ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নির্ধারিত সময়ের আগে মধ্য আয়ের দেশের ৩ শর্ত পূরণ হবে

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

নির্ধারিত সময়ের আগে মধ্য আয়ের দেশের ৩ শর্ত পূরণ হবে

সংসদ রিপোর্টার ॥ চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বাজেটের মোট বরাদ্দের ১১ দশমিক ৭ শতাংশ ব্যয় হয়েছে। তবে সার্বিকভাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। এ সময় অনুন্নয়ন খাতে ব্যয় হয়েছে বরাদ্দের ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ। আর উন্নয়ন বা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) খাতে ব্যয় হয়েছে ১০ দশমিক ২ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের ‘বাজেট ২০১৭-১৮ ঃ প্রথম প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত বাস্তবায়ন অগ্রগতি ও আয়-ব্যয়ের গতিধারা এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদ অধিবেশনে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন। স্পীকারের অনুমতি নিয়ে কখনও দাঁড়িয়ে আবার কখনও নিজ আসনে বসেই চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের বাজেট বাস্তবায়নের অগ্রগতি তুলে ধরেন অর্থমন্ত্রী। প্রতিবেদন উপস্থাপনকালে অর্থমন্ত্রী বলেন, আর্থ-সামাজিক সকল ক্ষেত্রেই অব্যাহত আছে ইতিবাচক পরির্তনের ধারা। চলতি অর্থবছরের অক্টোবরের মাঝামাঝি জাতিসংঘের সিডিপি সচিবালয়ের একটি মিশন বাংলাদেশ সফর করে নিশ্চিত করেছে যে, ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ে নির্ধারিত সিডিপি রিভিউ সভার পূর্বেই বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে আসার প্রয়োজনীয় তিনটি শর্ত পূরণ করতে সক্ষম হবে। তিনি বলেন, আর্থ-সামাজিক অগ্রযাত্রার এ মাহেন্দ্রক্ষণকে পুঁজি করে আমরা আরও অগ্রসর হতে চাই। ইতোমধ্যেই ২০৪১ সাল নাগাদ সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যকে সামনে রেখে আমরা সুদূরপ্রসারী কর্মপরিকল্পনা সাজিয়েছি এবং তা বাস্তবায়নে নানামুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে চলেছি। একইসঙ্গে বিশ্বায়নের এ যুগে আমাদের কর্মপরিকল্পনাসমূহকে এসডিজির সঙ্গেও সমন্বয় করে নিয়েছি। অর্থমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যকর ও গতিশীল নির্দেশনায় চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাজেট বাস্তবায়ন, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা ও উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নে আমাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। বিশেষ করে, এ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রফতানি আয়, প্রবাস আয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, ব্যাংক মুদ্রা সরবরাহসহ মৌলিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক চালকসমূহের অবস্থান বেশ সন্তোষজনক। তিনি জানান, চলতি অর্থবছর আমাদের সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ বছর। দুই মেয়াদের প্রায় এক দশকে আমাদের সরকারের অন্তর্ভূক্তিমূলক এবং প্রবৃদ্ধি সহায়ক উন্নয়ন কৌশল দেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বিষ্ময়কর অগ্রগতি এনেছে। শেষ বছরটিতে আমরা বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখছি এক দশকের অর্জনকে সুসংহত করে একটি সুদৃঢ় ভিত রচনা করার জন্য, যার ওপর দাঁড়িয়ে আস্থা ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জাতি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ গঠনের পথে অগ্রসর হতে পারবে। এছাড়া আর্থিক খাতের গুণগত পরিবর্তন আনতে আমরা সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছি, যা অদূর ভবিষ্যতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। অর্থমন্ত্রী দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, দ্রুত ও স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি অর্জনে বাংলাদেশের অর্থনীতির সহজাত সক্ষমতা ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। ধারাবাহিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলস্বরূপ বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের বৈশ্বিক রোলমডেল। বিশ্বসভ্যতা ও জাতীয় উন্নয়নের প্রধান আশঙ্কা জঙ্গীবাদ ও উগ্রপন্থী মনোভাব এবং গোষ্ঠীদের থেকে সমাজকে মুক্ত রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার শূন্য সহনশীলতা নীতি দৃঢ়ভাবে অনুসরণ করছে। বিদ্যুত-জ্বালানি ও যোগাযোগসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সৃষ্টি হচ্ছে বিনিয়োগ সহায়ক পরিবেশ। উন্নয়নের এই মহা আয়োজনে প্রয়োজন সকলের কার্যক্রম অংশগ্রহণ। বাজেটের শেষ পর্যায়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমাদের আছে অকুতোভয়, সৃজনশীল ও কর্মঠ জনশক্তি, সর্বোপরি সাহসী, প্রাজ্ঞ, গতিশীল ও জনহিতৈষি নেতৃত্ব। আর্তমানবতার জন্য সংবেদনশীল মানসিকতা, অভিজ্ঞতা, প্রাজ্ঞ, মেধা, বিচক্ষণতা, আত্মপ্রত্যয় ও দূরদর্শিতার কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন বিশ্বনেতা। যুক্তরাষ্ট্রের সাময়িকী ফরচুনে প্রকাশিত তালিকা মতে বিশ্বসেরা ৫০ জন নেতার মধ্যে তাঁর অবস্থান দশম স্থানে। আমি আস্থার সঙ্গে বলতে পারি যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আমরা আমাদের অভীষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছে যাব ইনশাআল্লাহ। চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে সামষ্টিক অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি তুলে ধরে অর্থমন্ত্রী জানান, এ সময়ে এনবিআর কর রাজস্ব আয় আদায় ১৯ দশমিক ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। মোট সরকারী ব্যয় বেড়েছে ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী বাস্তবায়ন