ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অভিমত ॥ বইমেলা হোক সাহিত্যচর্চার কেন্দ্র

প্রকাশিত: ০৩:৩৭, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

অভিমত ॥ বইমেলা হোক সাহিত্যচর্চার কেন্দ্র

‘বইমেলা কেবলই বই কেনাবেচার জন্য নয়, বইমেলা সবাইকে আকৃষ্ট করেও সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করবে।’ এই উক্তিটি প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং করেছেন ১ ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী একুশে বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে প্রধান অতিথির ভাষণে। দেশের সরকারপ্রধানের বক্তব্যে আরও উঠে এসেছে যে, এই গ্রন্থমেলা অনেক নবীন লেখককে তাদের সাহিত্যচর্চার কর্মফল প্রকাশের সুযোগ করে দেয় এবং নতুন পাঠক তৈরিতে বিশেষ অবদান রাখে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে নানা সংগ্রামের পরিক্রমায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ভাষাভিত্তিক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা সারা বিশ্বের মানুষের কাছেই এক মহাবিস্ময়কর ব্যাপার হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। আবেগময় সেই ভাষণ থেকে বেরিয়ে এসেছিল বাংলা ভাষাকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রাম, যা ১৯৪৭-এ দেশ বিভাজনের পর থেকে শুরু হয়ে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি চূড়ান্ত রূপ নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রামসহ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার মূল চার নীতি যথাক্রমে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। একুশের ভাষা আন্দোলন আমাদের শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ যা প্রতিবছর কালের বৈচিত্র্যে শীত-বসন্তে আমাদের কাছে উপস্থিত হয় যাকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন প্রাণের মেলা। এবারকার গ্রন্থমেলার পরিসর বৃদ্ধি পেয়েছে পাঁচ বর্গ কিলোমিটারব্যাপী বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোরওয়ার্দী উদ্যান মিলে, যেখানে সারা মাসব্যাপী অনুষ্ঠানের মধ্যে থাকবে সাংস্কৃতিক পারিবেশনা, সেমিনার, আলোচনাসভা ইত্যাদি। এবার বইয়ের স্টলের সংখ্যাও বিগত বছরের তুলনায় অনেক বেশি হওয়ায় দর্শনার্থীরা তাদের ইচ্ছেমতো ঘুরেফিরে বই ক্রয়ের আনন্দ উপভোগ করতে পারছে। এবারকার একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার-২০১৭ প্রদান করা হয়েছে ১০টি খাতে; যথাÑ কবিতা, কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ, গবেষণা, অনুবাদ, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্য, ভ্রমণ কাহিনী, নাটক, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ও শিশুসাহিত্য। দেশের প্রধানমন্ত্রীর মতোই অনেকই মনে করেন বইমেলা শুধু কেনাবেচা নয়, এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, গণতন্ত্রের আন্দোলন, বাঙালি জাতীয়তাবাদের চিন্তা-চেতনার প্রকাশ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এই গ্রন্থমেলার সঙ্গে