপি-। সৈয়দা রাশিদা বারীর বই ‘বাংলাভাষা বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু’। মায়ের ভাষা দেশ মাটি এবং বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রচিত কবিতা মালা প্রকাশ করেছে পার্ল পাবলিকেশন্স। য়ারোয়া বুক কর্নার থেকে এসেছে ‘নীল জল অরণ্য’। লেখক শ্যাম সুন্দর সিকদার। মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে ছিল ‘বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলা এবং বাংলাদেশের প্রকাশনার মান উন্নয়নের সমস্যা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন খান মাহবুব। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন বদিউদ্দিন নাজির, রেজাউদ্দিন স্টালিন ও মোস্তফা সেলিম। সভাপতিত্ব করেন ফজলে রাব্বি। সন্ধ্যায় ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
×