বিগত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ছিল মোট বরাদ্দের ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। এর বিপরীতে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বাস্তবায়নের হার দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ২ শতাংশ। মন্ত্রী জানান, রফতানি আয় বিগত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের ৮ দশমিক ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হতে বেড়ে ৮ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। প্রথম প্রান্তিকে রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৬ শতাংশ, বিগত অর্থবছরে একই সময়ে যা ছিল ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। এছাড়া আমদানি ব্যয় ২৮ দশমিক ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১৩ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার হয়েছে; বিগত অর্থবছরে এ প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। আমদানি ঋণপ্রবাহ ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়েছে। প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। বিগত অর্থবছরে একই সময়ে প্রবাসী আয়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছিল। এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরে ৩২ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। বার্ষিক গড় মুদ্রাস্ফীতি সেপ্টেম্বর ২০১৬ এর ৫ দশমিক ৭ শতাংশ হতে কমে সেপ্টেম্বর ২০১৭ সময়ে সাড়ে ৫ শতাংশ হয়েছে। অর্থমন্ত্রী প্রথম প্রান্তিকের বাজেট বাস্তবায়নের প্রতিবেদন তুলে ধরতে গিয়ে আরও বলেন, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখে উচ্চহারের অন্তর্ভূক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জনে আমরা নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের এই লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতি বিবৃতিতে দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা এবং প্রবৃদ্ধি ও কর্মসৃজনকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদী সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও সামাজিক দায়িত্বশীল অর্থায়ন সহায়ক মুদ্রা ও আর্থিক নীতি অনুসরণের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। আমার বিশ্বাস, দেশের উৎপাদন সক্ষমতার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ঋণ সরবরাহ নির্বিঘœ রাখতে আমরা সক্ষম হব। আবুল মাল আবদুল মুহিত আরও জানান, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উর্ধমুখী থাকায় ভোগ ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে আমদানির চাহিদা বাড়ছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আমাদের মোট আমদানি ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৪৭ হাজার ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বিগত অর্থবছরের তুলনায় ৯ শতাংশ বেশি। সংসদে উপস্থাপিত বাজেট প্রতিবেদনে সরকারী ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ২৬৭ কোটি টাকাকে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছর অনুন্নয়ন-ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২ লাখ ৪৬ হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১১ শতাংশ। আর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ লাখ ৫৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা, যা জিডিপি’র ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। এর মধ্যে তিন মাসে ব্যয় হয়েছে ৪৬ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা। এসব ব্যয়ের মধ্যে অনুন্নয়নসহ অন্যান্য ব্যয় ৩৬ হাজার ১২৯ কোটি টাকা। প্রতিবেদনে ১০টি বৃহৎ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে ব্যয় পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। চলতি বছর তাদের অনুকূলে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে মোট বাজেটের ৫৬ দশমিক শতাংশ। অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে এ মন্ত্রণালয়গুলো মোট বরাদ্দের ১২ দশমিক ৩ শতাংশ। সার্বিকভাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে মোট বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে (এডিপি) বিগত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৬২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। ১০ বৃহৎ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের বাজেট-ব্যয়ের চিত্র প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ভাল করেছে বিদ্যুত মন্ত্রণালয়। ১৮ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকার মধ্যে ৬ হাজার ৭৫ কোটি টাকা ব্যয় করতে পেরেছে এই মন্ত্রণালয়টি। একইভাবে স্থানীয় সরকার বিভাগ মোট বরাদ্দ ২১ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকার মধ্যে ৩ হাজার ৪৫ কোটি টাকা, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ১৬ হাজার ৮২০ কোটি টাকার মধ্যে ২ হাজার ৮১৭কোটি টাকা, রেলপথ মন্ত্রণালয় ১৩ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ২২৮ কোটি টাকা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকার মধ্যে ৪ কোটি টাকা, সেতু বিভাগ ৮ হাজার ৪০৪ কোটি টাকার মধ্যে ৩০৩ কোটি টাকা, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ৭ হাজার ৮৪২ কোটি টাকার মধ্যে ৪২৪ কোটি টাকা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ৮ হাজার ৭৫২ কোটি টাকার মধ্যে ২৭৩ কোটি টাকা, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ২ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকার মধ্যে ১৪৪ কোটি টাকা, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ ৬ হাজার ১৬৫ টাকার মধ্যে ৫৯৫ কোটি টাকা ব্যয় করতে পেরেছে।
×