জড়িত আছে সংস্থা হিসেবে বাংলা একাডেমি, বিভিন্ন বই প্রকাশক সংস্থা, সরকারী-বেসরকারী সংস্থার বইয়ের স্টল, লেখক ও অগণিত পাঠক। এসব অংশীদারদের নিজস্ব একটা ব্যবসায়িক দিক রয়েছে শিল্প সংস্কৃতি চর্চার অন্তরালে। বাংলা একাডেমি তাদের আয়োজনের অংশ হিসাবে যে স্টল বরাদ্দ দিয়ে থাকে সেখান থেকে একটি মোটা অঙ্কের টাকা রাজস্ব আসে। আবার অনেকেই স্টল বরাদ্দ নিয়ে তাদের বই প্রদর্শনের আয়োজন করে বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে। যার মধ্যে রয়েছে পূর্বে আলোচিত প্রকাশক, লেখক, ব্যবসায়ী। যাদেরও দিন শেষে আয়-ব্যয়ের একটি হিসাব রাখতে হয় এই মেলাকে ঘিরে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, পণ্য হিসাবে বই ক্রেতা কেউ ছাত্রছাত্রী, কেউ গবেষক, কেউ সৌখিন ক্রেতা, কেউ আবার কবি সাহিত্যিক। এরই মধ্যে কেউ রয়েছে শিশু শ্রেণী এবং প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিনিধি যারা নিজের প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগারকে সমৃদ্ধ করার জন্য ক্রেতা হিসাবে আবির্ভূত হয়। একটি তথ্যে দেখা যায় যে, ২০১৭ সালের বইমেলায় ৬০ কোটি টাকার উপরে বই বিক্রি হয়েছিল এবং বর্তমান বছরে এই অঙ্কটি আরও বাড়বে বলে আশা করা যায়। যা একটি সুখবর। বিশেষত; আমাদের মতো বই পাঠের চর্চাবিমুখ মানুষের দেশে। সেই বইগুলো বইপ্রেমিক মানুষের ঘরের সৌন্দর্য বর্ধনের উপকরণও বটে- যা বই মেলারই অবদান। কারণ বইয়ের চেয়ে সুন্দর কিছু আছে বলে মনে হয় না। প্রতিটি সৃজনশীল সংস্কৃতিমনা মানুষই হয়ত তা বুঝেন। তারা বছরের এই ক্ষণটির দিকে তাকিয়ে থাকে। কখন ফেব্রুয়ারি মাস আসবে আর প্রকাশনা সংস্থা তথা মুদ্রণ কর্মীরা তাদের বিনিদ্র রজনী কাটাবে মেলা শুরু হওয়ার আগে থেকেই নতুন বই মুদ্রণের প্রয়াসে, যা প্রকাশনা শিল্পের জন্য একটি আলোকিত দিক। প্রতিদিনই মেলায় নতুন বই আসছে যা মেলার নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে প্রচার করা হয়ে থাকে এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার কর্মীরা তাদের বিধিবদ্ধ দায়িত্বের অংশ হিসাবে বিশেষ ব্যক্তিদের সাক্ষাতকার গ্রহণ করে তাদের নির্ধারিত চ্যানেলগুলোতে সংবাদের অংশ হিসাবে প্রচার করছে প্রতিনিয়ত। এই ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি এবং এই মাসের ২১ তারিখটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসাবে স্বীকৃতির মাধ্যমে দেশের ভাবমূর্তি বৈদেশিক অঙ্গনে অনেক প্রসারিত হয়েছে। এখন সাহিত্যের মানদ-ে আমরা যদি এই সময়টিকে ঘিরে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় সৃষ্টির বিষয়গুলোকে মূল্যায়ন করি তাহলে দেখা যাবে কবিতা ও উপন্যাসের ক্ষেত্রে একটা শূন্যতার আভাস অর্থাৎ সাহিত্যের অন্যান্য শাখার চেয়ে এই শাখা দুটোতে সংখ্যাধিক্যের ভিত্তিতে সৃষ্টি কম যদিও মানের কথা বিবেচনায় আনা যায় না। আবার অন্যান্য শাখায় লেখক থাকলেও মানসম্মত লেখার স্বল্পতা পরিলক্ষিত হয় এই ফেব্রুয়ারি মাসকে ঘিরে। যারা সাহিত্য সমালোচক তারা বলছেন, মানসম্মত সাহিত্য এবং সাহিত্যিকের সংখ্যা ক্রম অবনতিশীল বিধায় আগ্রহে ও পেশায় দুটিতেই কেমন একটা স্থবিরতা পরিলক্ষিত হয় সৃষ্টিশীল কাজে। বিষয়টি এমন যে, সাহিত্য সৃষ্টি বা সাহিত্যিক হওয়া একটা ব্যক্তিগত আগ্রহের ব্যাপার যা একটি অনুকূল পরিবেশ পেলে প্রস্ফুটিত হয় এবং এর ধারাবাহিকতা অনেকদিন পর্যন্ত চলে। এটি কোন অনুকরণের বিষয় কিংবা সৌখিন বিষয় নয়। এই জায়গাটিতেই রয়েছে সঙ্কট। কেউ যদি এটাকে পেশা হিসাবে নিতে চায় তবে আর্থিক দৈন্যর সম্মুখীন হতে হবে, এটাই বাস্তব। বিশেষত: প্রতিযোগিতামূলক বাজার অর্থনীতির যুগে যেখানে জ্ঞানচর্চার ফসলের বাজার সংগঠিত নয়। আবার সামাজিক স্বীকৃতিও এখানে সহজে ধরা দেয় না। যার ফলে ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চাও ক্ষীণ হয়ে আসছে প্রজন্মের জ্ঞানশূন্যতার কারণে। যারা চলে যাচ্ছে আর যারা আসছে তাদের মধ্যে গুণগত পার্থক্য আকাশ-জমিন, যা শুধু সাহিত্য বা ভাষার ক্ষেত্রেই নয়, জীবনের সর্বক্ষেত্রে। ফলে মনের খোরাকের জন্য যে সাহিত্য প্রয়োজন সে জায়গাটিতে অভাব থেকে যায়, যার ফলে অস্থিরতা বা অসন্তোষ বা অস্বস্তি এখন প্রায় সব পরিবারেই নিত্যদিনের সঙ্গী এবং মনের স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। এই ধরনের একটি আত্মসামাজিক পরিস্থিতিতে সাহিত্যিক, উপন্যাসিক কিংবা কবি সৃষ্টি বিশেষত: ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী গ্রন্থমেলাকে কেন্দ্র করে কতটুকু অবদান রাখবে তা ভেবে দেখার বিষয়। যারা জনপ্রিয়তা চায় তাদের জন্য এই ধরনের মেলা সাহিত্যসৃষ্টি কেনাবেচার একটি ক্ষেত্র হতে পারে কিন্তু ভাল সাহিত্য বা সৃজনশীল সৃষ্টি কতটুকু সম্ভব হবে তাও ভাবার বিষয়। তবে আয়োজক সংস্থা বাংলা একাডেমি একটি সরকারী প্রতিষ্ঠান হলেও তাদেরও অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে এই মেলার আয়োজন করতে হয় বিশেষত: দেশের সাবির্ক রাজনৈতিক পরিস্থিতিসহ নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে। কারণ অতীতে অনেক জীবনহানির ঘটনা এই মেলাকে কেন্দ্র করেই সংগঠিত হয়েছে যা আমাদের একুশের চেতনাকে বিনষ্ট করেছে। মুক্তবুদ্ধির চর্চা, সৃজনশীলতার চর্চা, সৃজনশীল সাহিত্যের চর্চা ইত্যাদি অনেকক্ষেত্র এই মেলায় আগত কবি সাহিত্যিক দর্শনার্থীদের জীবনের ঝুঁকি যে বাড়িয়ে দেয় তা আমাদের মনে রাখতে হবে অতীতের ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। তাই আমাদের মতাদর্শগত বিরোধগুলো নৈতিকভাবেই মোকাবেলা করতে হবে। গ্রন্থমেলা কোনভাবেই এর ক্ষেত্র হতে পারে না বা ক্ষেত্র হতে দেয়া যায় না। তাহলে পূর্বে ঘোষিত প্রাণের মেলা কথাটির কোন গুরুত্বই থাকে না যদিও এর মধ্যে অনেক আবেগ রয়েছে যা দিয়ে সত্যিকার অর্থে জীবন চলে না। এখন যারা সাধারণ মানুষ কিংবা ছাত্রছাত্রী তাদের কাছে এই সব কথার অর্থ নিরর্থক বলে মনে হতেই পারে। আমাদের দেশে যত বেশি লেখক তৈরি হবে তত বেশি পাঠকের সংখ্যা বাড়বে। কারণ একজন লেখক একজন পাঠকও। আর লেখা বাড়লেও প্রকাশনা শিল্প আরও বেশি অবদান রাখবে অর্থনীতিতে যা আমাদের আশার আলো দেখাবে সামনের দিকে চলতে। তাই বইমেলা হোক সাহিত্যচর্চার কেন্দ্র ও তীর্থভূমি। লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ ও গবেষক
×